আদালত নিরাপত্তার নির্দেশনা দিলেও ছাত্রীর পরিবার আশ্বস্ত হতে পারছে না, তিনি ক্যাম্পাসে ফিরতে ভয় পাচ্ছেন।
Published : 01 Mar 2023, 08:28 PM
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কৃত ‘ছাত্রলীগের’ পাঁচ নেতাকর্মী যদি ক্যাম্পাসে ফিরে আসতে পারেন তাহলে তারা আবারও নির্যাতন চালাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী ছাত্রী।
বুধবার হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ নির্যাতনের অভিযোগে ছাত্রলীগের পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার, তারপর তাদেরকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের প্রতিক্রিয়ায় এ আশঙ্কা প্রকাশ করেন প্রথম বর্ষের ওই শিক্ষার্থী।
নির্যাতনের পর থেকে ক্যাম্পাস ছেড়ে পাবনার গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করা ছাত্রী সাংবাদিকদের কাছে চিহ্নিত নির্যাতনকারীদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের দাবি জানান।
“কেননা ওখানে পড়তে গেলে আমাকে কয়েক বছর সেখানে অবস্থান করতে হবে। চিহ্নিত নির্যাতনকারীরা সাময়িক বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের পর ক্যাম্পাসে ফিরে এসে আমার ওপর আবারও নির্যাতন চালাবে বলে আমার আশঙ্কা।”
ছাত্রী আরও বলেন, আদালত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে তার নিরাপত্তায় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিলেও, পরিবার আশ্বস্ত হতে পারছে না। তিনি ক্যাম্পাসে ফিরতে ভয় পাচ্ছেন।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টা থেকে প্রায় ৩টা পর্যন্ত দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের একটি কক্ষে আটকে রেখে র্যাগিংয়ের নামে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ওই ছাত্রীকে ‘বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ’ করেন। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি ঘটনা কাউকে জানালে ‘জীবননাশের হুমকিও’ দেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, হল কর্তৃপক্ষ, হাই কোর্টের নির্দেশে বিচার বিভাগীয় এবং ছাত্রলীগ আলাদা আলাদা তদন্ত কমিটি করে।
দুটি তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় বুধবার হাই কোর্টে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ পাঁচ ছাত্রীকে সাময়িক বহিষ্কার, দায়িত্বহীনতার অভিযোগে হল প্রভোস্টকে অব্যহতি এবং দায়িত্বে অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ কয়েকটি নির্দেশ দিয়েছেন।
যে পাঁচ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করার কথা বলা হয়েছে, তারা হলেন- ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী এবং দেশরত্ন শেখ হাসিনা হল শাখার সহসভাপতি তাবাসসুম ইসলাম, একই শিক্ষাবর্ষের একই বিভাগে শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ কর্মী মোয়াবিয়া জাহান, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ কর্মী হালিমা আক্তার ঊর্মি, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগ কর্মী ইসরাত জাহান মীম।
ইবিতে ছাত্রী নির্যাতন: পাঁচ নেতাকর্মীকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার
হাই কোর্টের এই নির্দেশের কিছু পরেই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকেও পাঁচজনকে বহিষ্কার করে বিবৃতি দেওয়া হয়।
এরপর পাবনার স্থানীয় সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে তার গ্রামের বাড়িতে যান। দরিদ্র এই পরিবারটির অভিভাবক একজন ভ্যানচালক। তার মেধাবী দুই ছেলে, দুই মেয়ের সবাইকে তিনি কষ্ট করে পড়াশোনা করাচ্ছেন। তিন ছেলেমেয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সবার ছোটজন স্কুলে পড়ছে।
বড় ছেলে এ বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। বড় মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। তৃতীয়জন এবার ভর্তি হয়েছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগে। সবার ছোটজন পাশের গ্রামের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র।
ব্কিালে বাড়িতে ওই শিক্ষার্থী, তার বাবা ও বড় ভাই যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তখন তাদের পাশে উঠানের শীল কড়ই গাছের নীচে পরিবারের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন নীল ভ্যানটি ছিল। বাড়ির চারদিকে পাটকাঠির বেড়া দেওয়া।
নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রী বলেন, “আমার ওপর নির্যাতনের ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ায় আমি হাই কোর্টের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তারা স্থায়ী বহিষ্কার না হওয়ায় আমি হতাশ। কারণ অভিযুক্তরা আমার ওপর অমানবিক নির্যাতন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার ও পড়ার কোনো যোগ্যতা নেই ওদের। আমি তাদের সবাইকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের দাবি জানাচ্ছি।”
তিনি বলেন, “ন্যায়বিচার ও অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে আমি কুষ্টিয়া আদালতে মামলা করব। মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
“অন্যায়ভাবে যারা আমাকে পাশবিক ও মানসিক নির্যাতন করেছে দ্রুত তাদের বিচার চাই, শাস্তি চাই।”
এ সময় তার বড় ভাই বলেন, “চিহ্নিতরা যে ধরনের অপরাধ করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। তারা স্থায়ী বহিষ্কার ও শাস্তির আওতায় না এলে এমন ঘটনার আবারও পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
“আমরা চাই, এ ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, যাতে সব বিশ্ববিদ্যালয়েই এমন নিষ্ঠুর র্যাগিং সংস্কৃতির মূলোৎপাটন হয়।”
ওই ছাত্রীর প্রতিবাদ ও সাহসিকতা সারা দেশে প্রশংসিত হওয়ায় তাকে নিয়ে গর্বিত এলাকাবাসীও। তারাও এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।
ছাত্রীর প্রতিবেশী এক যুবক বলেন, “নিরবে অন্যায় সহ্য না করে প্রতিবাদ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। তার বাবা কঠোর পরিশ্রম করে সন্তানদের শিক্ষিত করার চেষ্টা করছেন। বাবাও তাকে প্রতিবাদ করতে সাহস যুগিয়েছেন। নির্যাতনে জড়িতদের সঠিক বিচার হলে, সবাই নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে অনুপ্রেরণা পাবে।“
এ ব্যাপারে হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার নেটওয়ার্ক পাবনার সভাপতি আব্দুল মতীন খান বলেন, “ওই ছাত্রী দেখিয়ে দিয়েছে, অভিযোগ দিলে বিচার পাওয়া যায়। গ্রাম থেকে উঠে আসা একটা মেয়ে অন্য সবার মতো বিপদ আপদ- এতো চিন্তা-ভাবনা না করে যে প্রতিবাদী হয়েছে, সে একটা উদাহরণ স্থাপন করেছে। সবসময় এটাই হওয়া উচিত, কিন্তু আসলে হয় না, সেই কারণেই ওই ছাত্রী একটা দৃষ্টান্ত।”
আরও পড়ুন:
ছাত্রী নির্যাতন: হাই কোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়নে কাজ শুরু ইবি কর্তৃপক্ষের
ইবির হলে নির্যাতিত ছাত্রী ‘মামলা করবেন’ আদালতে
ছাত্রী হলে নির্যাতন: ইবির তদন্ত প্রতিবেদন হাই কোর্টে
ইবিতে ছাত্রী নির্যাতন: ছাত্রলীগের ৫ জনের হলের সিট বাতিল
ফোনে ইবির নির্যাতিত ছাত্রীকে ‘ন্যায়বিচারের’ আশ্বাস ছাত্রলীগ সভাপতির
যা যা ঘটেছে ছাত্রলীগকে সব বলেছি: ইবির নির্যাতিত ছাত্রী
ইবিতে ছাত্রী নির্যাতন: বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদন জমা
‘তারা আমার হাত-পা ধরে ক্ষমা চেয়েছে,’ বললেন ইবি ছাত্রী
ইবিতে ছাত্রী নির্যাতন: হাই কোর্টের আদেশে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি
ইবি হলে ছাত্রী নির্যাতন: তদন্ত কমিটির মুখোমুখি ছাত্রলীগের দুই নেত্রী
তদন্ত কমিটিকে ‘নির্যাতনের’ বর্ণনা দিয়েছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষার্থী
ইবি হলে ছাত্রী নির্যাতন: ভুক্তভোগীর বক্তব্য শুনবে হল কর্তৃপক্ষ
ইবির হলে ছাত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগ ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে