বরিশালে ভোটের মাঠে সাবেক মেয়রের ছেলে; দেখাবেন ‘বড় চমক’

বরিশাল বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা বলছেন, রূপন বিএনপির কেউ নন।

সাইদ মেমনবরিশাল প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 April 2023, 07:48 PM
Updated : 24 April 2023, 07:48 PM

বিএনপির স্থানীয় সরকার নির্বাচনে না আসার ঘোষণার মধ্যে বরিশাল সিটি করপোরেশনে ভোট করার ঘোষণা দিয়ে আলোচনার সৃষ্টি করেছেন সাবেক মেয়র আহসান হাবীব কামালের ছেলে কামরুল আহসান রূপন; যদিও দলটির নেতারা বলছেন, তিনি দলের কেউ নন। 

রূপনের বাবা বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কামাল ২০১৩-১৮ মেয়াদে বিএনপির হয়ে মেয়র পদে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। বাবার অনুসারীদের ‘সহানুভূতি’ ছাড়াও দলের নেতা-কর্মীদের একটি অংশের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন বলে দাবি করছেন সাবেক ছাত্রদল নেতা রূপন। 

২০০২ সাল থেকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়া এই মহানগরীতে শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে বিএনপির। তবে ২০০৮ সালে থেকে পাঁচ বছর মেয়র ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শওকত হোসেন হিরণ আর গত সাড়ে চার বছর ধরে এই দায়িত্ব পালন করছেন ক্ষমতাসীন দলের সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ।

সিটি করপোরেশনের শুরুতে প্রথম মনোনীত মেয়র হিসেবে আট মাস দায়িত্বে পালন করেন কামাল। পরে ২০১৩ সালে দলের মনোনয়নে আবার মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। তার আগে পৌরসভার চেয়ারম্যান ও একাধিকবার কাউন্সিলর ছিলেন।

ফলে মহানগরীর রাজনীতিতে কামালের একটা প্রভাব রয়ে গেছে। বাবার হাত ধরে রাজনীতিতে আসা রূপন সেটাকেই ভিত্তি ধরে এগোচ্ছেন ভোটের মাঠে। আগামী ১২ জুন অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হতে চাইছেন তিনি।

ছাত্রজীবনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য; পরে কেন্দ্রীয় কমিটিতেও ছিলেন রূপন। এখন বিএনপির কোনো পদ-পদবী নেই তার।

সম্প্রতি নগরীর আলেকান্দার হজরত কালু শাহ সড়কের বাসভবনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা হয় রূপনের। তিনি বলেন, বাবা আহসান হাবীব কামালের সঙ্গে যারা রাজনীতি করেছেন, তাদের সহানুভূতি তিনি পাচ্ছেন। অনেকেই সঙ্গেই দেখা করেছেন, কুশল বিনিময় করেছেন। 

“যারা মান-অভিমান নিয়ে এতদিন দূরে সরে ছিলেন, তারাও এখন আসছেন। সবার কাছ থেকে অকল্পনীয় সাড়া পাচ্ছি। খোলামেলা আলোচনা হচ্ছে। সামনে আরও অনেক বড় চমক আছে।”

রূপন দাবি করেছেন, তিনি জীবনের পাঁচ ভাগের একভাগ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে থেকে কাটিয়েছেন। তবে আগামী নির্বাচন নিয়ে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে এখনও কোনো ইঙ্গিত বা নির্দেশ তিনি পাননি। নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছায়ই প্রার্থী হয়েছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “দল নির্বাচনে যাবে কি না, সেই বিষয়টি দলীয় হাই কমান্ডের উপর নির্ভর করছে। তারা যদি ভেবেচিন্তে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সিদ্ধান্তে আমার পূর্ণ সমর্থন থাকবে।”

সেক্ষেত্রে তিনিও দলের মনোনয়ন চাইবেন। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষেই কাজ করবেন।

বিএনপি তো নির্বাচনে যাচ্ছে না, তারপরও কেন আপনি নির্বাচনে যাচ্ছেন- প্রশ্নে রূপন বলেন, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মানদণ্ড জনগণের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য সেই বিষয়টি প্রমাণের জন্যই তিনি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।

“দেখেন, আমি নির্বাচন করব ঘোষণা দেওয়ার পর পরই দুদক থেকে আমাকে, আমার মা ও বোনকে নোটিস দেওয়া হয়েছে। সামনে হয়ত হামলা-মামলা-নির্যাতনের শিকার হতে হবে। গুম হওয়ারও আশঙ্কাও করছি।”

বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সবাই যে নির্বাচনে যেতে ইচ্ছুক এমনটাও নয় বলে জানান রূপন। তবে সেই সঙ্গে বলেন, “আবার অনেকে যেতে চায়।”

বিএনপি কি কৌশলে আপনাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী করতে পারে- জানতে চাইলে রূপন বলেন, “বিএনপি নির্বাচনে গেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী কেন থাকবে? তাহলে দল তো প্রার্থী মনোনয়ন করবে। সেখানে যে কাউকে মনোনয়ন দেবে।” 

রূপনের বাবা কামাল ২০১৩ সালে ভোটে জিতে মেয়র হলেও ২০১৮ সালে তাকে বাদ দিয়ে বিএনপি প্রার্থী করে সাবেক সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান সরোয়ারকে। তিনি সাদিক আব্দুল্লাহর কাছে হেরে যান।

বরিশালে বিএনপি যাকেই প্রার্থী করুক সবাই ঐক্যবদ্ধ হবে, এমনটা নাও হতে পারে বলে মনে করেন রূপন।

তিনি বলেন, “আমার পক্ষে বিএনপির নেতাকর্মীরা অবশ্যই কাজ করবেন। অনেকে এখনও সঙ্গে রয়েছেন। সামনে আরও অনেকে কাজ করবেন।

“দলের সবাই যে কাজ করবেন সেই নিশ্চয়তা নেই। বিএনপি যদি কোনো প্রার্থী মনোনয়ন দিত, তাহলেও একত্রিত থাকত না। কারণ, অনেকেই মনোনয়ন চাইতেন। বঞ্চিতরা বিরোধিতা করত।”

রূপনের দাবি, বর্তমানে বিএনপির প্রভাবশালী ও পদধারী এক নেতার সঙ্গে সরকারদলীয় প্রার্থীর ‘সুসম্পর্ক’ রয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে এলেও ওই নেতা সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতেন এবং এখনও করবেন।

তবে নাম-ধাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, “সময় এলে সাংবাদিকদের মাধ্যমে সবকিছু তুলে ধরা হবে।”

নির্বাচনে গেলে দলের আন্দোলনের ক্ষতি হবে কি না- জানতে চাইলে রূপন বলেন, “বিএনপির আগে ছিল ২৭ দফা আন্দোলন। এখন ১০ দফা আন্দোলন। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া দল নির্বাচনের যাবে না। যদি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, তাহলে অংশ নেওয়া উচিৎ হবে। এরপর অন্যান্য দাবি আদায় করা যাবে।”

শুধু বরিশাল সিটি নয়, পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই ব্যালটে ভোট চেয়েছেন রূপন। ইভিএমে কারচুপি হয় বলে অভিযোগ তার।

তিনি বলেন, “আগামী সংসদ নির্বাচন ব্যালটের মাধ্যমে হবে। সেখানে সিটি নির্বাচন ইভিএমে কেন করতে হবে? ব্যালটের মাধ্যমে নিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের একটা প্রস্তুতি নেওয়া যেত। বর্তমান নির্বাচন কমিশন ব্যালটে নির্বাচন কেমনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করবেন, সেই ধারণাও পেত। ব্যালটের মাধ্যমে সরকার একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন করে তাদের জনপ্রিয়তাও যাচাই করতে পারতো। সিটি নির্বাচনকে একটি মডেল নির্বাচন করা যেত।

“ক্যামেরার নিচে ইভিএমে ভোট নেওয়া হলেও সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ইভিএমে একটা হার নির্ধারণ করা থাকে। যেখানেই যে প্রতীকেও ভোট দেওয়া হোক না কেন, হার অনুযায়ী নৌকা প্রতীকে যাবে।”

আওয়ামী লীগ এখন কেন সোচ্চার?

শওকত হোসেন হিরণের মৃত্যুর পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী করেছিল সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে। বঙ্গবন্ধু বোনের ছেলে গৌরনদীর সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ছেলে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন সাদিক।

বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে জেলাজুড়ে হাসানাত আব্দুল্লাহর যে দাপট, তার ধারা সাদিকের মাধ্যমে আসে নগরীতেও। আর এই সময়ে নানা কর্মকাণ্ডে সাদিককে নিয়ে বিতর্কও বাড়তে থাকে।

এই প্রেক্ষাপটে আগামী ১২ জুন অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ বদলে ফেলে মেয়র প্রার্থী। সাদিককে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয় আবুল খায়ের আব্দুল্লাহকে (খোকন সেরনিয়াবাত)। ভাই হলেও হাসানাতের সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই খোকন সেরনিয়াবাতের।

বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর সময়কে কীভাবে মূল্যায়ন করেন জানতে চাইলে সাবেক ছাত্রদল নেতা রূপন বলেন, “সেটা তো শুধু সাধারণ জনগণই নয়, দলীয় এমনকি ঢাকা থেকে আসা নেতারাই তো বলেছেন যে তিনি তার সময়ে কী করেছেন। দলীয় নেতাকর্মীরাও তার কাছ থেকে ছাড় পায়নি।

তিনিও এর শিকার হয়েছেন জানিয়ে বলেন, “আমাদের মাছের ঘেরও দখল করে নেওয়া হয়েছে।”

রূপনের প্রশ্ন, “দলীয় ও কেন্দ্রীয় নেতারা সাদিক আবদুল্লাহর অত্যাচার-নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে এখন সরব হচ্ছেন কেন? এটা তো আগে থেকেই করা হয়েছে। তখন থেকে তারা কেন সোচ্ছার হননি?”

রূপন বিএনপির ‘কেউ না’

২০০২ সালের ২৫ জুলাই থেকে ২০০৩ সালের ১৪ জুলাই পর্যন্ত বরিশাল মহানগরীর মেয়র থাকা কামাল প্রথম নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পাননি। সেবার দলের মনোনয়নে মেয়র হন মজিবুর রহমান সরোয়ার। ওয়ান-ইলেভেনের সময় তাকে মেয়র পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।  

২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া শরফউদ্দিন ঝন্টু আওয়ামী লীগের মহানগর কমিটির সভাপতি শওকত হোসেন হিরণের কাছে হেরে যান। তবে ২০১৩ সালে ভোটে জিতে মেয়রের পদে বসেন কামাল। 

সেসময় বরিশাল মহানগরীতে বিএনপির রাজনীতিতে আহসান হাবীব কামাল এবং মজিবুর রহমান সরোয়ারের দ্বন্দ্ব ছিল আলোচিত। ২০২২ সালের ৩১ জুলাই কামাল মারা গেলেও দুই বলয়ের বিরোধ এখনও তৃণমূলে দেখা যায়।

বিএনপিকর্মীদের ভাষ্য, কামালের অনুসারীদের একটা অংশ এখন বিএনপির মহানগর কমিটির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবীর জাহিদের বলয়ে চলে গেছেন। আরেকটা অংশকে একত্রে রাখার চেষ্টা করছেন রূপন। 

রূপনের নির্বাচন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক মেয়র সরোয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সে তো বিএনপির কেউ না, বিএনপির সদস্য নয়। বিএনপিতে যোগ দেয়নি। স্বাধীনভাবে যে কেউ নির্বাচন করতে পারে। বিএনপির কোনো নেতাকর্মী তার পক্ষে কাজ করবে বলে আমি মনে করি না। বিএনপির ভোটার ভোট দিতেও পারে, আবার নাও দিতে পারে।

“বিএনপি যারা করে, তারা নির্বাচনে আসবে না। শুধু মেয়র পদে নয়, এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপির পদধারী কেউ অংশ নেবে না। অংশ নিলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

বিএনপির পদধারী অনেক নেতা কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করতে যাচ্ছেন- এমন গুঞ্জন সম্পর্কে সরোয়ার বলেন, “দল থেকে কঠিনভাবে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ যদি দলের পদে থেকে নির্বাচন করে, তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

বরিশাল মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রূপনের তো দলীয় পদ-পদবি নেই। সে নির্বাচন করছে নিজের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে। দল নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্বান্ত নিয়েছে, তাই এ বিষয়ে তার সঙ্গে কখনও কোনো কথাও হয়নি।”

বিএনপি নির্বাচনে গেলে মনোনয়ন চাইবেন কি না- জানতে চাইলে জাহিদ বলেন, “সেটা সময় এলে সিদ্ধান্ত নেব।”

দলের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তাকেও কোনো ধরনের সহায়তা করবেন না জানিয়ে বিএনপি নেতা বলেন, “ভোট বর্জন তো বর্জনই। কারও পক্ষে ভোট চাইতে বা দিতেও যাব না।”

বিএনপিতে সম্পৃক্ততা নিয়ে রূপন বলেন, তিনি ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সদস্য ছিলেন। ২০১০ সালে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। সেই হিসেবে তিনি বিএনপির সদস্য।

২০০৩ সালে সরোয়ারের নির্বাচন করেছিলেন দাবি করে রূপন করেন, “এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ঢাকায় মিছিল করেছি। জীবনের পাঁচভাগের চার ভাগ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে পদ-পদবি নেই; তাই দায়বদ্ধতাও নেই।”