বরিশালে সাদিক আব্দুল্লাহ কেন এবার বাদ?

চাচা খোকন সেরনিয়াবাতের মনোনয়ন পাওয়া আর ভাতিজা সাদিকের বাদ পড়ার ঘটনাটি এখন বরিশাল নগরীজুড়ে আলোচনার বিষয়।

সাঈদ মেমনবরিশাল প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 April 2023, 03:44 PM
Updated : 18 April 2023, 03:44 PM

বরিশাল নগরীর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আক্তারুজ্জামান সুরুজ কৈশোর বয়স থেকে আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী। দলের প্রায় সব কর্মকাণ্ডে নিয়মিত তিনি, যদিও কোনো পদ-পদবি নেই। শনিবার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর নাম শুনে খুবই উৎফুল্ল দেখাল তাকে।

কারণ জানতে চাইলে সুরুজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের কোনো মুল্যায়ন করেননি তিনি (সাদিক আব্দুল্লাহ)। সবাইকে কোণঠাসা করে বিতর্কিত লোকদের নিয়ে নগরীতে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছেন। সুবিধাবাদীরা লুটেছে, ত্যাগীরা বঞ্চিত রয়েছে।”

এমন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল বরিশালে এমন আরও নানাজনের কাছ থেকে। তারা সবাই সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে সাদিক আব্দুল্লাহর কর্মকাণ্ডে বিরক্ত।

বরিশালে এবার নৌকার মেয়র প্রার্থী মনোনয়নে সেই চাওয়ার প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় কর্মীরা।

শওকত হোসেন হিরণের মৃত্যুর পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী করেছিল সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে। বঙ্গবন্ধু বোনের ছেলে গৌরনদীর সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ছেলে সাদিক তখন নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নবিশই ছিলেন।

তবে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন সাদিক। বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে জেলাজুড়ে হাসানাত আব্দুল্লাহর যে দাপট, তার ধারা সাদিকের মাধ্যমে আসে নগরীতেও। আর এই সময়ে নানা কর্মকাণ্ডে সাদিককে নিয়ে বিতর্কও বাড়তে থাকে।

এই প্রেক্ষাপটে আগামী ১২ জুন অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ বদলে ফেলে মেয়র প্রার্থী। সাদিককে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয় আবুল খায়ের আব্দুল্লাহকে, যিনি খোকন সেরনিয়াবাত নামে পরিচিত।

সম্পর্কে খোকন সেরনিয়াবাত বিদায়ী মেয়র সাদিকের চাচা, হাসানাত আব্দুল্লাহর ছোট ভাই। তবে হাসানাত পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই খোকন সেরনিয়াবাতের। তিনি বরিশালেও থাকেন না, থাকেন খুলনায়।

তারপরও গত শনিবার আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড খোকন সেরনিয়াবাতকে মনোনয়নের ঘোষণা দিলে বরিশাল নগরীতে বের হয় আনন্দ মিছিল, চলে মিষ্টি বিতরণ। যদিও বরিশালের রাজনীতিতে সাদিক আব্দুল্লাহর বিরোধী হিসেবে পরিচিত যারা কোণঠাসা হয়ে ছিলেন, তাদেরই এসব কর্মসূচিতে সামনে দেখা গেছে।

বরিশালের রাজনীতিতে অনেকটাই অপরিচিত খোকন সেরনিয়াবাতের মনোনয়ন পাওয়া আর সাদিকের বাদ পড়ার ঘটনাটি এখন নগরীজুড়ে সাধারণ মানুষের আলোচনারও বিষয়বস্তু।

এসব আলোচনায় আওয়ামী লীগের এই মনোনয়নের বিচার-বিশ্লেষণ যেমন চলছে; তেমনি উঠে আসছে গত পাঁচ বছরে বর্তমান মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর নানা কর্মকাণ্ডও।

গত দুদিনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, সংবাদমাধ্যমের কর্মী, সরকারি চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অন্তত ৩০ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

তারা বলছেন, মেয়র নানা কারণেই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন, দলের ভেতরের বিরোধীদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন, মহানগরজুড়ে মেয়রের নাম ব্যবহার করে একটা শ্রেণি নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। তারা লঞ্চ ও স্পিডবোট ঘাট এবং বাস টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। তার কারণে অজনপ্রিয় হয়ে পড়েন সাদিক আব্দুল্লাহ।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের সঙ্গে সাদিক আব্দুল্লাহর দ্বন্দ্বের বিষয়টিও আবার উঠছে আলোচনায়; যা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরূপ করে তুলেছিল মেয়রের প্রতি।

সাদিক তার বিরুদ্ধে যেন কেউ মুখ খুলতে সাহস না পায়, সেজন্য ভীতিকর একটি অবস্থা তৈরি করে রেখেছিলেন বলেও বিরোধীদের অভিযোগ।

এসব অভিযোগের বিষয়ে চেষ্টা করেও মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি ঢাকায় থেকে তার অনুসারীদের কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারাও এ নিয়ে বেশি কথা বলতে রাজি হননি।

সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারী হিসেবে পরিচিত বরিশাল মহানগর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক পরিমল চন্দ্র দাসের দাবি, সাদিক আব্দুল্লাহ একজন ‘ভালো লোক’।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আওয়ামী লীগের একটি বিশাল পরিবার। সেখানে ভুল-বোঝাবুঝি থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তার ভুল হিসেবে তেমন কিছুই আমি দেখি না।

 “প্রশাসনের সঙ্গে খারাপ সম্পর্কের বিষয়টি সকলে উল্লেখ করেছেন। প্রশাসনের সঙ্গে তো তার কোনো ঝামেলা নেই। তিনি বিষয়টি সমাধান করতে গিয়ে নিজেই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।”

শ্রমিক লীগের এই নেতা আরও বলেন, “সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ আগেই বলেছেন, তিনি নৌকার মনোনয়ন না পেলেও যে পাবেন তার পক্ষে কাজ করবেন। প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত প্রার্থীকে জয়ী করতে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন।”

সাদিক আব্দুল্লাহ মঙ্গলবার ঢাকা থেকে দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে ভার্চুয়াল সভা করে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে বলেছেন।

তিনি বলেন, “নৌকা মার্কাকে আমাদের জয়লাভ করাইতে হবে। এখানে আমার চাচা নমিনেশন পাইছে, এখানে অন্য কোনো বিষয় নাই। আমার চাচা করবে নির্বাচন, আমরা তার নির্বাচন উঠাই দিব। যেখানে যা করার লাগে আমরা করব।”

“আমরা সংগঠন করতে আসছি এখানে। অনেক দূর যাওয়া লাগবে,” দলের নেতা-কর্মীদের বলেন তিনি।

সাদিকের বাবা হাসানাত আব্দুল্লাহ আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডেরও সদস্য। তাই অনেকের ধারণা ছিল, এবারও তার ছেলে সাদিকই মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন। কিন্তু তা না হওয়ায় হতাশ তার সমর্থকরা।

যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য খোকন সেরনিয়াবাত মাস তিনেক আগে বরিশালের রাজনীতিতে জড়াতে শুরু করেন। বরিশাল নগরীর কালীবাড়ি রোডে তার বাবা প্রয়াত আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ি। তবে খুলনা থেকে এসে সেই বাড়িতে ওঠেননি তিনি। বাংলা বাজার এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে থাকছেন তিনি।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের রাতে ঢাকার মিন্টো রোডে আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতেও হামলা হয়েছিল। সেই হামলায় রব সেরনিয়াবাতসহ পরিবারের ছয় সদস্য নিহত হন। সেই রাতে গুলিবিদ্ধ হলেও বেঁচে যান খোকন সেরনিয়াবাত।

পারিবারিক দূরত্বের বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কোনো কথা বলতে চান না খোকন সেরনিয়াবাত। আর তাকে ঘিরে আওয়ামী লীগের যে নেতা-কর্মীদের উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে, তারা আবার বরিশাল নগরীর সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের অনুসারী। প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মেয়রের দ্বন্দ্বও বরিশালে আলোচিত বিষয়।

‘যা হওয়া উচিৎ ছিল, তাই হয়েছে’

সাদিক আব্দুল্লাহকে নিয়ে আওয়ামী লীগকর্মী সুরুজের মতো বিরক্ত নগরীর নতুন বাজার এলাকার বাসিন্দা চন্দন জ্যোতি শীলও।

তারও অভিযোগ, গত সাড়ে চার বছরে বরিশালে অনেক যোগ্য নেতা তাদের ‘মর্যাদা’ পাননি। কিন্তু তারা এটা বলতেও পারেননি। 

চন্দন বলেন, “লোক দেখানো উন্নয়ন দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করা যায় না। সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করার মতো কোনো কাজই মেয়র করেননি। সাধারণ মানুষ যে আন্তরিকতা, যে সেবা চেয়েছে, তা দিতে পারেননি সাদিক আবদুল্লাহ।”

২০২১ সালের অগাস্টে বরিশাল উপজেলা পরিষদ চত্বরে সংসদ সদস্য জাহিদ ফারুক শামীমের পোস্টার রাতের বেলায় ছেড়াকে কেন্দ্র করে তৎকালীন ইউএনও মুনিবুর রহমানের সঙ্গে মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর দ্বন্দ্ব হয়। ওই সময় ছাত্র ও যুবলীগের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে।

Also Read: ভোটে চাচার বিপক্ষে ‘যাবেন না’ সাদিক আব্দুল্লাহ

Also Read: ‘অপরিচিত’ খায়ের আব্দুল্লাহর মনোনয়নে আওয়ামী লীগের আনন্দ মিছিল

Also Read: বরিশাল সিটি নির্বাচন: আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দৌড়ে চাচা-ভাতিজা

Also Read: বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের বাড়িতে ‘সমঝোতা’ বৈঠকে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ

Also Read: মেয়র সেরনিয়াবাতকে গ্রেপ্তারের দাবি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের

এ নিয়ে মামলা-পাল্টা মামলা হয়। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন মেয়রের গ্রেপ্তারের দাবিও জানিয়েছিল। বিষয়টি সারাদেশে আলোচনার জন্ম দেয়। পরে ঢাকা থেকে হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।

এরপর গত বছরের অক্টোবরে জেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রে ইউএনও মনিরুজ্জামানের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন মেয়র। বাদানুবাদের একপর্যায়ে ইউএনওকে ‘স্টুপিড’ বলেন সাদিক। সেই ভিডিও ভাইরাল হলে সমালোচনায় পড়েন সাদিক।

চন্দন জ্যোতি শীল এসব প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, “এরকম আরও ঘটনায় প্রশাসনের একটি অংশের সঙ্গে বিরূপ সম্পর্ক ও বড় দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। যার কারণে তার জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছিল। সেই জরিপ প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের কাছে ছিল। তাই তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি বলেই আমার ধারণা।”

বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা খান আলতাফ হোসেন ভুলু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিনি (মেয়র) যে প্রক্রিয়ায় দল চালিয়েছেন, তাতে যা হওয়া উচিৎ ছিল, এখানে তাই হয়েছে। আমি তো মনে করি, মানুষ অনেক কম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। আমার ধারণা ছিলো, মানুষ আরও বেশি প্রতিক্রিয়া জানাবে।

“প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরিশালবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পেরেছেন। তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন খোকন সেরনিয়াবাতকে মনোনয়ন দিয়ে। খোকন ভালো মানুষ। তিনি বরিশাল নগরীর উন্নয়ন করতে পারবেন বলেই আমার বিশ্বাস। তিনি প্রধানমন্ত্রীর আস্থা ধরে রাখতে পারবেন।”

জেলা পরিষদের সাবেক এই চেয়ারম্যান কয়েকজনের নাম ধরে বলেন, দলের বাইরে থেকে আসা এসব লোক মেয়রের প্রশ্রয়ে ‘লুটপাট’ চালিয়েছে, খানে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে।

“আমাদের মতো সিনিয়রদের করার কিছু ছিল না। এখন খোকনকে দায়িত্ব দিয়েছেন, খোকন হয়ত সবাইকে নিয়ে কিছু করতে পারবেন।”

‘ভবন মালিকরা তাকে বাঘের চেয়েও ভয় পেতেন’

বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউর রহমান বিপ্লব মেয়রবিরোধী লোক হিসেবে পরিচিত। তিনি প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের অনুসারী। তার দাবি, গত চার বছর সিটি করপোরেশন কার্যত অচল ছিল।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মেয়র নিজে তো কোনো উন্নয়ন করতে পারেননি, স্থানীয় এমপি নগরীতে কোনো বরাদ্দ আনলে সেই কাজও করতে দেননি। সামান্য বৃষ্টিতে নগরীতে হাঁটু সমান পানি উঠে যায়। পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী ১১ কোটি টাকার একটি বরাদ্দ আনেন নগরীর সাতটি খাল পুনঃখননের জন্য। কিন্তু সিটি করপোরেশন থেকে অনুমতি না দেওয়ায় সেই টাকা এখন ফেরত যাচ্ছে।

“নগরীর সদর উপজেলা সম্প্রসারিত প্রশাসনিক ভবন ও হল রুমের ১০ কোটি ৩ লাখ টাকা ব্যয়ের কাজ শুরুর পর সিটি করপোরেশন বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের দাবি, নগরীতে কোনো কাজ করতে হলে তাদের অনুমতি নিতে হবে।”

জিয়াউর রহমান বিপ্লব বলেন, “নগরীতে যাদের বহুতল ভবন রয়েছে, তারা তাকে বাঘের চেয়েও বেশি ভয় পেতেন। কারণ তার কাজ ছিল, ভবনের দোষ-ত্রুটি বের করা এবং তারপর সেই ভবন মালিকদের বড় অংকের টাকা জরিমানা করা। টাকা না দিলে ভবন গুঁড়িয়ে দিতে বুলডোজার পাঠানো হত। এর ভুরিভুরি প্রমাণ আছে।”

২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এনামুল হক বাহারের দাবি, “নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের সাধারণসহ সংরক্ষিত ৪০ কাউন্সিলর একদিনের জন্য সিটি করপোরেশনে বসতে পারেননি। এমনকি এলাকাবাসীর দুর্ভোগের কথাও মেয়রের কাছে জানাতে পারেননি। এছাড়া সিটি করপোরেশনে যে কমিটি হয় একটি কমিটিও সুষ্ঠুভাবে হয়নি। যা কিছু করেছেন মেয়র ইচ্ছামত করেছেন।”

একাধিক কাউন্সিলর মেয়রের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন বাহার। তিনি বলেন, “সিটি করপোরেশন এবং দলীয় কার্যালয় হচ্ছে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসভবন। সেখানে বসেই তিনি সকল কাজ করতেন। তাকে এ বিষয়ে বারবার অবহিত করা হলেও তিনি বলতেন, আমি যেখানে বসব সেটাই অফিস।“

১৯৯৫ সাল থেকে নগরীর ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক এ কে এম মতুর্জা আবেদীন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বর্তমান সিটি মেয়রের কাছে প্রথম দিকে একটি রাস্তার উন্নয়নে ডিমান্ড লেটার দেওয়া হয়। মেয়র রাস্তার দরপত্র আহ্বান করেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত রাস্তার কাজের ওয়ার্ক অর্ডার হয়নি। আগে মশা নিধনের ওষুধসহ নাগরিক সেবার প্রয়োজনীয় উপকরণ নগর ভবন থেকে কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু এখন আর কোনো কিছুই পাই না।

“ওয়ার্ডের দৈনিক মজুভিত্তিক শ্রমিকদের বেতন শিটে আমার স্বাক্ষর প্রয়োজন। কিন্তু গত দেড় বছর ধরে কোনো স্বাক্ষর নেওয়া হয় না। এমনকি সড়ক বাতির জন্য কল করা হলে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে জানিয়ে দিয়েছে, যাওয়া যাবে না।”

২২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আনিসুর রহমান দুলাল বলেন, “বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের নগরীর ব্যস্ততম চৌমাথা এলাকায় বড় একটি অংশ নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে শিশু পার্ক। ওই পার্কটি করতে ওই সময় বিভিন্ন মহল থেকে বাধা দেওয়া হলেও তা শোনেননি মেয়র। পার্কটি স্থাপনে ১৩ কোটি টাকা ব্যয় দেখিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পার্কটি রাখা যাবে না। কারণ, বরিশাল-ঢাকা মহাসড়ক ফোর লেন হলে পার্কটি ভেঙে ফেলতে হবে।”

বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম স্বপন জানিয়েছেন, কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই সিটি করপোরেশন থেকে নিয়মিত ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ৩০ জনকে ওএসডি করে রাখা হয়। কাজ করলেও বেতন দেওয়া হয় না ৭-৮ জনকে। ২৫ জনকে বেতন দেওয়া হলেও তাদের কর্মস্থলে আসতে নিষেধ করা হয়।

“এসব ব্যাপারে লিখিতভাবে আবেদন করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি আমরা। একজন কর্মকর্তাকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করতে হলে তাকে একাধিবার শোকজ করতে হবে। তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। এরপর সভা বসে তাকে চাকরিচ্যুত করতে হবে। মেয়র ইচ্ছামাফিক যখন-তখন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকরিচ্যুতির কাগজ ধরিয়ে দিতেন।”

বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও মেয়র পদের মনোনয়নপ্রত্যাশী মীর আমিন উদ্দিন মোহন মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে শতবর্ষী মোহামেডান ক্লাব ভবন ভেঙে ফেলার অভিযোগ এনেছেন।

তিনি বলেন, “দলের নেতাকর্মীরাও কথা বলতে পারেন না। মনে হয় আমরা প্রজা। কারও কথা শুনবেন না। তারা যা বলবেন, সেটাই মানতে হবে। না মানলে সমস্যায় পড়তে হয় নেতাকর্মীদের।”

দোষ সাদিকের কাছের লোকদের?

জনসম্পৃক্ততার অভাবই সাদেক আব্দুল্লাহর মনোনয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিটি মেয়রের সঙ্গে যারা ছিলেন, তারা তাকে জনসম্পৃক্ততার বিষয়ে বোঝায়নি। এ কারণে তার সঙ্গে নগরবাসীর জনসম্পৃক্ততা ছিল না। তাছাড়া দলীয় নেতা-কর্মীদের একটি অংশ তার সঙ্গে থাকলেও বড় অংশটি ছিল বাইরে।”

মনোনয়ন না পাওয়ার পেছনে এটাই বড় কারণ হিসেবে দেখছেন শাহ সাজেদা।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বরিশাল জেলার সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বলেছেন, “এ পরিবর্তনে প্রধানমন্ত্রী প্রশংসার দাবি রাখেন। প্রধানমন্ত্রী তার সুযোগ্যতা প্রমাণ রেখেছেন।

“তাছাড়া শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশালবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। ঠিক তেমনটি তার ছোট ছেলে খোকন সেরনিয়াবাতও ক্লিন ইমেজের লোক হওয়ায় বরিশালবাসী ইতিবাচক দৃষ্টিতে নেওয়ায় এর প্রতিফলন ঘটবে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। আর প্রধানমন্ত্রী তাকে মনোনয়ন দেওয়ায় তিনি সেই বিশ্বাসটা ধরে রাখবেন। সেই বিশ্বাস থেকে তিনি সুন্দর একটা নগরী উপহার দেবেন।”

বরিশালের জ্যেষ্ঠ সংবাদকর্মী জসিম জিয়া বলেন, “মিডিয়াকর্মীরা অনেক সময় নানা বিষয়ে মেয়রের বক্তব্য জানান চেষ্টা করতেন, তাকে ফোন করতেন, কিন্তু তিনি ফোন কল রিসিভ করতেন না। সিটি করপোরেশনে তাকে পাওয়া যেত খুব কম। দিনের বেলায় তাকে প্রায় পাওয়াই যেত না। সন্ধ্যার পর গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও তার বক্তব্য পেতেন না সাংবাদিকরা। ফলে সাংবাদিকদের সঙ্গেও তার একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল বলে মনে হয়।”

সাদিক আবদুল্লাহর সঙ্গে সিটির মেয়র পদে নির্বাচন করা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাওলানা ওবায়দুর রহমান মাহবুব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাড়ে তিন বছর তিনি কোনো কাজ করেননি। গত এক বছর একটু কাজ করেছেন। সেটাও নিজের ইচ্ছেমতো করেছেন। জনগণের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।”