প্রথমবার ভোটে দাঁড়িয়েই মেয়র হতে চলেছেন খোকন সেরনিয়াবাত।
Published : 12 Jun 2023, 11:40 PM
নদী পথে যাওয়ার সময় বরিশালের খানিক আগেই চরমোনাই পীরের দরবার; সেই পীরের ছেলে মুফতী ফয়জুল করীম যখন এবার মেয়র প্রার্থী হন, তখন বিএনপিবিহীন নির্বাচনও জমে ওঠার সম্ভাবনা জেগে উঠেছিল। ভোটের দিন তার উপর হামলা উত্তাপও ছড়িয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নৌকা নির্বিঘ্নেই বন্দরে ভেড়ালেন রাজনীতিতে নবীন খোকন সেরনিয়াবাত।
সোমবার অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৫৩ হাজার ভোটে জয়ী হয়েছেন আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ (খোকন সেরনিয়াবাত), যার প্রার্থী হওয়াটাই ছিল বরিশালবাসীর জন্য চমক। আর প্রথমবার ভোটে দাঁড়িয়েই জিতলেন তিনি।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর চাচা হলেও ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে খোকনের দূত্বই বেশি আলোচিত; যদিও ভোটে জেতার পর ভাই আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর অভিনন্দন বার্তা পেয়েছেন খোকন।
এবারের পাঁচ সিটি নির্বাচনে বিএনপিসহ নিবন্ধিত অধিকাংশ রাজনৈতিক দল না থাকায় ভোট নিয়ে মানুষের স্বাভািবক সময়ের মতো আগ্রহ তেমন দেখা যাচ্ছে না।
তার মধ্যে গত মাসে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জিতে চমক সৃষ্টির পর বরিশালেও ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখা নিয়ে অনেকে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন।
বিভিন্ন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের যে ভোটের হার, তার সঙ্গে পীরের নিজের জেলায় ভোট বলে এই কৌতূহলের মাত্রাটা ছিল বেশি। অনেকে মনে করছিলেন, হাতপাখার বড় ঝাপটায় দুলে উঠতে পারে নৌকা। কেননা, সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারীরা নামেননি খোকনের পক্ষে, আবার তারা গোপনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছিলেন বলেও গুঞ্জন ছড়িয়েছিল।
হাতপাখার প্রার্থীকে কে টাকা দিয়েছে বা দেয়নি সেটা আলোচ্য নয়: নানক
সেসব পেরিয়ে সোমবার ভোটের দিন হাতপাখার মেয়র প্রার্থী ফয়জুল করীম যখন হামলার শিকার হন, তখন তার সমর্থকদের লাঠিসোঁটা নিয়ে বিক্ষোভও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে হাতপাখার এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগও তুলেছিলেন তিনি।
তবে ভোটে আর কোনো গোলযোগ ছাড়াই ১২৬ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শেষের পর শিল্পকলা একাডেমিতে স্থাপিত ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র থেকে সমন্বিত ফল যখন রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবীর ঘোষণা করেন, তাতে নৌকার খোকন সেরনিয়াবাতের জয় ঘোষিত হয়।
বরিশালে ‘ঘুষিতে’ রক্তাক্ত হাতপাখার প্রার্থী
দুই সিটির ফল প্রত্যাখ্যান হাতপাখার, বাকি দুটিতেও প্রার্থী প্রত্যাহার
সম্পূর্ণ ইভিএমে অনুষ্ঠিত এই ভোটে ৬ ঘণ্টার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ফল আসে। তাতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত পেয়েছেন ৮৭ হাজার ৮০৮ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলনের ফয়জুল করীম হাতপাখা প্রতীকে ভোট পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৮২৮টি। অর্থাৎ দুজনের ভোটের ব্যবধান ৫৩ হাজারের বেশি।
বিএনপিসহ অধিকাংশ দলের বর্জনের পাশাপাশি বৃষ্টির বাগড়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ভোটের হার দাঁড়ায় ৫১ শতাংশ।
বরিশাল সিটি নির্বাচনে নৌকা জিতল ৫৩ হাজার ভোটে
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত গত নির্বাচনে বরিশালে ভোটের হার ছিল ৫৫ শতাংশের বেশ। ব্যাপক গোলযোগের মধ্যে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে ভোটের দিন ফল ঘোষণা করেননি রিটার্নিং কর্মকর্তা।
গোলযোগ ও অনিয়মের কারণে সেবার ১৬টি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত হয়েছিল। দুই দফা তদন্ত শেষে ১৬টি কেন্দ্রের মধ্যে ৯টি কেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণের নির্দেশ দেয় ইসি। চার মাস পর নৌকার প্রার্থী সাদিক আব্দুল্লাহকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়।
সাদিক পেয়েছিলেন ১ লাখ ১১ হাজার ৯৫৬ ভোট। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মজিবর রহমান সরোয়ার পান ১৩ হাজার ৭৭৬ ভোট।
২০০২ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের শওকত হোসেন হিরণ ২০০৮ সালে, বিএনপির আহসান হাবিব কামাল ২০১৩ সালে মেয়র নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সমর্থিত হিরণ পেয়েছিলেন ৪৬ হাজার ৭৯৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পিডিপির সরদার সরফুদ্দিন আহমেদ পান ৪৬ হাজার ২০৮ ভোট। সেবার ভোটের হার ছিল ৮১.৯৯%।
২০১৩ সালে হিরণকে ১৭ হাজার ভোটে হারতে হয়েছিল বিএনপির কামালের কাছে। সেবার ভোট পড়েছিল ৭২.১ শতাংশ।
বিদায়ী মেয়র হিসেবে এবার সাদিক আব্দুল্লাহ প্রার্থী হতে চাইলেও নানা অভিযোগের মুখে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব তাতে সায় দেয়নি। খুলনা থেকে এনে প্রার্থী করা হয় খোকনকে।
বরিশাল সিটি নির্বাচন: আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দৌড়ে চাচা-ভাতিজা
‘অপরিচিত’ খায়ের আব্দুল্লাহর মনোনয়নে আওয়ামী লীগের আনন্দ মিছিল
খোকনের বাবা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের রাতে ঢাকার মিন্টো রোডে রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতেও হামলা হয়েছিল। সেই হামলায় রব সেরনিয়াবাতসহ পরিবারের ছয় সদস্য নিহত হন। সেই রাতে গুলিবিদ্ধ হলেও বেঁচে যান খোকন সেরনিয়াবাত।
সেরনিয়াবাতের ছেলেদের মধ্যে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ আগে থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তিনি, বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্যও। তার হাত ধরেই সাদিক আব্দুল্লাহ বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন, মেয়রও হন। তবে নানা কাজে বিতর্ক তৈরি করেন তিনি, আওয়ামী লীগের অনেকেই তার বিপক্ষে অবস্থান নেন।
এই অবস্থায় যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য খোকন সেরনিয়াবাত পান দলের ইঙ্গিত। ভোটের মাস তিনেক আগে বরিশালের রাজনীতিতে জড়াতে শুরু করেন তিনি। খুলনা থেকে বরিশালে এসে বাংলা বাজার এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া করে সেখানে ওঠেন। আর তাকে কেন্দ্র করে জড়ো হতে থাকেন সাদিকবিরোধী আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা।
খোকনও পরিস্থিতি বুঝে নিজের নির্বাচনী প্রচারে যুক্ত করেননি সাদিককে। চাচার ভোটের দিনও বরিশালে আসেননি সাদিক, ফলে তার ভোটও দেওয়া হয়নি।
বড় ভাইয়ের বাসায় খোকন সেরনিয়াবাত, ছিলেন সাদিক-পরশও
তবে ভোটে জয়ের ভাইকে অভিনন্দন জানিয়েছেন হাসানাত আব্দুল্লাহ। বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মোহাম্মদ ইউনুসকে নিয়ে এই অভিনন্দন বার্তা দেন তিনি। তাতে আশা প্রকাশ করা হয়, আগামী জাতীয় নির্বাচনেও নৌকার জয়ের এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
সাদিক আব্দুল্লাহও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীরকে নিয়ে বিজয়ী প্রার্থীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ভোটের প্রচারে ভাতিজা সাদিকের মেয়রকালীন অনিয়ম-অব্যস্থাপনা নিরসনের প্রতিশ্রুতি দেন খোকন সেরনিয়াবাত।
বরিশালের মানুষ বঞ্চিত, মৌলিক সেবাও পায়নি: খোকন সেরনিয়াবাত
দলের অনেকের কাছ থেকে বিরুদ্ধ আচরণ দেখছি: খোকন সেরনিয়াবাত
তিনি বলেছিলেন, “এখানকার মানুষ অনেকদিন ধরে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত। মৌলিক সেবাও মানুষ পাচ্ছেন না। প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে এখানে মেয়র পদে মনোনীত করেছেন। মানুষ সুযোগ দিলে আমার দায়িত্ব শতভাগ পূরণ করব।”
সোমবার ভোটের ফল হওয়ার পর তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমাকে প্রার্থী বানিয়ে আপনাদের মাঝে পাঠিয়েছেন, ভোটের মাধ্যমে আপনারা আমাকে বিজয়ী করে নেত্রীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছেন।”
নগরবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, “নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে আপনাদের প্রতি দেওয়া সকল অঙ্গীকারসমূহ পর্যায়ক্রমে আমি বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট থাকব। নতুন বরিশাল গড়ার অঙ্গীকার, জয় হোক শেখ হাসিনার।”