গাজীপুর সিটি নির্বাচন: জাহাঙ্গীরের মনোনয়নপত্র বাতিল, মায়েরটি বৈধ

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “আমার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে।”

গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 April 2023, 06:16 AM
Updated : 30 April 2023, 06:16 AM

দলের বহিষ্কারাদেশ কাটিয়ে আবারও গাজীপুরের মেয়র হওয়ার আশায় মনোনয়নপত্র দাখিল করা জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা যাচাই-বাছাইয়ে বাতিল হয়ে গেছে। তবে তার মা জায়েদা খাতুনের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন।

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের রির্টানিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম রোববার সকালে জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন বাতিল ঘোষণা করে বলেন, “উনি একজন ঋণখেলাপি হিসেবে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। উনি একজন জামিনদাতা হিসেবে ঋণখেলাপি।”

এছাড়া ৩০০ জন সমর্থনকারীর জায়গায় ২৩৯ জনের স্বাক্ষর দিয়ে মনোনয়নয়পত্র জমা দেওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী অলিউর রহমান এবং যথাযথ কাগজপত্র না থাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল হোসেনের মনোনয়নপত্র বাতিল করার কথা জানিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, যাদের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে, তারা আপিল করার সুযোগ পাবেন। 

আগামী ২৫ মে অনুষ্ঠেয় গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাহাঙ্গীরের দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন প্রবীণ নেতা আজমত উল্লা খান। তার মনোনয়নপত্র বৈধ হওয়ায় দল মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক পাবেন তিনি।

গতবারের বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর এবারের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের কাছে নৌকা প্রতীক চেয়ে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের ঘোষণা দেন।

মেয়র পদে নিজের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মা জায়দা খাতুনের মনোনয়ন পত্রও জমা দেন জাহাঙ্গীর। তিনি বলেছিলেন, তার ওপর হওয়া ‘এই অন্যায়-অত্যাচারের’ প্রতিবাদেই প্রার্থী হয়েছেন তার মা।

রোববার বঙ্গতাজ মিলনায়তনে স্থাপিত রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে যাচাই বাছাই শেষে জায়েদা খাতুনসহ ৯ জনের মনোনয়ন পত্র বৈধ ঘোষণা করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা, বাতিল করা হয় তিনজনের মনোনয়নপত্র।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “আমার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে। ব্যাংকের ইনস্টলমেন্ট জমা দেওয়ার কথা জানিয়ে কর্তৃপক্ষ লিখিত ও মৌখিক জবানবন্দি দিয়েছে। তারপরও আপনারা যে কাজটি করলেন তাতে পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে, আপনারা নিরপেক্ষতার মধ্যে ছিলেন না।”

রিটার্নিং কর্মকর্তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করবেন জানিয়ে জাহাঙ্গীর বলেন, “আমি আশা করি আপনাদের কাজে যেন নিরপেক্ষতা থাকে। সব প্রার্থীর সঙ্গে নিরপেক্ষ আচরণ করা হয়।”

কেন বাতিল হল জাহাঙ্গীরের মনোনয়নপত্র

রিটার্নিং কর্মকর্তার ফোকাল পয়েন্ট (সহায়ক) কর্মকর্তা মো. মঞ্জুর হোসেন খান জানান, অগ্রণী ব্যাংকের ঢাকা ওয়াসা শাখা থেকে গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকার নিউ টাউন নিট ওয়্যার কোম্পানি লিমিটেডের একটি ঋণের গ্যারান্টার হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। কারখানা কর্তৃপক্ষ ওই টাকা পরিশোধ না করায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি শাখা ২৯ এপ্রিল এ সংক্রান্ত তথ্য দিয়েছে।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরের ভাষ্য, কোরিয়ান মালিকানাধীন ওই কম্পোজিট কারখানায় তার কোনো শেয়ার নেই, কোনো লভ্যাংশও তিনি নেন না। তারপরও হাজার হাজার শ্রমিককে বাঁচানোর জন্য মানবিক কারণে তিনি ‘নিজের সম্পদ’ তাদের দিয়েছেন।

“ওই ব্যাংকে মর্টগেজ দিয়ে সেই কোরিয়ান মালিক লোন নিয়ে কারখানাটি চলমান রেখেছে। এক কথায় আমি সেখানে জামিনদার হই। করোনা মহামারীর কারণে ইতোপূর্বে কোরিয়ান মালিক ব্যাংকে যথাসময়ে ওই পেমেন্ট দিতে পারেনি।

“আমি প্রার্থী হওয়ার পর গত ১১ এপ্রিল ও ১৮ এপ্রিল কোরিয়ানরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের যে পাওনা ছিল তা পরিশোধ করেছে। কোরিয়ান কোম্পনি অগ্রণী ব্যাংকের পাওনা টাকা পরিশোধ করেছে। সেই সমস্ত কাগজপত্র আইনজীবী এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জমা দেওয়া হয়েছে।”

জাহাঙ্গীর বলেন, ঋণ খেলাপির যে অভিযোগে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে, সেই কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে । যাচাই-বাছাইয়ের সময় ব্যাংকের কর্মকর্তারাও রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন। ব্যাংক কর্মকর্তারা ঋণ পরিশোধেদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

“তারপরও আমার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতা থেকে সরে গেছে। কোনো অদৃশ্যের চাপে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতা থেকে সরে গেছেন কিনা জানি না। তবে আমি ন্যায়বিচার পেতে আপিল করব। প্রয়োজনে আমি সুপ্রিম কোর্ট– হাই কোর্টে যাব। আমি শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যেতে চাই।”

এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকতা মো. ফরিদুল ইসলাম বলেন, “মনোনয়ন সঠিকভাবেই যাচাই বাছাই করেছি। জাহাঙ্গীর আলমের অন্যসব কাগজপত্র সঠিক আছে। তবে জাহাঙ্গীর আলম ব্যাংকে টাকা জমা করার কিছু কাগজপত্র আমাদের কাছে দিয়েছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে তা যথার্থ ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি তথ্যে ত্রুটি থাকায় তার মনোনয়নপত্রটি বাতিল করা হয়েছে। তবে প্রার্থীর আপিল করার সুযোগ রয়েছে, তিনি আপিল করতে পারবেন।”

বার বার আলোচনায়

জাহাঙ্গীর ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি; পরে গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি।

তবে তার নাম আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে, যখন তিনি সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আজমত উল্লার বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নমেন।

দলের নির্দেশেও ভোট থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি না হওয়ার পর সেবার নিখোঁজ হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। ভোটের ঠিক আগে আগে গাজীপুরে ফিরে কাঁদতে কাঁদতে আজমতকে সমর্থন জানান তিনি। তবে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় ব্যালটে তার নাম থেকে যায়।

গাজীপুরে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও সেই নির্বাচনে আজমত হারেন ১ লাখ ৬ হাজার ৫৭৭ ভোটে। জাহাঙ্গীর তখন বলেছিলেন, প্রার্থী নির্বাচনে ভুল করেছে তার দল।

পাঁচ বছর পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাহাঙ্গীরকে দলীয় প্রতীক নৌকা দেয় আওয়ামী লীগ। বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকে ২ লাখ দুই হাজার ৩৯৯ ভোটে হারিয়ে দেন তিনি।

সেই নির্বাচনের পর থেকে রাজধানী লাগোয়া এই জনপদে জাহাঙ্গীরের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছিল। তবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ঘরোয়া আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে।

আওয়ামী লীগের একটি অংশের ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে মেয়রের দলীয় সদস্যপদ কেড়ে নেয় আওয়ামী লীগ। তারপর বরখাস্ত হন মেয়র পদ থেকেও।

ভবিষ্যতে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করার শর্তে গত ১ জানুয়ারি তাকে ক্ষমা করার কথা জানিয়ে চিঠি দেয় আওয়ামী লীগ।

সেই ‘ক্ষমা’র শর্ত ভঙ্গ করে দলের প্রার্থী আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে বসেন জাহাঙ্গীর। মনোনয়নপত্র দাখিলের পর তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তাকে গুম করাও হতে পারে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘আস্থা থাকলে’ জাহাঙ্গীর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেবেন বলেই তার বিশ্বাস। আর সেজন্য তিনি ৮ মে পর্যন্ত দেখার কথাও বলেছিলেন।

আজমতের স্বস্তি 

রোববার মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাই শেষে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা বলেন, জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় তিনি ‘স্বস্তি’ পেয়েছেন।

“আমার দল, সাধারণ মানুষ ও শান্তিকামী মানুষ যেহেতু আমার সঙ্গে রয়েছে, সেজন্য অবশ্যই স্বস্তি আমি পাচ্ছি। নির্বাচনে আমি কাউকে প্রতিপক্ষ মনে করি না। আমি প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি। আমি সবাইকে নিয়ে স্বচ্ছ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন চাই। আমি এই মেসেজটা দিতে চাই যে কেউ আমাদের শত্রু নয়। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।”

বড় দল বিএনপির এ নির্বাচনে না থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করলে আজমত বলেন, “বিএনপি গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন বয়কট করেনি। সিটি করপোরেশন শুধুমাত্র মেয়র দ্বারা পরিচালিত নয়। এটি পরিচালনা করতে মেয়রের সঙ্গে কাউন্সিলরদেরও প্রয়োজন হয়। আর বিএনপি কাউন্সিলর পদে তাদের অসংখ্য নেতা-কর্মী নির্বাচন করছেন।

“আমি বলতে চাই, বিএনপি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়নি, শুধুমাত্র মেয়র নির্বাচন থেকে তারা সরে দাঁড়িয়েছেন। আমি মনে করি এ নির্বাচনে সাধারণ জনগণ লড়াই করছেন।”

জাহাঙ্গীরের বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে আজমত বলেন, “ঋণখেলাপির বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম একটি সংশোধনী চেয়েছেন। সেটা একসেপ্ট হয়েছে কি-না তা জানি না। ব্যাংকের প্রতিনিধিও বলেছে, তাদের বোর্ড মিটিং রয়েছে। সেই বোর্ড বিষয়টি ডিসাইড করবে। এটা আমাদের কোনো ব্যাপার নয়। নির্বাচন কমিশনের যে আইন রয়েছে, বিধি রয়েছে, সেই বিধির আলোকে তারা সিদ্ধান্ত নেবে।

“তবে জাহাঙ্গীর আলম আইনের মধ্য দিয়ে যদি প্রার্থিতা ফিরে পায়, আমি তাকে মোস্ট ওয়েলকাম জানাব।”

বৈধ প্রার্থী ৯ জন

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জমা পড়া ১২ মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর নয় জনের প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।

এ নির্বাচনে অংশ নিতে ১৩ জন মনোনয়নপত্র তুললেও দাখিলের শেষ দিন ২৭ এপ্রিল ১২ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন।

তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান, জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাবেক স্বাস্থ্য সচিব এমএম নিয়াজ উদ্দিন, জাকের পার্টির প্রার্থী রাজু আহমেদ, ইসলামি আন্দোলনের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান, গণ ফ্রন্টের প্রার্থী মো. আতিকুল ইসলাম, স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. হারুন অর রশিদ, স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম রনি, স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন মণ্ডল এবং বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়দা আক্তারের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ৮ মে পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার সুযোগ আছে, প্রতীক বরাদ্দ হবে ৯ মে। আগামী ২৫ মে ভোট হবে এই সিটি করপোরেশনে।