মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে ‘গুমের শঙ্কায়’ জাহাঙ্গীর

“হয়ত কালকের পরে আমার পায়ে শিকল পড়তে পারে। আমাকে অ্যারেস্ট করতে পারে, আমাকে গুম করতে পারে।”

গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 April 2023, 01:05 PM
Updated : 27 April 2023, 01:05 PM

দলের শৃঙ্খলা মেনে চলার শর্তে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের চার মাস যেতে না যেতেই ফের ‘বিদ্রোহী’ গাজীপুর সিটি নির্বাচনের বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে দলের প্রার্থী আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে ‘স্বতন্ত্র’ হিসেবে নিজের ও মায়ের নামে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে তিনি ‘গুমের’ শঙ্কার কথাও বলেছেন। বলেছেন, তাকে গ্রেপ্তারও করা হতে পারে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।

আগামী ২৫ মে ভোট সামনে রেখে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন বৃহস্পতিবার আজমত, জাহাঙ্গীর ও তার মা জায়েদা খাতুনসহ ১২ জন তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

আগামী রোববার এসব মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাই হবে। ৮ মে পর্যন্ত মনোনয়ন প্রত্যাহারের সুযোগ আছে।

মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে আজমত বলেছেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘আস্থা থাকলে’ জাহাঙ্গীর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেবেন বলেই তার বিশ্বাস। আর সেজন্য তিনি ৮ মে পর্যন্ত দেখার কথাও বলেছেন।

তবে ভোটের মাঠ থেকে সহজে সরছেন না, এ কথা জানিয়ে রাখলেন জাহাঙ্গীর। বলেছেন, ‘ষড়যন্ত্র করে’ না সরালে তিনি সরবেন না।

“আমার স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার কোনো পথ নাই, যদি আমাকে সরিয়ে দেওয়া না হয়। উপরে আল্লাহ আছে, নিচে গার্জিয়ানরা আছেন তারা বুঝবেন”, বলেন তিনি।

ঘরোয়া আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ও একাত্তরে শহীদদের নিয়ে ‘আপত্তিকর মন্তব্য’ করার অভিযোগ ওঠার পর দল ও সিটি করপোরেশনের পদ হারানোর দেড় বছর পর জাহাঙ্গীর ‘ক্ষমা’ পান গত ১ জানুয়ারি। কিন্তু চার মাস না যেতেই রাজধানী লাগোয়া মহানগরটিতে ২০১৩ সালের নির্বাচনের আমেজ ফিরে এসেছে জাহাঙ্গীরের সিদ্ধান্তে।

মেয়র পদ থেকে বরখাস্তের আদেশ নিয়ে তিনি বলেন, “আমি ১৮ মাস মিথ্যার (বহিষ্কারাদেশ) দায় বহন করছি । এটা থেকে আমি মুক্তি পেতে চাই। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আমি নির্বাচন করব।

“পাঁচ বছরের একটা নির্বাচিত মেয়রকে তিন বছর পর মিথ্যা, বানোয়াট অভিযোগে একটা চিঠি দিয়ে এ রকম করেছে। হয়ত কালকের পরে আমার পায়ে শিকল পড়তে পারে। আমাকে অ্যারেস্ট করতে পারে, আমাকে গুম করতে পারে।

“আমি দেশবাসী এবং নগরবাসীকে বলে যাই, যদি আমার মৃত্যু হয়, আপনারা বিশ্বাস করেন, আমার শহর রক্ষা করতে গিয়ে যা যা ভালো কাজ আছে আমি করেছি।”

‘ক্ষমতার কারণে’ অনেকে মিথ্যাচার করতে পারে, ‘ফাঁসিয়ে দিতে’ পারে মন্তব্য করে জাহাঙ্গীর বলেন, “এই দেশে অন্যায়কারীরা যেভাবে নাটক সাজায়, আমার বিরুদ্ধে হয়ত বা সেভাবেও কিছু করতে পারে।

“আমি বলতে চাই, হয়তবা আমি আপনাদের সামনে জীবনে নাও আসতে পারি, আমি এই শহরের মানুষের কোনো ক্ষতি হয় এমন কিছু করি নাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমার এবং এই শহরের মানুষের ক্ষতি করা হয়েছে।”

ভোট নয়, শহর রক্ষা করাটাই ‘বড় কথা’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “একটা মিথ্যার জয় হয়ে গেছে, সত্যের এখানে পতন ঘটেছে। এই মিথ্যাকে যারা সত্য বানিয়েছে, আমি ভবিষ্যতে তাদেরও বিচার চাই। আমি এই শহর রক্ষা এবং নেতাকর্মীদের রক্ষা করার জন্য যা করা প্রয়োজন তার জন্য আমি প্রস্তুত আছি।”

মেয়র হিসেবে কোনো অন্যায় করে থাকলে শহরের মানুষ ভোটের মাধ্যমেই তার বিচার করবে বলে মন্তব্য করেন জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, “আর যদি ভালো কিছু করে থাকি, তাহলে অবশ্যই অবশ্যই ভোটের মাধ্যমে জয়লাভ হবে।”

আওয়ামী লীগের ক্ষতি নয়

দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ালেও আওয়ামী লীগের ক্ষতি না করার কথা বলেছেন জাহাঙ্গীর।

তিনি বলেন, “জন্মের পর থেকেই আওয়ামী লীগ ছিলাম, আছিও। আওয়ামী লীগের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেটি আমি দেখব।

“নৌকার বিরুদ্ধে আমার অবস্থান নয়। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান নয়, ব্যক্তি আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান নয়। আমার অবস্থান অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে, অসৎলোক, খারাপ লোকের বিরুদ্ধে।”

জাহাঙ্গীরের মা কেন প্রার্থী

বিকেলে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে মেয়র পদে মা জায়েদা খাতুনের মনোনয়নপত্র জমা দেন জাহাঙ্গীর। পরে তার পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দেন মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক সদস্য আসকর আলী, সাবেক সহদপ্তর সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম এবং সাবেক গাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কাদির।

২০১৮ সালে জয়ের তিন বছর পর তার ওপর হওয়া ‘এই অন্যায়-অত্যাচারের’ প্রতিবাদেই মা প্রার্থী হয়েছেন দাবি করে জাহাঙ্গীর বলেন, “আমি সন্তান হিসেবে আমার মাকে রক্ষা করার জন্য আমার জীবন এখানে প্রস্তুত রেখেছি।”

তার মা সব সময় শহরের মানুষের জন্য কাজ করেছেন দাবি করে তিনি বলেন, “মা হিসেবে দেখেছেন এই সন্তানের ওপর কীভাবে অত্যাচার করা হয়েছে। সেজন্য আমার মাও ফরম নিয়েছেন। আমি আমার মার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। সন্তান হিসেবে আমি আমার জীবন পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত।”

১০ বছর ধরেই আলোচিত চরিত্র জাহাঙ্গীর

২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম ভোটের চিত্র ফিরে এসেছে ১০ বছর পর। এক দশক আগের সেই নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েছিল আজমতকে। দলের সমর্থনের প্রত্যাশী ছিলেন সে সময়ের তরুণ নেতা জাহাঙ্গীরও।

দলের নির্দেশেও ভোট থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি না হওয়ার পর নিখোঁজ হন জাহাঙ্গীর। ভোটের আগে আগে গাজীপুরে ফিরে কাঁদতে কাঁদতে আজমতকে সমর্থন জানান তিনি। তবে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় ব্যালটে তার নাম থেকে যায়।

গাজীপুরে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও সেই নির্বাচনে আজমত হারেন এক লাখ ৬ হাজার ৫৭৭ ভোটে।

সেই নির্বাচনে জাহাঙ্গীরের সমর্থক নেতা-কর্মীদের আজমত উল্লাহর পক্ষে নামতে দেখা যায়নি। এটা তখন নৌকার পরাজয়ে ‘ভূমিকা’ রাখে বলে অভিযোগ রয়েছে।

পাঁচ বছর পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাহাঙ্গীরকে দলীয় প্রতীক নৌকা দেয় আওয়ামী লীগ। বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকে দুই লাখ দুই হাজার ৩৯৯ ভোটে হারিয়ে দেন তিনি।

সেই নির্বাচনের পর থেকে রাজধানী লাগোয়া এই জনপদে জাহাঙ্গীরের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছিল। তবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ঘরোয়া আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে।

আওয়ামী লীগের একটি অংশের ক্ষোভ বিক্ষোভের মধ্যে মেয়রের দলীয় সদস্যপদ কেড়ে নেয় আওয়ামী লীগ। বরখাস্ত হন মেয়র পদ থেকেও।

ভবিষ্যতে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করার শর্তে গত ১ জানুয়ারি তাকে ক্ষমা করার কথা জানিয়ে চিঠি দেয় আওয়ামী লীগ।