গাজীপুরের এই মেয়র প্রার্থী অবশ্য বলছেন, তিনি আইনের সব ‘ফাঁক-ফোকর বন্ধ করে’ তবেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
Published : 30 Apr 2023, 01:30 AM
বহিষ্কারাদেশ কাটিয়ে আবারও দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে ভোটে লড়তে মনোনয়নপত্র দাখিল করে আলোচনায় গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও তার প্রার্থিতা টিকবে কি না, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
জাহাঙ্গীর অবশ্য দাবি করেছেন, তিনি সব ‘ফাঁক ফোকর বন্ধ করে’ তবেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ফলে এটি বাতিল হওয়ার কোনো কারণ নেই।
তবে এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে রোববার। কারণ এ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বৈধ কি না, তা যাচাই-বাছাই হবে এদিন।
আগামী ২৫ মে অনুষ্ঠেয় গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাহাঙ্গীরের দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন প্রবীণ নেতা আজমত উল্লা খান। দল মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক পাবেন তিনি।
জাহাঙ্গীর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। শুধু নিজেই নয়, মা জায়েদা খাতুনের নামেও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তিনি।
সেই কারণে অনেকের ধারণা, নিজের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার শঙ্কা থেকেই জাহাঙ্গীরের এই পদক্ষেপ।
জাহাঙ্গীরের তৎপরতা ১০ বছর আগে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে।
২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনেও দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। নানা নাটকীয়তার পর জাহাঙ্গীর প্রচারে না নামলেও সেই নির্বাচনে আজমত উল্লাকে হারতে হয়েছিল।
পরের নির্বাচনে ২০১৮ সালে জাহাঙ্গীর দলের মনোনীত প্রার্থী হয়ে মেয়র হলেও দুই বছর আগে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর মেয়র পদও হারান তিনি।
তবে গত ১ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরকে দলে ফিরিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ। এখন আবার তিনি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাচ্ছেন।
যে কারণে প্রশ্ন
গাজীপুরসহ পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা নিয়ে নির্বাচন কমিশন যে পরিপত্র জারি করেছে, তাতে হাই কোর্টের এক রায় উল্লেখ করে বলা হয়েছে- সিটি করপোরেশনের মেয়র পদটি লাভজনক হওয়ায় এই পদে অধিষ্ঠিতদের প্রার্থী হতে হলে আগে পদত্যাগ করতে হবে।
এবিধানের কারণেই জাহাঙ্গীরের প্রার্থিতা টিকবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরপরই ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর তাকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিসহ ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ তুলে বলা হয়, ‘সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে’ জাহাঙ্গীরকে মেয়রের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হল।
সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার সেই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যান জাহাঙ্গীর। ২০২২ সালের ২৩ অগাস্ট উচ্চ আদালত এক রুলে প্রশ্ন রাখে- জাহাঙ্গীরকে মেয়রের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না?
আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও আসেনি। তবে বলা হচ্ছে, যেহেতু জাহাঙ্গীরকে মেয়র পদ থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়নি, যেহেতু তিনি পদে বহাল রয়েছেন বলে ধরা যায়।
ফলে তিনি মেয়র পদে অধিষ্ঠিত থাকলে তাকে সেই পদ ছেড়ে তারপরই মনোনয়নপত্র দাখিল করতে হবে। কিন্তু তিনি তা করেননি বলে তার মনোনয়নপত্র বৈধ হবে না।
‘ফাঁক রাখেননি’ জাহাঙ্গীর
মেয়র পদে এখনও রয়েছেন দাবি করলেও জাহাঙ্গীর সেই সঙ্গে এটাও বলছেন, তার মনোনয়নপত্র বাতিল করার কোনো সুযোগ তিনি রাখেননি।
জাহাঙ্গীর শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাকে তো আদালত মেয়র পদ থেকে বহিষ্কার করেনি, এমনকি দায়িত্ব পালনে নিষেধও করেনি।”
সাময়িক বরখাস্তের পর মেয়র হিসেবে সুবিধা পেয়েছেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “না পাওয়ার তো কোনো বিষয় নেই, আমি কোনোটা নিচ্ছি, কোনোটা নিচ্ছি না।”
সেক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে মেয়র পদ ছেড়েছেন কি না- এমন প্রশ্নে জাহাঙ্গীরের সুনির্দিষ্ট জবাব দিতে চাননি।
মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে ‘গুমের শঙ্কায়’ জাহাঙ্গীর
জাহাঙ্গীর সরে দাঁড়াবেন, বিশ্বাস আজমতের
তিনি বলেন, “কাগজপত্র দেখে, বিশেষ করে নির্বাচনী আইনের কোনো জায়গায় মনোনয়ন বাতিল করার কোনো সুযোগ পাবে না।
“কারণ, আমি আইনের বই দেখে, আইনে যা যা আছে সব ঠিকমতো করেছি। কোনো ফাঁক-ফোকর রাখি নাই। এখন গায়ের জোরে বাতিল করতে পারবে। এছাড়া কোনো সুযোগ নাই।”
‘ফাঁক-ফোকর’ না রাখার বিষয়েও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেননি আইন নিয়ে পড়াশোনা করা জাহাঙ্গীর।
“কোর্টের রায়ের দিনই আপনারা অনেক কিছু পাবেন। আইন অনুযায়ী আমি সবই করব।”
বহিষ্কারাদেশ চ্যালেঞ্জ করে জাহাঙ্গীরের রিট আবেদনে ৩ মে রায় দেবে বিচারপতি জাফর আহমেদ ও বিচারপতি মো. বশির উল্লাহর বেঞ্চ।
জাহাঙ্গীরের পদত্যাগ করার ‘সুযোগ নেই’
জাহাঙ্গীরের বহিষ্কারাদেশে প্রত্যাহার এবং মেয়র পদে ফেরা নিয়ে গুঞ্জনের মধ্যে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম গত ২২ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “তাকে তো মেয়র পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়নি; সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। সাময়িকভাবে বরখাস্ত যেসব কারণে করা হয়েছে, সেগুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সময়ের ব্যবধানে এ বিষয়ে বলা যাবে।”
এরপর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হলেও জাহাঙ্গীরের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের কোনো প্রজ্ঞাপন আসেনি। এর মধ্যে বিষয়টি আদালতেও গড়ায়।
এক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ এখনও বহাল রয়েছে বলেই মনে করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ, যিনি এক সময় নির্বাচন কমিশনের সচিবের দায়িত্বও পালন করেন।
তিনি শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মেয়াদকালীন সময়ের জন্য সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন উনি (জাহাঙ্গীর)। মেয়াদের মধ্যে তাকে তো আর পুনর্বহাল করা হয়নি। পুনর্বহাল না করার মধ্যে উনার মেয়াদ শেষ হয়েছে।
“পুনর্বহাল না হওয়ায় উনার পদত্যাগ করার কোনো বিধান তো থাকছে না। সরকার তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে।”
“সিটিং মেয়রের পদত্যাগ করে নমিনেশন পেপার জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। তার ক্ষেত্রে পদত্যাগ করার আর তো সুযোগ নেই,” বলেন সাবেক ইসি সচিব হেলালুদ্দীন।
জাহাঙ্গীর বার বার আলোচনায়
জাহাঙ্গীর ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি; পরে গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি।
তবে তার নাম আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে,যখন তিনি সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আজমত উল্লার বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে।
দলের নির্দেশেও ভোট থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি না হওয়ার পর সেবার নিখোঁজ হয়েছিলেন তিনি। ভোটের ঠিক আগে আগে গাজীপুরে ফিরে কাঁদতে কাঁদতে আজমতকে সমর্থন জানান তিনি। তবে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় ব্যালটে তার নাম থেকে যায়।
গাজীপুরে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও সেই নির্বাচনে আজমত হারেন ১ লাখ ৬ হাজার ৫৭৭ ভোটে। জাহাঙ্গীর তখন বলেছিলেন, প্রার্থী নির্বাচনে ভুল করেছে তার দল।
পাঁচ বছর পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাহাঙ্গীরকে দলীয় প্রতীক নৌকা দেয় আওয়ামী লীগ। বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকে ২ লাখ দুই হাজার ৩৯৯ ভোটে হারিয়ে দেন তিনি।
সেই নির্বাচনের পর থেকে রাজধানী লাগোয়া এই জনপদে জাহাঙ্গীরের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছিল। তবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ঘরোয়া আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগের একটি অংশের ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে মেয়রের দলীয় সদস্যপদ কেড়ে নেয় আওয়ামী লীগ। তারপর বরখাস্ত হন মেয়র পদ থেকেও।
ভবিষ্যতে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করার শর্তে গত ১ জানুয়ারি তাকে ক্ষমা করার কথা জানিয়ে চিঠি দেয় আওয়ামী লীগ।
সেই ‘ক্ষমা’র শর্ত ভঙ্গ করে দলের প্রার্থী আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে প্রার্থী হলেন জাহাঙ্গীর। মনোনয়নপত্র দাখিলের পর তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তাকে গুম করা হতে পারে।