পাঠকদের আমি তিনটি ঘটনা বলতে চাই। ধর্ষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুরে আইনের প্রয়োগ ও নারীর নিরাপত্তা সম্পর্কে একটা ধারণা দিতেই এই লেখার অবতারণা।
Published : 23 May 2017, 09:28 AM
ঘটনা-১
২০১৫ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি। ম্যাকরিচি জলাধার সংলগ্ন এলাকায় ঘটে ঘটনাটি।
সকালবেলা বাংলাদেশি নির্মাণ শ্রমিক প্রামাণিক লিটন ১৬ সেন্টিমিটার লম্বা একটি ধারালো চাকু নিয়ে ডরমিটরি থেকে বের হন। এরপর তিনি সহজে শিকার পাবার আশায় লর্নি ট্রইলের পাশে অপেক্ষা করছিলেন। যখন তিনি শিকারকে একা হাঁটতে দেখলেন, তখন প্রামাণিক লিটন তার কাছে গিয়ে কথা বলা শুরু করলেন এমন এক ভাব নিয়ে, যেন তার কোনো পথের দিক-নির্দেশনা প্রয়োজন।
পাঠক,নিশ্চয়ই এতক্ষণে প্রামাণিক লিটনের শিকার সম্পর্কে কৌতুহল অনুভব করছেন। বাংলাদেশের এই ২৪ বছর বয়সী নির্মাণ শ্রমিক ৪০ বছর বয়স্ক এক চাইনিজ নারীকে তার সাথে যৌন মিলনের প্রস্তাব দেন। ভদ্র মহিলা রাজি না হওয়ায় প্রামাণিক লিটন চাকু বের করে মহিলার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন। লিটন এক হাত দিয়ে মহিলার নাক ও মুখ চেপে ধরে এবং অন্য হাত দিয়ে চাকুটি মহিলার গলায় চেপে ধরলে ভদ্র মহিলা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
এরপর লিটন ওই চাইনিজ মহিলাকে এতটাই জোর করে ধর্ষণ করে যে মহিলা ব্যাথায় চিৎকার দিয়ে ওঠে। ধর্ষকের আবার দরদ কত!ওই মহিলা যাতে গর্ভধারণ না করে,সেজন্য লিটন তাকে ৫০ ডলার দিতে চায়। ডিএনএ পরীক্ষায়,মহিলার শরীরে এবং পোশাকে প্রামাণিক লিটনের শুক্রাণু পাওয়া গেছে।
ভাগ্যিস এটি বাংলাদেশ নয়! তাই বিচার পেতে দেড় যুগ লাগলো না। মাত্র দুই বছরের মধ্যেই এই ধর্ষণ মামলার রায় দিয়েছে সিঙ্গাপুরের আদালত। হ্যা,গত ১৯ মে, ২০১৭ তারিখে বাংলাদেশের নির্মাণ শ্রমিক প্রামাণিক লিটনের ১৭ বছরের জেল হয়েছে। সাথে রয়েছে ২৪টি বেত্রাঘাত।
ঘটনা-২
৩২ বছর বয়সী এক ইন্দোনেশিয়ান গৃহকর্মীর সাথে প্রেম ছিল ২৯ বছর বয়সী বাংলাদেশি শ্রমিক আহমেদ সুহেলের সাথে। এক পর্যায়ে,ইন্দোনেশিয়ার ওই গৃহকর্মী আহমেদ সুহেলের সাথে সম্পর্ক রাখতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। বিষয়টি মানতে পারেনি আহমেদ সুহেল।
২০১৬ সালের ১লা মার্চ। সিঙ্গাপুরের নোভেনা এলাকার জেন্টল রোডেই ঘটেছিল ঘটনাটি। ওই ইন্দোনেশিয়ান নারী বাজার থেকে বাসায় ফিরছিলেন, সাথে ছিল গৃহকর্তার তিন বছর বয়সী ছেলে। এ সময় আহমেদ সুহেল এসে ওই ইন্দোনেশিয়ান গৃহকর্মীর শরীরে চাকু দিয়ে আঘাত করে। ভাগ্যিস, ওই গৃহকর্মী প্রাণে বেঁচে যায়!
২০১৭ সালে ৬ এপ্রিলে সিঙ্গাপুরের আদালত আহমেদ সুহেলের বিরুদ্ধে রায় দেয়। বিচারে আহমেদ সুহেলকে সাড়ে তিন বছরের জেল ও ছয়টি বেত্রাঘাত শাস্তি দেয় সিঙ্গাপুরের আদালত। পাঠক খেয়াল করুন, রায় হলো মাত্র এক বছরের মধ্যেই।
ঘটনা-৩
২০১৩ সালের ২ নভেম্বর। উডল্যান্ডস এলাকায় ঘটে ঘটনাটি। ৩২ বছর বয়সী ইন্দোনেশিয়ান গৃহকর্মী নিকটস্থ একটি শপিং মলে তার গৃহকর্তার পরিবারের জন্য সকালের নাস্তা কিনতে গিয়েছিলেন। ওই ইন্দোনেশিয়ান নারী ফুড কোর্টে গিয়ে খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমন সময় নুরুল ইসলাম নামে এক বাংলাদেশি পরিচ্ছন্নতা কর্মী এসে এই ইন্দোনেশিয়ান নারীকে জানায় যে শপিং মলের কার পার্কে আরেকজন বাংলাদেশি এবং এক ইন্দোনেশিয়ান গৃহকর্মী মারামারি করছে।
ফলে খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ইন্দোনেশিয়ান গৃহকর্মী ভেবে নেয় যে শপিং মলের কার পার্কে মারামারি করতে থাকা ওই ইন্দোনেশিয়ান হয়তো তার বন্ধুদের একজন। তাই সে খাবারের লাইন ছেড়ে ওদের মারামারি ঠেকাতে নুরুল ইসলামের সাথে ওই কার পার্কের চতুর্থ তলায় চলে যায়।
কিন্তু গিয়ে দেখেন, সেখানে কেউ নেই। নুরুল ইসলাম তাকে মিথ্যে বলে সেখানে নিয়ে গেছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে ওই ইন্দোনেশিয়ান গৃহকর্মী কার পার্ক থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। আর অমনি নুরুল ইসলাম তার চুলের মুঠি ধরে দেয়ালের এক কোণায় নিয়ে তাকে বিবস্ত্র করে এবং তার শরীরে হাত দেয়। কিন্তু ওই ইন্দোনেশিয়ান গৃহকর্মী হার মানার পাত্রী নয়। সেও নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়।
একটা পর্যায়ে, নুরুল ইসলাম যখন দেখে যে কিছুতেই তাকে কাবু করতে পারছে না, তখন সে ওই নারীর দিকে কাপড় ছুড়ে দেয় এবং তাকে চলে যেতে বলে। পরে ওই গৃহকর্মী বাসায় গিয়ে তার গৃহকর্তাকে জানালে তিনি পুলিশে খবর দেন।
২০১৫ সালে ২৯ মে, সিঙ্গাপুরের আদালত বাংলাদেশি পরিচ্ছন্নতা কর্মী নুরুল ইসলামকে ছয় বছরের জেল এবং আটটি বেত্রাঘাত শাস্তি দেয়। পাঠক লক্ষ করুন, মাত্র দেড় বছরের মাথায় বিচার পেয়েছে ভিকটিম।
পাঠক, উপরের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে বারবার আপনাদের খেয়াল করিয়ে দিচ্ছিলাম, কত দ্রুত ভিকটিমরা বিচার পেয়ে যাচ্ছে। অপরাধগুলো ঘটছে বাংলাদেশি স্টাইলে, যেমন প্রকাশ্য দিবালোক সিলেটের এমসি কলেজ প্রাঙ্গণে খাদিজাকে যেভাবে ছুরিকাঘাত করা হয়, সেভাবেই বাংলাদেশি শ্রমিক আহমেদ সুহেল তার প্রাক্তন প্রেমিকা ওই ইন্দোনেশিয়ান গৃহকর্মীর শরীরে চাকু দিয়ে আঘাত করে।
ধর্ষণ তো বাংলাদেশের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। প্রতিদিনই খবরের কাগজ খুললে ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। সময় মতো বিচার হয় না,অথবা আদৌ কারো কারো বিচার হয় না বলেই তো এদের সাহস এত বেড়ে গিয়েছে। সিঙ্গাপুরের মতো একটা দেশ যেখানে জায়গায় জায়গায় সিসি ক্যামেরা লাগানো সেখানে এসেও এরা ধর্ষণ করে বেড়াচ্ছে।
ওই যে, দেশে ঠিক মতো বিচার হয় না। এনারা ভাবছে, বিদেশে এসেও তারা ইচ্ছামতো এসব অপরাধ করবে, কেউ ধরতেই পারবে না তাদের। রেহাই পায়নি কেউ। এরা ভেবেছিল নির্জন রাস্তায় গিয়ে অথবা কার পার্কে গিয়ে ধর্ষণ করলে কেউ টের পাবে না, তাদের বিচারও হবে না। কিন্তু বিচার ঠিক সময় মতোই হয়েছে। আর এজন্যই এখানে মেয়েরা এত নিরাপদ। এখানেও মাঝে মাঝে এমন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, কিন্তু দ্রুততম সময়ে বিচার হয়।
উপরের প্রতিটি রায়ের ক্ষেত্রেই আদালত জেল-হাজতের পাশাপাশি শাস্তি হিসেবে বেত্রাঘাত দিয়েছেন। বেত্রাঘাতের কথা শুনে অনেকেই ভাবতে পারেন, এটি আবার কী এমন শাস্তি! কেউ কেউ হাসি দিয়েও উড়িয়ে দিতে পারেন, বেত্রাঘাত আবার একটা শাস্তি হলো! যারা এই বেত্রাঘাত সম্পর্কে জানেন না, তারা এমনটিই ভাবতে পারেন।
আমি নিজেও প্রথম যখন এই বেত্রাঘাত সম্পর্কে শুনেছিলাম,আামি নিজেও খুব হালকাভাবেই নিয়েছিলাম বিষয়টা। পরে একজন বাংলাদেশি নারীর কাছে এই বেত্রাঘাতে ভয়াবহতা সম্পর্কে শুনেছিলাম। তার বর্ণনা থেকে শুধু এটুকু বুঝেছিলাম, যারা একবার এই বেত্রাঘাত খেয়েছে, তাদের মন এবং শরীর সারাজীবন ভুলতে পারবে না, এই বেত্রাঘাতের কথা।
লেখক: রোকেয়া লিটা, লেখক ও সাংবাদিক
ই-মেইল: [email protected]
এই লেখকের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |