এখানে সরকারের অনুমতি না থাকলে কাজ করা সম্ভব নয়। কেউ যদি আমাকে চাকরির প্রস্তাব দিয়ে আমার জন্য কাজের অনুমতি করিয়ে নিতে পারে, তবেই আমি এখানে কাজ করতে পারবো।
আমি আর সে আশায় বসে রইলাম না। কারণ, এখানে আমাকে কেউ চেনেও না- জানেও না; আমার মত অপরিচিত একজন মানুষকে কেন কেউ চাকরির প্রস্তাব দিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি করিয়ে আনবে!
আর তাছাড়া আমি তো পেশায় সাংবাদিক, বাংলাদেশ থেকে সাংবাদিক আনার দরকার নেই এদের। এদেশেই অনেক সাংবাদিক আছে। এদের প্রয়োজন নির্মাণ শ্রমিক। তাই নির্মাণ শ্রমিকের চাহিদা এখানে বেশি।
চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম লেখাপড়া করবো। কিন্তু আমি তখন বাংলাদেশে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দ্বিতীয় মাস্টার্স করছি। দুটো মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে ফেলার পথে।
আবারও মাস্টার্স! না, না, এতোগুলো ডিগ্রি দিয়ে কী করবো! ভাবলাম, পিএইচডির জন্য চেষ্টা করি। আমার বর যে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পিএইচডি করছে, সেখানেই একটি কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্কুল আছে।
পিএইচডির জন্য আবেদন করার ক্ষেত্রে উপদেষ্টা খুঁজে পাওয়া অনেক বড় একটি বিষয়। নিজের গবেষণা প্রস্তাবের সাথে উপদেষ্টার গবেষণা আগ্রহের মিল থাকতে হবে। আমি ওই স্কুলের ওয়েবসাইটে গিয়ে বেশ কয়েকজন অধ্যাপকের পরিচিতি জেনে তাদের ইমেইলে যোগাযোগ করলাম।
দুইজনের কাছ থেকে সাড়া পেলাম। তাদের মধ্যে একজন ব্রিটিশ অধ্যাপকের সাথে আমার ভালো যোগাযোগ হলো। তিনি আমার মাস্টার্সের চলমান গবেষণাটি বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন। একদিন নিজের পরিচয় দিয়ে, আমি তার সাথে দেখা করতে চাইলাম। তিনি তার ঠিকানা দিয়ে আমাকে সময় দিলেন।
নির্ধারিত দিনে ঠিক সময় মত ওই অধ্যাপকের অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। তিনি আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন, কারণ আমি যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে তিনি একটি ইমেইল পেয়েছেন।
সেই ইমেইলে জানতে পেরেছেন যে, একটি জার্নালে তার গবেষণা একসেপ্টেড হয়েছে। ভালো-মন্দ দুয়েকটি কথা বলার পর, তিনি তার অফিস থেকে আমাকে নিচে একটি কফি-শপে নিয়ে গেলেন। আমরা কফি নিলাম।
এরপর তিনি সাংবাদিকতা বিভাগের স্টুডিও থেকে শুরু করে অন্যান্য জায়গাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখালেন। তিনি আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে চাইলেন।
আমি একটি উপন্যাস লিখেছি শুনে আমাকে অভিনন্দনও জানালেন। একটা পর্যায়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কেন পিএইচডি করতে চাই ?
আমি তখন বলতে পারিনি যে, সিঙ্গাপুরে আমার কাজ করার অনুমতি নেই বলেই পিএইচডি করতে চাই। আমি বলেছিলাম যে, আমি লেখালেখিতে মনোযোগী হতে চাই, সাংবাদিকতা করে লেখালেখিতে সময় দিতে পারি না।
তখন তিনি বললেন যে, তিনি নিজেও এক সময় সাংবাদিক ছিলেন। এরপর তিনি শিক্ষকতায় এসেছেন। পিএইচডি করলে আমাকেও হয়তো ক্লাস নিতে হবে এবং শিক্ষকতা করতে হবে।
আমি বেশ জোর দিয়ে বললাম, শিক্ষকতা করার পাশাপাশি লেখালেখি অনেক সহজ হবে, অনেক সময় পাবো। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আমার ভুলটি ভাঙিয়ে দিলেন।
তিনি জানালেন, সাংবাদিকতার চেয়ে বরং শিক্ষকতায় বেশি সময় দিতে হয়। শুধু তাই নয়, ক্লাস নেয়ার পাশাপাশি প্রচুর গবেষণা করতে হয় এবং সেগুলোর জন্য অনুদান আনতে হয়। ঠিক মত গবেষণা করতে না পারলে চাকরির মেয়াদ বাড়ে না।
এখানে শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ে পেশাগত উৎকর্ষতার উপর ভিত্তি করে। এমনও নয় যে, যেন-তেন শিক্ষক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন তারা। সিঙ্গাপুরের বেশিরভাগ শিক্ষকই বিদেশি, ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।
আমি উই কিম উই স্কুল অফ কমিউনিকেশন অ্যান্ড ইনফরমেশন- এর ওই অধ্যাপকের কথা শুনে বেশ থতমত খেয়ে গেলাম। মনে মনে বললাম- আয় হায়, এইটা কী কয়! বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি আবার চুক্তিভিত্তিক হয় না কি!
আমি এই ব্যবস্থাটির সাথে মোটেই পরিচিত নই। বাংলাদেশে তো দেখি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়া আর সোনার হরিণ পেয়ে যাওয়া একই কথা। একবার কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়ে গেলে আর তাড়ায় কে? গবেষণা তো দূরের কথা, অনেকে শুনি ক্লাসও ঠিক মত নেয় না, অনেকের বিরুদ্ধে ছাত্রী হয়রানির আভিযোগ, তারপরও তাদের চাকরি যায় না। কারণ, ওই যে 'সোনার হরিণ'টা তারা পেয়ে যায়।
ভুলটা বোধ হয় আমিই করেছি, সিঙ্গাপুরের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মেলাচ্ছি। সিঙ্গাপুরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিয়েই অনেকে এ দেশটাকে চেনেন।
নানইয়াং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং-এ বিশ্বে তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম স্থান দখল করে আসছে। আর আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং-এ বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৩তম স্থান দখল করে রেখেছে। সিঙ্গাপুরের আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং-এ বিশ্ববিদ্যালয়টি ১২তম স্থান দখল করেছে, যেখানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এদের ধারে কাছেও নেই। কেন নেই, তা তো উপরে উল্লেখিত শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া দেখেই বোঝা যায়।
দুদিন আগেই পত্রিকায় পড়লাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পাশ না করেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে কয়েকজন, যেখানে নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া যায় না। বরং কয়েক বছর ধরে আবার পোস্ট ডক্টরেট করতে হয়। তারপর শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার চিন্তা।
আপনার সরল মন ভাবতেই পারে, যোগ্য শিক্ষক না পেলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেবে কোথায় থেকে? হা হা হা, আমি বরং কিছুক্ষণ হাসি।
বাংলাদেশের কিছু কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগদাতারা নিজেদের এতই বড় ব্রাহ্মণ মনে করেন যে, প্রার্থী যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবে তাকে সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পাশ করতে হবে।
অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা প্রার্থী হলে চলবে না। অভিযোগ আছে, অক্সফোর্ডে শিক্ষকতা করে আসা ব্যক্তিকেও কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতার চাকরি দেওয়ার জন্য যোগ্য মনে করেনি।
অতএব, আপনিই নির্ণয় করুন, কেন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং-এ পিছিয়ে আছে।
শুধু শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে দোষ দিলেও বিশাল একটা অন্যায় করা হবে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য বরাদ্দও নেই বললেই চলে।
সিঙ্গাপুরের সরকার প্রচুর বরাদ্দ দিয়ে থাকে গবেষণার জন্য, যা বাংলাদেশে নেই।
এই তো সেদিনই পত্রিকায় পড়লাম, শুধু সমাজ বিজ্ঞান ও মানবিক অনুষদেই আগামী পাঁচ বছরের গবেষণার জন্য ৩৫০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিচ্ছে সিঙ্গাপুরের শিক্ষা মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য, প্রযুক্তিসহ অন্যান্য খাতে তো অনুদান আছেই।
সিঙ্গাপুরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানের দিক থেকে বহির্বিশ্বে একটা স্থান দখল করে ফেলেছে। এখন এদেশে ইউরোপ-আমেরিকা থেকেও শিক্ষার্থীরা পড়তে আসছেন।
সবাই যে বৃত্তি নিয়ে এখানে লেখাপড়া করছে, তা কিন্তু নয়।
বিদেশি শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশই এদেশে লাখ লাখ ডলার খরচ করে লেখাপড়া করছে, আর তাতেই তো বিনিয়োগকৃত অর্থের পাশাপাশি মেধা ও শ্রমের মিশেলে সিঙ্গাপুর এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে সরকার যতদিন শিক্ষাকে জাতি গঠনের জন্য বিনিয়োগের দৃষ্টিতে দেখবে না, ততদিন এই খাতে উন্নতি দেখতে পাওয়া কঠিন।
রোকেয়া লিটা
সাংবাদিক
rokeya.lita@hotmail.com