সিঙ্গাপুরের চিঠি: প্রতিমা বিসর্জনে মানা যেখানে!

মাস খানেক হলো নতুন বাসায় উঠেছি। নতুন বাসাটা দেখার জন্য আমি আর ধ্রুব যেদিন এসেছিলাম, সেদিনই আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল।

রোকেয়া লিটা, সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Oct 2016, 02:05 PM
Updated : 12 Oct 2016, 11:31 AM

আমাদের মুখে বাংলা কথা শুনে পাশ থেকে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমাদের ডাকলেন। এরপর নিজের পরিচয় দিয়ে আলাপ শুরু করে দিলেন। ভদ্রলোক নিজেও বাঙালি, তবে তার জন্মস্থান ভারতে। বড় হয়েছেন মালয়েশিয়ায়, আর এখন বাস করছেন সিঙ্গাপুরে, আমাদের মুখোমুখি একটি ফ্লাটে। বলছিলাম, পঁচাত্তর বছর বয়স্ক সুনীল দাদার কথা। স্ত্রী মারা গেছেন বছর খানেক হলো। এখন একাই থাকেন।

সুনীল দাদার সঙ্গে নিয়মিতই আলাপ হয়। বিশেষ করে বাসায় ঢোকার সময় আর বের হওয়ার সময়। কারণ, সিঙ্গাপুরের প্রায় সব বাসার দরজাতেই দুটো স্তর থাকে। একটি গ্রিলের দরজা, আর আরেকটি কাঠের। সচরাচর গ্রিলের দরজাটাই বেশি ব্যবহার করে সবাই। কাঠের দরজাটা খোলা থাকে। রাতে অবশ্য দুটো দরজাই বন্ধ থাকে। গ্রিলের দরজা থাকায় বাসা থেকে বের হলেই সুনীল দাদা আমাদের দেখতে পান।

সেদিন সুনীল দাদাকে বললাম পূজা দেখতে যাবো।

ব্যস, তিনি বলে দিলেন সন্ধ্যা সাতটায় বের হবো, তৈরি থেকো। ঠিক সময় মতো আমরা বের হলাম। জুরং ইস্ট এলাকার একটি মণ্ডপে গেলাম পূজা দেখতে। সেখানে গিয়ে দেখলাম, বাংলাদেশি আর ভারতীয় বাঙালিরা একসঙ্গে পূজা উদযাপন করছেন। পূজা দেখতে এসেছে অন্য ধর্মাবলম্বীরাও। পূজার পাশাপাশি চলছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনেকদিন পর বাংলাদেশের নাচ-গান দেখে মনটা ভরে উঠলো।

পূজা শেষে সবার জন্য ছিলো খাবারের আয়োজন। হিন্দু-মুসলিম কোনো ভেদাভেদ নেই, সবার জন্য উন্মুক্ত এই আয়োজন।

পরদিন সকালে আবার সুনীল দাদা ফেরার পার্ক মেট্রোরেল স্টেশনের পাশেই আরেকটি মণ্ডপে নিয়ে গেলেন আমাদের। এখানেও বিশাল আয়োজন। দেশে থাকতে অনেকবার পূজা দেখেছি। এবারই প্রথম সিঙ্গাপুরের মাটিতে পূজা দেখলাম। এখানে সুনীল দাদার পরিচিত লোকজন অনেক। সবার সঙ্গে দেখা হলো, পরিচয় হলো। বেশ ভালোই লাগছিল।

আমরা মণ্ডপে বসে দেখছিলাম, মেয়েরা আরতী দেওয়ার জন্য একে একে থালায় সিঁদুর, মিষ্টান্ন আর ফুল নিয়ে মঞ্চে উঠছিলো। এমন সময় ঘোষণা এলো, “দিদিরা, দয়া করে দেবীর গায়ে সিঁদুর ছোঁয়াবেন না, সতর্ক থাকবেন মিষ্টান্ন যেন দেবীর গায়ে না লাগে। কারণ, এই দেবীই আগামী বছর আমাদের ব্যবহার করতে হতে পারে।"

শুনে বেশ অবাকই হলাম! সুনীল দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনারা তাহলে দেবীকে ভাসাবেন না?"

তিনি জানালেন, দেবীকে ভাসাবেন না তারা। কারণ সচরাচর পূজা করার জন্য বাইরে থেকে মূর্তি আনতে হয়। একদিকে মূর্তি আনা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি অনুমতিরও একটা ব্যাপার আছে। তাই প্রতি বছর তারা নতুন মূর্তি দিয়ে পূজা করেন না। সচরাচর পাঁচ বছর পরপর মূর্তি বদলানো হয়।

মণ্ডপে পূজা আর সিঁদুর খেলা শেষ হতে হতে দুপুর হয়ে গেলো। আমরা খেয়ে দেয়ে গাড়িতে করে বাসার দিকে রওনা হলাম। গাড়িতে বসে সুনীল দাদার কাছে জানতে চাইলাম, এই মূর্তিগুলো কোথায় ভাসানো হয়?

উত্তরে সুনীল দাদার কাছ থেকে জানা গেল অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। সিঙ্গাপুরের কোনো নদী বা খালে-বিলে মূর্তি ভাসানোর অনুমতি নেই। এতে নদী দূষণ হয়। সচরাচর কয়েক বছর পর পর জাহাজ ভাড়া করে মূর্তিগুলোকে সমুদ্রে নিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি কেউ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির পোড়া অবশিষ্টাংশও নদী-নালায় ফেলা হয় না।

গত বছর সুনীল দাদার স্ত্রী মারা গেলে তার ছেলে মায়ের পোড়া অবশিষ্টাংশ হাঁড়িতে নিয়ে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছে। হয়তো পরিবেশ দূষণ ঠেকাতেই এই ব্যবস্থা।

ঠিক সেই মুহুর্তে আমার সামনে ভেসে উঠেছিল বাংলাদেশের চিত্র। পত্রিকা পড়ে জানলাম, এ বছর সারা দেশে ২৯ হাজার ৩৯৫টি স্থায়ী ও অস্থায়ী মণ্ডপে দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতোগুলো মূর্তি ভাসানো হবে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীতে।

কোরবানির ঈদের সময়ও দেখেছি, এখানে পশু জবাই করার ব্যাপারে অনেক বিধি-নিষেধ আছে। কয়েক বছর ধরেই কোরবানির ঈদের সময় নির্দিষ্ট একটি জায়গায় কোরবানি দেওয়ার কথা বলছে প্রশাসন। কিন্তু আদৌ তা নিয়মে পরিণত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এ বছর বাংলাদেশে কোরবানিতে পশুর রক্তে ঢাকার একটি রাস্তা রক্তে ভেসে যাওয়া বেশ আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছিল। বিষয়টি নিয়ে খবর এসেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও। সমালোচনা যেহেতু চলছে, নিশ্চয়ই কোনো একদিন নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কোরবানি পালিত হবে।

কিন্তু দূর্গাকে ভাসিয়ে দেওয়ার পর যে নদী দূষণ, তা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। প্রশাসন নিরব, গণমাধ্যম নিরব, সুশীল সমাজ নিরব! দূর্গাকে নদীতে ভাসানো একটা বড় ধরনের দূষণ, সেই বোধ এখনও তৈরি হয়নি বাংলাদেশে। তাহলে সমাধান হবে কীভাবে? পথে-ঘাটে কোরবানির রক্ত যেমন দুর্গন্ধ ছড়িয়ে বায়ু দূষণ করে, রোগ-জীবাণু ছড়ায়, ঠিক তেমনি দূর্গাকে নদীতে ভাসালেও নদীর পানি দূষিত হয়।

সংস্কৃতির দিক দিয়ে সিঙ্গাপুর একটি বৈচিত্রপূর্ণ দেশ। এখানে সব ধর্মের লোকজন শান্তিপূর্ণভাবে তাদের আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। তবে পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে কোনো কিছুর সাথেই আপোষ করে না তারা। বাংলাদেশ সেই বিবেচনায় অন্ধকারে বাস করছে। সামনের দিনগুলোতে এই অন্ধকার দূর হবে কি? 

লেখক: সাংবাদিক।

ইমেইল: rokeya.lita@hotmail.com