সিঙ্গাপুরের চিঠি: জামানত ফেরত দেওয়া বাড়িওয়ালির উপহার!

অবশেষে পুরনো বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় উঠলাম আমরা। এই বাসাটা বেশ পুরনো, আগের বাসার মত অতো সুন্দর নয়।

রোকেয়া লিটা, সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Jan 2017, 12:14 PM
Updated : 5 Jan 2017, 12:14 PM

অনেক সুযোগ-সুবিধা,যেমন- জিম বা সুইমিং পুল নেই। তাতে কোনো সমস্যা নেই আমাদের। এই বাসাটার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো,এটি ‌এমন এলাকায় যেখানে প্রচুর বাংলাদেশি।

আমরা যে ভবনে থাকি, তার নিচতলায় বেশ কিছু বাংলাদেশি শ্রমিক থাকেন। বাজার করতে গেলেও দেখি বেশ কয়েকটা বাংলাদেশি মিনি মার্ট রয়েছে এই এলাকায়। আর পাশের বাসার বাঙালী দাদু তো আছেনই।

কিন্তু সমস্যা হলো, দুই জায়গায় বাসা ভাড়ার জামানত আটকে আছে আমাদের। এতে করে একটা অর্থসংকটে ভুগছিলাম আমরা। নতুন বাসার জামানত তো বাড়িওয়ালির কাছে থাকবেই,সেটা জানা কথা।

কিন্তু যে বাসাটা ছেড়ে এলাম,সেই বাসার জামানত এখনও ফিরে পেলাম না আমরা। বাসা ছাড়াও সময় ওই যে বাড়িওয়ালি আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর নিল,তারপর আর টাকা পাঠানোর কোনও খবর নেই।

হঠাৎ একদির পুরনো বাসার বাড়িওয়ালি আমার বর ধ্রুবর কাছে ম্যাসেজ পাঠালো,সে আমাদের জামানত ফেরত দিতে পারবে না। কারণ আমরা নাকি তার বাসার কাঠের মেঝেতে অনেক দাগ করে রেখে এসেছি। অথচ বাসায় ওঠার সময়ই মেঝের ওই দাগগুলো আমরা দেখেছি।

বাড়িওয়ালির অভিযোগ,রোলার চেয়ার আর টেবিল ফ্যান নড়াচড়া করার কারণে নাকি এই দাগ সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বাড়িওয়ালি নিজেই আমাদের রোলার চেয়ার দিয়েছেন,আমরা কোনো আসবাবপত্র কিনি নাই। আর চেয়ার বা টেবিল ফ্যান মূলত নাড়াচাড়া করতো বাড়িওয়ালির বুয়া। এই বুয়াই এসে সপ্তাহে দু'দিন সবকিছু সরিয়ে ঘর পরিষ্কার করে দিত।

ধ্রুব অনেক যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করলো,কিন্তু কোনো কাজ হলো না। ধ্রুব অবাক হয়ে তাকে বললো,"তাই বলে আপনি জামানতের এক হাজার ডলার পুরোটাই রেখে দেবেন!"

বাড়িওয়ালি বললেন,মেঝে সারানোর জন্য নাকি তাকে আরও কিছু ডলার জোড়া দিতে হবে।

ধ্রুব নানাভাবে বাড়িওয়ালিকে বোঝানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছে,কিছুতেই বাড়িওয়ালির মন গলে না। বাড়িওয়ালির এই আচরণ দেখে আমি ভীষণ বিরক্ত হলাম। স্থানীয় এক সাংবাদিকের সাথে কথা বললাম,জামানতের অর্থ উদ্ধারে কি করা যায়?

ওই সাংবাদিক বললেন,"স্মল ক্লেইম ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করেন আপনারা। কোনো উকিল লাগবে না,শুধু প্রমাণগুলো সাথে রাইখেন।"

যাক,একটা উপায় অন্তত পাওয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গেই আমি ধ্রুবকে বললাম,"বাড়িওয়ালির সাথে আর প্যাচাল পেরে কোনো লাভ নাই। আমরা স্মল ক্লেইম ট্রাইব্যুনালে যাব।"

ধ্রুব বাড়িওয়ালিকে বললো,"যদি আপনি জমানত ফেরত না দেন,তবে আমরা চায়না টাউনে স্মল ক্লেইম ট্রাইব্যুনালে যাবো।"

ধ্রুব বাড়িওয়ালিকে স্মল ক্লেইম ট্যাইব্যুনালে যাওয়ার কথা বললো ঠিকই,কিন্তু সে মন থেকে সাহস পায় না। বারবার বলে,"এইসব মামলা-মোকদ্দমায় যাব,পরে আবার কী না কী ঝামেলা হয়ে আমার পিএইচডি’র বারোটা বেজে যাবে।"

আমি ধ্রুবকে বললাম,"এত ভয়ের কী আছে? স্মল ক্লেইম ট্রাইব্যুনালে আমার জামানতের জন্য অভিযোগ করবো,বিচারে যদি জামানত ফেরত না পাই কোনো সমস্যা তো নেই। আদালত তো আর আমাদের কোনও শাস্তি দিচ্ছে না।"

তারপরও ধ্রুবর সংশয় কাটে না। শেষে বললাম,"তোমার গবেষণা পরামর্শকের সাথে কথা বলে দেখ,তিনি কী বলেন।"

অবশেষে ধ্রব তার গবেষণা পরামর্শকের সাথে কথা বলে জানলো,তার আরেক পরামর্শকও নাকি একই সমস্যায় পড়েছিল। পরে ওই পরামর্শক স্মল ক্লেইম ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করে বাসা ভাড়ার জামানত উদ্ধার করেছেন।

ভালো হলো,ধ্রুব ওই পরামর্শক আমাদের বেশ কিছু পরামর্শ দিলেন কীভাবে আদালতে অভিযোগ করতে হবে।

এদিকে স্মল ক্লেইম ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার কথা শুনে বাড়িওয়ালি ধ্রুবকে বললো,সে আমাদের এক হাজার ডলারের মধ্যে মাত্র চারশ' ডলার ফেরত দেবেন।

আমরা তাকে এক হাজার ডলার থেকে আড়াইশ' ডলার দিতে চাইলাম। কারণ ধ্রুব বলছিল,আদালতে যাওয়া-আসায় যে খরচ হয়, তা দিয়ে হলেও ঝামেলা মিটিয়ে ফেলি।

কিন্তু আড়াইশ ডলার নিতে রাজি হলো না বাড়িওয়ালি। অথচ বাসাভাড়ার চুক্তিপত্র অনুযায়ী বাড়িওয়ালি কোনো কিছু নষ্ট হলে,তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেড়শ' ডলারের বেশি রাখতে পারে না। উপরন্তু সে বলে বসলো,জামানত ফিরিয়ে দিতে চাওয়া নাকি ভাড়াটের জন্য বাড়িওয়ালির উপহার।

তো সে যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে,জামানত ফেরত দেবে না, তা নাকি সে করতেই পারে, কোন সমস্যা নেই তাতে!

আমরা আর বাড়িওয়ালির সাথে কথা না বাড়িয়ে চায়না টাউনে স্মল ক্লেইম ট্রাইব্যুনালে গেলাম। মাত্র দশ ডলার ফি দিয়ে অভিযোগ করলাম। কিন্তু সমস্যা হলো, বাড়িওয়ালিকে আদালতের চিঠিটা আমাদেরকেই পাঠাতে হবে। তার ওপর আবার সে যেখানে বসবাস করে,সেই ঠিকানায় আদালতের চিঠি পাঠাতে হবে!

বাড়িওয়ালি কোথায় থাকে আমরা তো জানি না,আমরা কেবল তার বাসায় ভাড়া থেকেছি। বেশ বিপদে পড়ে গেলাম আমরা। পরে একটা উপায় বের হল।

স্মল ক্লেইম ট্রাইব্যুনালের টুলকিটে একটা সরকারি ওয়েবসাইটের ঠিকানা দেওয়া। এই ওয়েবসাইট থেকে তথ্য কিনতে হয়। আমরা বাড়িওয়ালির আইসি নম্বর (পরিচয়পত্রের নম্বর)দিয়ে তার ঠিকানা বের করে আনলাম এবং চিঠিও পাঠালাম।

পাশাপাশি নোভেনায় কর অফিসে গিয়ে বাসা ভাড়ার চুক্তিপত্রের জন্য স্ট্যাম্প ডিউটি দিয়ে আসলাম। স্ট্যাম্প ডিউটি বাসা ভাড়া নেওয়ার সময়ই পরিশোধ করতে হয়,কিন্তু বাড়িওয়ালি এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি আমাদের। ফলে,বিলম্ব ফিসহ পরিশোধ করতে হলো আমাদের। কারণ স্ট্যাম্প ডিউটি না দিলে আদালত আমাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোন ব্যবস্থা নেবে না।

চিঠি পেয়ে বাড়িওয়ালি হাজির হলো আদালতে। একজন রেজিস্ট্রারের সামনে বাদী-বিবাদী হাজির। পরপর দুইবার রেজিস্ট্রার উভয়পক্ষের সাথে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বাড়িওয়ালি জামানত ফেরত দেবে না,উপরন্তু সে আমাদের প্রতিবেশীর কাছ থেকে অভিযোগ লিখে এনে রেজিস্ট্রারের কাছে জমা দিলো।

 আমরা উভয়পক্ষই প্রমাণসহ লিখিত অভিযোগ আদালতে জমা দিলাম। সমাধান হচ্ছে না দেখে রেজিস্ট্রার উভয়পক্ষকে বিচারকের সামনে শুনানীর জন্য আসার তারিখ দিল।

নির্ধারিত দিনে আমরা শুনানীর জন্য আদালতে হাজির হলাম। আদালতের ভেতরে বাদী-বিবাদী আর সাক্ষী ছাড়া আর কেউ যেতে পারে না। আমার সাক্ষ্য দেওয়ার কথা থাকলেও তার আর প্রয়োজন হলো না। আমরা মামলায় জিতে গেলাম। আদালত আমাদের এক হাজার ডলার জামানতের সাথে কোর্ট ফি দশ ডলারসহ মোট এক হাজার দশ ডলার ফিরিয়ে দেওয়ার হুকুম দিল বাড়িওয়ালিকে।

পরে শুনেছি,বিচারক বাড়িওয়ালিকে জিজ্ঞাসা করেছে- বাসা ভাড়া দেওয়ার সময়কার মেঝের কোনো ছবি সে জমা দিয়েছে কি না? বাড়িওয়ালি ওই সময়কার কোনো ছবিই জমা দেয়নি। তাছাড়া বাড়িওয়ালির অভিযোগগুলোও ছিল খুব দুর্বল, যা কিনা বাসা ভাড়ার চুক্তির শর্ত বিরোধী।

অভিযোগগুলোর একটি ছিল তরকারির গন্ধ। বিচারক নাকি বলেছেন যে,পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির লোকজন বাস করলে এমন হবেই। একেকজনের খাবারের ঘ্রাণ একেকরকম হবে। বিচারক নাকি এও বলেছে যে,বছরের মাঝখানে এভাবে বাসা ছাড়তে বাধ্য করাটা অন্যায় হয়েছে বাড়িওয়ালির।

শুনানীর দিনই রায় পেয়ে গেলাম। মাত্র তিন মাসের মধ্যেই বিচার সম্পন্ন হলো। বাড়িওয়ালিকে দুই সপ্তাহ সময় দেওয়া হলো,এর মধ্যে তাকে হয় উচ্চ আদালতে আপিল করতে হবে,অথবা জামানত ফেরত দিতে হবে।

আপিল করার যে ব্যয়, তা আমাদের জামানতকেও ছাড়িয়ে যাবে এবং উপযুক্ত কারণও থাকতে হবে আপিলের জন্য। কাজেই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম,বাড়িওয়ালি আপিল করতে যাবে না। জামানত ফেরত না দিয়েও কোন উপায় নেই তার। আদালত তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে অথবা সে যেখানে চাকরি করে,সেই অফিসকে নির্দেশ দেবে তাকে জামানত পরিশোধ করতে বাধ্য করার জন্য। আদালতে রায় বাস্তবায়নের এমন বেশ কয়েকটি উপায় আছে।

আমি ধ্রুবকে বললাম,"বাড়িওয়ালি একটি স্কুলের শিক্ষক। সে নিশ্চয়ই চাইবে না এসব মামলা-মোকদ্দমার বিষয় তার স্কুল পর্যন্ত যাক!"

অবশেষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বাড়িওয়ালি আমাদেরকে জামানত ফিরিয়ে দিল। সত্যি বলতে কী,শুরুতে আমি আদালতে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। যদিও ধ্রুবকে বুঝতে দেইনি। তবে বারবার মনে হত,এটা সিঙ্গাপুর,এখানকার বিচার ব্যবস্থা খুব ভালো। ভরসার জায়গাটা আসলে সেখান থেকেই তৈরি হয়েছিল।

লেখক: সাংবাদিক

ই মেইল: rokeya.lita@hotmail.com

ছবি কৃতজ্ঞতা: জাকারিয়া রেহমান।

রোকেয়া লিটার আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!