রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্ম, বোধিলাভ এবং তথাগত বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ সাক্ষাৎ এই তিনটি কালজয়ী ঘটনা বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সংঘটিত হয়। তাই বৈশাখী পূর্ণিমার অপর নাম বুদ্ধপূর্ণিমা।
Published : 22 May 2024, 02:01 PM
১.
ত্রিপিটক শাস্ত্রে চার মহাদ্বীপের কথা বলা আছে। উত্তরকুরু, পূর্ব বিদেশ, অপর গোদান ও জম্বুদ্বীপ। এই চার মহাদ্বীপ যথাক্রমে মহামেরুর উত্তরে উত্তরকুরু, পূর্বে পূর্ব বিদেশ, পশ্চিমে অপর গোদান ও দক্ষিণে জম্বুদ্বীপ অবস্থিত। জম্বুদ্বীপ ত্রিকোণ বলে উল্লেখ আছে। বৌদ্ধ সাহিত্যে জম্বুদ্বীপ বলতে ভারতবর্ষকেই বোঝায়। নেপাল প্রদেশের রোহিণী নদীর তীরে অবস্থিত কপিলবস্তু নগরী। শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, বোধিসত্ত্ব অতীতে কোনো এক জন্মে কপিল ঋষি হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি এই নগরীতে একটি আশ্রম নির্মাণ করেছিলেন। কপিল ঋষির নামানুসারেই এই নগরীর নাম কপিলবস্তু। কপিলবস্তুর শাক্যবংশীয়রা ইক্ষাকুবংশীয় বলে পরিচয় দেন। সিদ্ধার্থের পিতৃবংশ অর্থ্যাৎ শাক্যবংশীয়রা কপিলবস্তুতে রাজত্ব করতেন। সিদ্ধার্থের পিতা রাজা শুদ্ধোদন পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। তার অন্যান্য ভ্রাতারা হলেন অমৃতোদন, ধৌতোদন, শুক্লোদন ও ঘটিতোদন। সিদ্ধার্থের মাতা রাণী মহামায়া (মায়াদেবী) ছিলেন রাজা অনুশাক্যের কন্যা। রাজা অনুশাক্য রোহিনী নদীর অপর তীরবর্তী দেবদেহ নামক স্থানে রাজত্ব করতেন। রাণী মহামায়া ইন্দ্রাণীর মতো রূপবতী ছিলেন। তিনি কখনো মাদক স্পর্শ করতেন না, মিথ্যা ভাষণ করতেন না এবং কোনো ক্ষুদ্র প্রাণীরও প্রাণনাশ করতেন না। রাজা শুদ্ধোদন ও রাণী মহামায়া এই দম্পতির দীর্ঘ সাংসারিক জীবনে প্রথমদিকে কোনো সন্তান তখনও জন্মগ্রহণ করেনি। অবশেষে দীর্ঘসময় পর বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে তাদের কোল আলোকিত করে জন্ম নিল এক পারমী পূর্ণ সত্ত্ব। এদিকে দীর্ঘ সময় পরে মনের ইচ্ছা সিদ্ধি লাভ করায় পিতা রাজা শুদ্ধোদন নবজাতকের নাম রাখলেন সিদ্ধার্থ।
২.
বুদ্ধত্ব লাভের জন্য সত্ত্বগণকে কোটি কোটি কল্প ধরে বোধিসত্ত্ব রূপে নানা যোনিতে জন্মগ্রহণ করে পারমী পূর্ণ করতে হয়। অবশেষে পারমী পরিপূর্ণ হলে বোধিসত্ত্ব অভিসম্বুদ্ধ হন। সম্যক সম্বুদ্ধত্ব লাভের পর ধর্মচক্র প্রবর্তন করেন এবং এক সময় মহাপরিনির্বাণ সাক্ষাৎ করেন। জগতে নির্দিষ্টকালের জন্য প্রবর্তিত এই ধর্ম প্রচলিত থাকে; পরে ইহার বিলোপ হয়। তখন নষ্টসত্যের পুনরুদ্ধার করে জগতের পরিত্রাণহেতু নতুন কোনো বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে। বর্তমান মহাভদ্র কল্পের চতুর্থ সম্যক সম্বুদ্ধ গৌতম সম্যক সম্বুদ্ধ এই ধারাবাহিকতার অংশমাত্র। জন্মজন্মান্তরে ত্রিশপ্রকার পারমী পরিপূরণ করে মনুষ্যলোকের শেষ জন্ম রাজা বিশ্বন্তরের দানশীল ও পরমত্যাগী জীবন সম্পন্ন করে তিনি তুষিত স্বর্গে আরোহণ করেন। তুষিত স্বর্গের পরমায়ু অনুযায়ী সেখানে সন্তোষিত দেবপুত্র হয়ে ৫৭ কোটি ৬০ লক্ষ বছর অবস্থান করেন। মূলত, সেখান থেকে চ্যুত হয়েই তিনি রাজা শুদ্ধোদন এবং রাণী মহামায়ার সংসারে জনগ্রহণ করেছিলেন।
তিনি সত্ত্ব হিসেবে বুদ্ধাঙ্কুর (বোধিসত্ত্ব)। সংসারের মায়াজালে আটকে থাকার জন্য তার জন্ম হয়নি। এটা পিতা শুদ্ধোদনও শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি প্রথমবার বুঝতে পেরেছিলেন ঋষি অসিত দেবলের মাথার উপরে নবজাতক শিশু সিদ্ধার্থের পা রাখার ঘটনায়। সিদ্ধার্থের জন্মের ঘটনায় দেবলোকেও আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। বুদ্ধাঙ্কুর সিদ্ধার্থের জন্মের কথা জেনে স্বর্গ থেকে ঋষি অসিত দেবল সিদ্ধার্থকে পুণ্যদর্শন করতে এসেছিলেন। ঋষি অসিত দেবলের মাথার উপরে নবজাতক শিশু সিদ্ধার্থের পা রাখার ঘটনাটি তখন ঘটে যায়। এই দৃশ্য দেখে পিতা শুদ্ধোদন চরমভাবে ঘাবড়ে যান। পরে ঋষি অসিত দেবল স্বয়ং জানালেন মহারাজ আপনার এই সন্তান সাধারণ কেউ নন; তিনি এই জগৎ সংসারের ভাবী সম্যক সম্বুদ্ধ। রাজা শুদ্ধোদন দ্বিতীয়বার আরও একটি ঘটনার সাক্ষী হলেন। একদিন শিশু সিদ্ধার্থ সারাদিন জম্বুবৃক্ষমূলে ধ্যানস্থ হয়ে বসেছিলেন। এদিকে তার কষ্ট হবে বলে ওই বৃক্ষের ছায়া নিশ্চল হয়ে থেকে গিয়েছিল। কি আশ্চর্য! কি অদ্ভুত! পিতা শুদ্ধোদন ভালোকরেই বুঝতে পারলেন, তার নয়নের মণি সিদ্ধার্থ সাধারণ কোনো সত্ত্ব নন। সিদ্ধার্থকে সংসারে রমিত করে রাখতে একজন পিতা হিসেবে এবং একজন রাজা হিসেবে যা যা করার থাকে তারচেয়েও বেশি চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তবুও রাজকুমার সিদ্ধার্থকে সংসারে ধরে রাখা যায়নি। চারিনিমিত্ত দর্শন করে ঊনত্রিশ বছর বয়সে তিনি সংসার পরিত্যাগ করলেন। ছয় বছর কঠোর সাধনা বলে পয়ঁত্রিশ বছর বয়সে অবশেষে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে তিনি গয়ার বোধিদ্রুমমূলে বসে সর্বজ্ঞতা তথা বুদ্ধত্ব লাভ করলেন।
৩.
বুদ্ধত্ব লাভের পর বুদ্ধ সাত সপ্তাহ গয়ার বোধিদ্রুমকে কেন্দ্র করে অতিবাহিত করেন। অবিস্মরণীয় নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে সেখানে বুদ্ধের সাত সপ্তাহ কাটে। এরপর বুদ্ধ নবলব্দ জ্ঞান প্রচারের জন্য সারনাথের উদ্দেশে ধর্মযাত্রা শুরু করলেন। শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধ সারনাথের ঋষিপতন মৃগদাবে বসে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের উপলক্ষ করে জগতে প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন করেন। বুদ্ধ কর্তৃক মধ্যমপন্থার মাহাত্ম বর্ণনা, চারি আর্যসত্যের বিস্তর বর্ণনা, আর্যঅষ্টাঙ্গিক মার্গ সম্বলিত সদ্ধর্ম দেশনা শ্রবণ করে পর্যায়ক্রমে তারা সকলে অর্হৎ মার্গ ফলে প্রতিষ্ঠিত হন। জগতে বুদ্ধের পরে উক্ত পঞ্চবর্গীয় শিষ্যরাই হলেন প্রথম অর্হৎ ভিক্ষুসংঘ। পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদেরকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া বুদ্ধের এই ধর্ম অভিযান চলে দীর্ঘ ৪৫ বছর পর্যন্ত। একদিকে চারি পরিষদ গঠন এবং তাদেরকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার কর্মযজ্ঞ অপরদিকে ধর্মপ্রচার অভিযানের মাধ্যমে সত্ত্বগণকে দুঃখমুক্তির পথ দেখানোর ব্রত বুদ্ধ সমানেই করে গেছেন। অবশেষে আশি বছর বয়সে হিরণ্যবতী নদীর অপরপাড়ে কুশিনগরের উপবর্ত্তনস্থ জোড়া শালবৃক্ষের নিচে নির্বাণশয্যায় শায়িত হলেন। সেদিনও ছিল শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা। বুদ্ধ নামের যে মহাসূর্য শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে উদিত হয়েছিলেন; জগতকে মুক্ত জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে পুণরায় শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে অস্তমিত হলেন।
রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্ম, বোধিলাভ এবং তথাগত বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ সাক্ষাৎ এই তিনটি কালজয়ী ঘটনা বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সংঘটিত হয়। তাই বৈশাখী পূর্ণিমার অপর নাম বুদ্ধপূর্ণিমা। বিশ্বময় বুদ্ধপূর্ণিমা নামটি আজ নন্দিত ও বহুল পরিচিত একটি নাম।
জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে শুভ বুদ্ধপূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। অশান্ত বিশ্বে শান্তি বর্ষিত হোক।