সিঙ্গাপুরের চিঠি: এক নারী দোকানির কাহিনি

সপ্তাহখানেক হলো আমরা নতুন এলাকায় বাসা নিয়েছি। এই এলাকায় প্রচুর বাঙালি রয়েছেন। একদিন সন্ধ্যেবেলা হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বাসার পাশেই একটি বাজারে গেলাম।

রোকেয়া লিটা, সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Sept 2016, 02:54 PM
Updated : 15 Sept 2016, 03:32 PM

সেখানে খাবার, মুদির, সবজিরসহ সবধরনেরই ছোট ছোট দোকান রয়েছে।

দোকানগুলোর সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটি দোকান আমার চোখে আটকালো। কারণ ওই দোকানে পুঁই শাক, লাল শাক, কচুর লতিসহ প্রায় সব ধরনেরই বাংলাদেশি সবজি রয়েছে।

আমি খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার বর ধ্রুবকে বললাম, “দেখলে এই বাজারে সবকিছুই পাওয়া যায়। এখন আর তোমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। আমি নিজেই এসে বাজার করে নিয়ে যেতে পারবো।”

দোকানের ভেতরে আবার চাল-ডাল, ফ্রোজেন মাছ-মাংসসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই রয়েছে।

দোকানের ভেতরে বসে রয়েছেন বোরকা পরা এক নারী। আমি ভাবলাম, তিনি হয়তো মালয়েশিয়ান বা ভারতীয়। আমি গুঁড়া মসলা কেনার জন্য দোকানের ভেতরে ঢুকে দেখছি। হঠাৎ ওই নারীর মুঠোফোনে একটা কল আসলো। তিনি কল রিসিভ করেই বাংলায় কথা বলা শুরু করলেন।

ফোনে কথা বলা শেষ হলে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি বাংলাদেশি কি না! উত্তরে ভদ্রমহিলা জানালেন, তার বাড়ি গাজীপুরে। কথাটা শুনে খুশিতে আবারও আমার মনটা ভরে উঠলো।

আগের এলাকায় সারাদিনেও কথা বলার মত একজন মানুষ পেতাম না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাজার করতে আসলেই কথা বলার জন্য একজন মানুষ পাবো।

এরপর থেকে নিয়মিতই আমি ওই দোকানে যেতে শুরু করলাম। কথাসূত্রে, তার ব্যবসা নিয়ে লিখতে চাইলে ভদ্রমহিলা বাংলাদেশের সামাজিক কারণ দেখিয়ে নিজের পুরো পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে অনুমতি দিলেন।  বললেন, প্রয়োজনে ছদ্মনাম হিসেবে ‘কান্তা’ নামটি ব্যবহার করতে।

দুপুর পর্যন্ত দোকান বন্ধই রাখেন কান্তা। বিকেল ৪ টার দিকে তিনি বিক্রি-বাট্টা নিয়ে বসেন।

সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি নারীর মালিকানাধীন দোকান

আমি প্রায়ই গিয়ে পাশের রেস্তোরাঁ থেকে চা কিনে নিয়ে কান্তার দোকানে বসি আর গল্প করি। দোকানে গিয়ে বসলেই আরো অনেক বাংলাদেশির দেখা পাই যারা এ এলাকাতেই থাকেন।

ধীরে ধীরে কান্তার দোকানটাই আমার কাছে হয়ে উঠলো এক খণ্ড বাংলাদেশ।

গল্পে গল্পে জানতে পারলাম, প্রায় এক যুগ আগে স্বামীর হাত ধরে সিঙ্গাপুরে আসেন কান্তা। প্রথমদিকে প্রায় আট বছর ঘরকন্না নিয়েই ছিলেন তিনি। এরইমধ্যে হয়ে ওঠেন চার সন্তানের জননী।

সংসারে মানুষ বেড়েছে, তাই খরচও বাড়তে লাগলো। তখনই প্রথম ব্যবসা করার কথা ভাবেন কান্তা। বাংলাদেশ থেকে তার মা সিঙ্গাপুরে বেড়াতে আসলে, সন্তানদের নিজের মায়ের কাছে রেখে ব্যবসায় নেমে পড়েন তিনি।

স্ত্রীর সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে কান্তার স্বামীও শিপইয়ার্ডের কাজ ছেড়ে এই ব্যবসায় নেমে পড়েন। ভিন্ন একটা এলাকায় রয়েছে তারও দোকান।

শুরুতে এখনকার দোকানের পাশেই থাকা আরেকটি দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন কান্তা। ধীরে ধীরে ব্যবসায় লাভ বাড়তে থাকলে এই দোকানটি কিনে ফেলেন তিনি।

তার দোকানে বর্তমানে মালয়েশিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আসছে শাকসবজি, মাছ-মাংসসহ অন্যান্য উপাদান। দোকানে রেখেছেন একজন কর্মচারীও। সেই সাথে বাসায় ছেলেমেয়েদের দেখাশোনার জন্য রেখেছেন একজন ইন্দোনেশিয়ান পরিচারিকা। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বাসায় একজন গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থাও করেছেন তিনি।

কী বুঝলেন? স্বামী, সংসার, সন্তান সবদিক সামাল দিয়ে ঠিকঠাক মত ব্যবসা করছেন কান্তা। অথচ এই কান্তাই কিন্তু আর দশজন সাধারণ বাংলাদেশি নারীর মতই ছিলেন বাংলাদেশে।

আমি কান্তার কাছে জানতে চাইলাম, “বাংলাদেশে থাকলে পারতেন এভাবে ব্যবসা করতে?”। উত্তরে কান্তা বললেন, “প্রশ্নই ওঠে না”। তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। দেশে থাকতে কলেজ আর বাসা, এই ছিলো তার গণ্ডি। কখনও প্রয়োজনীয় কিছু দরকার হলে, ভাইরাই তা এনে দিতেন। সেই কান্তা এখন দেশের সীমানা পার হয়ে বিদেশে এসে ব্যবসা করছেন।  এর পেছনে মূল কারণটা কী?

উত্তরে কান্তা জানালেন, স্বামীর সহযোগিতা তো ছিলোই। পাশাপাশি সিঙ্গাপুরের পরিবেশটা বেশ নারীবান্ধব। দোকান বন্ধ করে রাত ১০টা-১১টার দিকে একা একাই বাসায় যাচ্ছেন, কেউ কোন ধরনের বিরক্ত করেনা। আর এতোদিন ধরে সিঙ্গাপুরের দোকান চালাচ্ছেন , চাঁদাবাজি কী জিনিস কোনোদিন টেরই পাননি তিনি।

মাঝে মাঝে এমন সময় যায়, যখন প্রতিদিনই কান্তার দোকানে পাঁচ থেকে ছয় হাজার ডলার পর্যন্ত বিক্রি । এতগুলো ডলার নিয়ে একা একা বাসায় গিয়েছেন বহুবার, কখনও কোনো ছিনতাইকারীর কবলে পড়তে হয়নি তাকে।

আমি এসব কথা শুনি আর ভাবি, বাংলাদেশে কত শিক্ষিত মেয়েরা ঘরে বসে আছে দিন কাটাচ্ছে।  

কোনো কিছু করতে পারে না বলে, তাদের সারাজীবনই পরনির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়। কে চায় পরনির্ভরশীল থাকতে! কিন্তু উপায় থাকে না বলেই তারা স্বামীর উপার্জনের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

সিঙ্গাপুরে এসে বুঝতে পারছি, উপযুক্ত পরিবেশ আর সহযোগিতা পেলে সব মেয়েই হয়ে উঠতে পারে কান্তার মত আত্মনির্ভরশীল।

লেখক, সাংবাদিক

rokeya.lita@hotmail.com