'লিটল ইন্ডিয়া'র মতই সিঙ্গাপুরের আরেকটি জায়গা 'চায়না টাউন'। 'লিটল ইন্ডিয়া'য় গেলে যেমন আপনার মনে হবে সিঙ্গাপুরের বুকে একখণ্ড ভারত, তেমনি চায়না টাউনে গেলে মনে হবে সিঙ্গাপুরের বুকে একখণ্ড চীন।
চায়না টাউনে খুব তাড়াতাড়িই কাজটা শেষ হয়ে গেল। ধ্রুব'র পিএইচডি শেষের পথে, এখন সে আগের চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। তবে, আমি জানি, আজ আর সে অফিসে যাবে না। আমি এই সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না।
বললাম, “এতো তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে কী করবে? তারচে' বরং চলো ‘গার্ডেনস বাই দ্য বে’ থেকে ঘুরে আসি”।সে আর দ্বিমত করলো না।
আমরা এমআরটি বা মেট্রো রেল-এ করে 'বে ফ্রন্ট' স্টেশনে এসে নামলাম। স্টেশনে নেমেই অভিভূত হলাম। এই স্টেশনটি অন্যান্য স্টেশনগুলোর মত নয়। স্টেশনের চারদিকে সুদৃশ্য গ্লাস বসিয়ে একটি অন্য রকমের আবেদন তৈরি করা হয়েছে।
আগেই বলেছি যে, সিঙ্গাপুরের এমআরটি স্টেশনগুলো এমন পরিকল্পনা মাফিক তৈরি করা হয়েছে যে, স্টেশন থেকে বের হলেই সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এখানেও তাই। মাটির নিচে এমআরটি স্টেশন, লিফটে করে উপরে উঠে বের হলেই 'গার্ডেনস বাই দ্য বে'।
'গার্ডেনস বাই দ্য বে' সিঙ্গাপুরে দর্শনার্থীদের জন্য অন্যতম দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় একটি বিনোদন কেন্দ্র। অনেকগুলো বাগান মিলিয়ে বানানো একটি বিশালাকার বাগান।
মেরিনা বে'র কোল ঘেঁষে ২৫০ একর এলাকা জুড়ে তৈরি করা হয়েছে এই বাগান। এই বাগানের নকশা তৈরির জন্য ২০০৬ সালে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
বিশ্বের ২৪টি দেশের ১৭০টি নকশা অংশ নেয় এই প্রতিযোগিতায়। ব্রিটিশ দুই প্রতিষ্ঠান এই বাগানের নকশা তৈরির প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়।
প্রায় তিন থেকে চার বছরের মধ্যেই এই বাগানের কিছু কিছু অংশ তৈরি হয়ে যায় এবং দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয়।
যাই হোক, আমরা এমআরটি স্টেশন থেকে বের হয়ে 'গার্ডেনস বাই দ্য বে'তে ঢুকেই উচ্ছ্বসিত হলাম। চারপাশটা এতো পরিপাটি যে বলে বোঝানো যাবে না।
২৫০ একর ! মানে, বিশাল আয়তনের বাগান, এ বিশাল আয়তনের বাগান পায়ে হেঁটে পুরোটা দেখা মুশকিল।
ধ্রুবকে বললাম, সন্ধ্যার আগে বাসায় যাবো না। সারাদিন এখানে ঘুরবো, ক্লান্ত লাগলে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়বো, আর যখন সন্ধ্যা হবে চারদিকের আলোকসজ্জায় গা ভাসিয়ে, তবেই বাসায় ফিরবো।
শাটল বাসটা এসে থামলো 'ফ্লাওয়ার ডোম' আর 'ক্লাউড ফরেস্ট'র কাছে। এই দুটি জায়গায় যেতে হলে টিকেট কাটতে হবে, আর টিকেটের দাম বেশ চড়া।
আমরা ভেতরে গেলাম না, কারণ বাইরে থেকেই দেখা দেখা যাচ্ছে অনেক কিছু। ফ্লাওয়ার ডোম-এ হরেক রকমের ফুল আর বানানো ফড়িং, প্রজাপতি আর 'ক্লাউড' ফরেস্ট হলো কৃত্রিম পাহাড়ি ঝরনা। আমি ধ্রুবকে বললাম, যে বান্দরবানের নীলগিরিতে গেছে, তার আর এত অর্থ ব্যয় করে ক্লাউড ফরেস্টে যাওয়ার দরকার নেই।
তিনি সম্ভবত দামের ব্যাপারে আমাদের চেহারা দেখে নেতিবাচক অভিব্যক্তি বুঝেছিলেন। জানিয়ে দিলেন যে, কোথায় ম্যাকডোনাল্ডস পাওয়া যাবে। বিষয়টা ভীষণ ভালো লাগলো।
সামনের একটা রাস্তা অনেকগুলো ক্রিসমাস ট্রি দিয়ে সাজানো। বুঝলাম, ক্রিসমাস এসে গেছে প্রায়, তাই এই ব্যবস্থা। এই রাস্তা ধরে সামনে যেতেই ম্যাকডোনাল্ডস পেয়ে গেলাম।
খেয়েদেয়ে সামনে এগুতেই দেখি বিশাল একটা ক্যাকটাসের বাগান। অবশ্য তার আগেই রয়েছে একটি বিশাল অ্যাকোয়ারিয়াম।
এমন সময় এক বিদেশি মহিলা দর্শনার্থী এসে বললো, ছবি তোলার জন্য তার সাহায্য লাগবে কি না! আমি খুশি হয়ে ফোনটা তার হাতে দিলাম।
তিনি আমাদের ছবি তুলে দিলে, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে তার ছবি তোলার জন্য সাহায্য লাগবে কি না?
তিনি প্রথমে 'না' বলে, পরে আবার মন বদলে ছবি তুলে দিতে বললেন। আমি খুশি মনে তার কয়েকটা ছবি তুলে দিয়ে, 'ধন্যবাদ' বলে বিদায় নিলাম।
ক্যাকটাসের বাগানে গিয়ে বিশাল বিশাল একেকটা কাটাওয়ালা ক্যাকটাস দেখে আমরা বেশ মজা করলাম। এরপর একটা জায়গায় গেলাম যেখানে অনেকগুলো পাথরের স্থাপত্যের মাঝে উঁচু একটা চাইনিজ টটেম রাখা আছে।
চাইনিজ টটেম হলো- পাথরের ওপর খোদাই করা 'স্তম্ভ', যা সচরাচর চাইনিজ স্থাপত্যশিল্পে দেখা যায়। আরও অনেক কিছুই দেখলাম, শিশুদের জন্য চমৎকার একটি বাগান আছে যেখানে শিশুরা খেলা করছে আর পানিতে ভিজছে।
হাঁটতে হাঁটতে সামনে গিয়ে দেখি একটা বিশাল জঙ্গল। নাম না জানা সব গাছগাছালি।
সচরাচর আমরা যা খাই, তার সবই রয়েছে এখানে। আমার খুব ভালো লাগলো জায়গাটা। গাছগাছালি, সবুজ আর সবুজ, মাঝখানে আমার পছন্দের খাবারের দোকানগুলো।
সামনে রেখে চেয়ারগুলোতে আবার পাখিরা সারি বেধে বসে আছে। পাখিগুলো উড়ছে, কিচির-মিচির করছে, বাইরের কোন কোলাহল এখানে আসছে না। আমরা ছুটির দিনগুলোতে সকালবেলা বাইরেই নাস্তা করি।
মনে মনে ভাবলাম, ইস! আমাদের বাসার পাশেই যদি এমন একটা খাবার জায়গা পেতাম! মনে হচ্ছিল, 'এ যেন একটা বাগানের ভেতর নান্দনিকতায় ভরা কোনও শহর!'
'গার্ডেনস বাই দ্য বে' থেকে বেরিয়ে এসে ট্রেনে উঠলাম। বাসায় যেতে যেতে ভাবছিলাম, সুষ্ঠু পরিকল্পনা আর অর্থ থাকলে কত কিছুই না করা সম্ভব।
বাংলাদেশের চেয়ে মাত্র ছয় বছর আগে স্বাধীন হয়েছে সিঙ্গাপুর, অথচ কত উন্নতি করে ফেলেছে তারা। নদী বা সমুদ্রের জন্য খুব বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই আমাদের।
উন্নত দেশগুলোতে নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এক ভিন্ন ধরনের সভ্যতা। লন্ডন শহরে গিয়ে দেখেন টেমস নদীর চারপাশটা এমন চমৎকার করে বাধাই করা হয়েছে, সেটিই হয়ে উঠেছে দর্শনীয় স্থান।
অথচ আমাদের ঢাকায় চারটা বিশালাকার নদী থাকার পরও সেখানে যাওয়ার উপায় নেই। বুড়িগঙ্গার পানি এতো দূষিত যে, দুর্গন্ধের কারণে তার ধারে কাছে যাওয়ার উপায় নেই।
শুনতে পাচ্ছি, সরকার ঢাকার নদীগুলোর সু-ব্যবস্থাপনার কাজ হাতে নিয়েছে। আশা করছি, ভবিষ্যতে ঢাকার এই নদীগুলোই ঢাকার মানুষের বিনোদনের জন্য সবচেয়ে আকর্ষনীয় স্থান হয়ে উঠবে।
রোকেয়া লিটা
সাংবাদিক
ছবি তুলেছেন জাকারিয়া রেহমান