আমার বর আমাকে নিয়ে যেতে চাইলো সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে।
কিন্তু আমি বললাম, আমি একজন নারী ডাক্তারের কাছে যেতে চাই।
সিদ্ধান্ত নিলাম, কে কে উইমেন’স অ্যান্ড চিলড্রেন’স হাসপাতালে যাবো।
হাসপাতালে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার সময়ই জিজ্ঞেস করা হলো, আমি নারী ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে চাই নাকি পুরুষ ডাক্তারের কাছে। একজন নারী চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়ার পর নির্ধারিত দিনে চলে গেলাম হাসপাতালে।
ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার পর মোবাইল ফোনে দুই দফা মেসেজের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয় কবে, কত নম্বর ফ্লোরে, কোনখানে ডাক্তার দেখাতে যেতে হবে। কাজেই ঠিকানা মোতাবেক আমরা জায়গা মতো পৌঁছে গেলাম।
হাসপাতালে গিয়ে আমি বেশ অভিভূত হলাম। শুধু নামে উইমেন’স হসপিটাল নয়, হাসপাতালে ঢোকার পর রিসেপশন থেকে চিকিৎসক, কোথাও কোনো পুরুষ দেখতে পেলাম না। সবখানে কাজ করছে নারীরাই।
ডাক্তার দেখানোর পর আমাকে কয়েকটি পরীক্ষা করাতে বলা হলো। পরীক্ষা করাতে গিয়েও দেখি সবগুলো ল্যাবেই কাজ করছে নারীরা।
কে কে উইমেন’স অ্যান্ড চিলড্রেন’স হাসপাতাল হচ্ছে সিঙ্গাপুরে নারী ও শিশুর জন্য বিশেষায়িত সবচেয়ে বড় হাসপাতাল। বলা হয়, জন্মসূত্রে সিঙ্গাপুরের নাগরিকদের একটা বড় অংশের জন্ম এই কে কে উইমেন’স অ্যান্ড চিলড্রেন’স হাসপাতালে।
হাসপাতালের পরিবেশ ভীষণ মনোরম। রোগীরা যেখানে অপেক্ষা করছে,সেখানে রয়েছে বিনামূল্যে চা-কফিসহ বিভিন্ন ধরনের পানীয়। এছাড়া রিসেপশনগুলিতে রোগীদের সামনে রাখা আছে ফলমূল।
হাসপাতালের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে খাবার দোকান। ম্যাকডোনাল্ডস থেকে শুরু করে সব ধরনের খাবার দোকান রয়েছে সেখানে। গর্ভবতী মা ও শিশুদের নিয়ে এই হাসপাতালে এলে খাওয়া নিয়ে কোনো চিন্তাই করতে হবে না।
হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় স্তন ক্যানসারসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সচেতনা বিষয়ক পোস্টার টাঙ্গানো রয়েছে। সবচেয়ে দরকারি বিষয় হলো, নারী ও শিশুর সব ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে এই হাসপাতালে। আর এসবের দেখাশোনা করছে মেয়েরাই। কোনো রকমের অস্বস্তি নেই রোগী এবং সেবাদানকারীদের মধ্যে।
অবাক হয়ে ভাবছিলাম,বাংলাদেশে নারীদের জন্য আলাদা কোনো হাসপাতাল নেই। যেসব সরকারি হাসপাতাল আছে সেগুলোর অবস্থা এতোটাই বাজে যে একজন নারী রোগীর গোপনীয়তা রক্ষারও প্রয়োজন মনে করে না সেবাদানকারীরা।
তাদের কোনো রাখঢাকও নেই! একজন নারী রোগীর ইসিজি করবে,তার জন্য যে একটা পর্দা বা গোপনীয়তার ব্যাপার থাকবে, সেসব কোনো কিছুই নেই। ওই নার্স ইসিজি করার জন্য একগাদা লোকের সামনে আমার শরীর থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলতে চাইলেন!
আশেপাশে তাকিয়ে দেখি, একগাদা অচেনা লোকজন চারপাশে তাকিয়ে আছে ! আমি নার্সকে বাধা দিলে তিনি আমার ওপর চড়াও হলেন! এই হচ্ছে বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে নারী রোগীদের অবস্থা !
আরও একটি উদাহরণ দেই। আমি তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। আমার এক বান্ধবী বেশ কিছুদিন ধরে বলছিলো, সে তার স্তনে ব্যথা অনুভব করছে।
সেই বান্ধবীকে নিয়ে একদিন একটা সরকারি হাসপাতালে গেলাম। রিসেপশনে একজন পুরুষ জানতে চাইলেন, কোন ডাক্তারের কাছে যাবো আমরা?
নিজের সমস্যা বলতে লজ্জা পাচ্ছিলো আমার বান্ধবী। ফলে কোনো কিছু না ভেবে বলে দিলো, সার্জারি ডাক্তারের কাছে যাবো। ডাক্তারের কাছে গিয়ে দেখি পুরুষ ডাক্তার।
ডাক্তার রোগীর সমস্যার কথা শুনে বললেন, "আসলে না দেখে ওষুধ দেয়া তো ঠিক নয়। কিন্তু আপনার বান্ধবী যে পরিমাণ লাজুক,তাতে করে আমি তার কথার উপর ভিত্তি করেই কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি।"
আমরা জানতাম, এটা সঠিক ছিল না।
এসব তো সাধারণ চিকিৎসা। ধর্ষণের দুই আঙুল পরীক্ষার কথাই ধরুন। শুনেছি সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের দুই আঙুল নারীর যৌনাঙ্গে প্রবেশ করিয়ে (টু ফিঙ্গার টেস্ট) পরীক্ষা করা হয়, মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছে নাকি হয়নি!কে জানে কেমন পরিবেশে এসব পরীক্ষা করানো হয়!
হয়তো একটি নারী হাসপাতালই এসব সমস্যার মহৌষধ নয়। তবে এসব সমস্যা সমাধানে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে শুরুতে রাজধানীতে একটি পূর্ণাঙ্গ নারী হাসপাতাল গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে নিঃসন্দেহে মেয়েরা চিকিৎসা নিতে এসে অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো। শুধু হাসপাতাল বানালেই হবে না, হাসপাতালের কর্মীদেরও নারীবান্ধব হতে হবে।
দেশের অবকাঠামোগত নানা রকম উন্নয়ন হলেও, চিকিৎসাক্ষেত্রে খুব একটা উন্নয়ন দেখতে পাচ্ছি না। আর সেখানে নারীদের চিকিৎসা তো খুবই অবহেলিত একটি বিষয়। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, সেদেশে একটি নারী হাসপাতাল নেই ! এটি নিঃসন্দেহে একটি লজ্জার বিষয়।
লেখক: সাংবাদিক,rokeya.lita@hotmail.com
ছবি তুলেছেন জাকারিয়া রেহমান