সিঙ্গাপুরের চিঠি: মেয়েদের পোশাক ও ব্যর্থ ‘পাকা কলা’ তত্ত্ব

একটি হাফ প্যান্ট, একটি টি-শার্ট আর এক জোড়া চপ্পল। নিশ্চয়ই ভাবছেন, আমি ছেলেদের পোশাক পরিচ্ছদের কথা বলছি, তাই না?

রোকেয়া লিটা, সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Sept 2016, 01:32 PM
Updated : 22 Sept 2016, 01:42 PM

না, আসলে বলছিলাম সিঙ্গাপুরের মেয়েদের কথা, যাদের একটি বড় অংশ এভাবেই চলাফেরা করে ঘরের বাইরে।

ওদের দেখাদেখি আমিও কিছুদিন আগে বাজার থেকে একটা হাফ-প্যান্ট কিনে আনলাম। এখন আমি প্রায়ই তাদের মেয়েদের মত হাফ-প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে চলাফেরা করি। ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া তো দূরের কথা, আজ পর্যন্ত কেউ একটা কটু কথাও বলেনি।

আমি যখন আমার বাংলাদেশি বন্ধুদের কাছে এসব কথা বলি, ওরা বলে এসব দেশে নাকি এমনিতেই মেয়েরা ছেলেদের সাথে ঢলাঢলি করে, এজন্যই নাকি পুরুষরা মেয়েদের বিরক্ত করে না।

আমি মনে মনে হাসি আর বলি, বন্ধু আপনার পাসপোর্ট আছে তো? জীবনে কয়বার দেশের বাইরে গিয়েছেন? পুরোনো একটি প্রবাদ মনে পড়ে যায়, অদেখা দেখে বেশি আর অবলা বলে বেশি। আমার বাংলাদেশি বন্ধুদের কথা শুনে তেমনই মনে হয়, যে আজ পর্যন্ত একবারের জন্যেও দেশের বাইরে যায়নি, সেও ধরে নিয়েছ বিদেশে না চাইতেই মেয়েরা এসে ছেলেদের সঙ্গ দেয়।

এখানকার পরিস্থিতি আসলে একেবারেই উল্টো। বরং আমি বলবো, সিঙ্গাপুরের মেয়েরা বাংলাদেশি মেয়েদের চাইতে বেশি লাজুক স্বভাবের। বাংলাদেশে মেয়েরা গণপরিবহনে পুরুষের পাশে বসতে আজকাল আর তেমন একটা আপত্তি করে না। হরহামেশাই তারা পুরুষের পাশে বসে চলাফেরা করছে। অথচ আমি এখানকার বাসে বা ট্রেনে প্রায়ই দেখি, বেশিভাগ মেয়েই অপরিচিত কোনো পুরুষের পাশে বসতে চায় না। প্রয়োজনে তারা দাঁড়িয়ে থাকে।

সিঙ্গাপুরের মেয়েদের সাধারণ পোশাক

সিঙ্গাপুরের
মেয়েরাও
অনেক
সংসারী।
তারাও
রান্না
করে,
সন্তান
জন্ম
দেয়,
ধর্ম
কর্ম
পালন
করে,
আবার
চাকরিও
করে।

এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য যে আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে, তা বাংলাদেশের মত নয়। বাংলাদেশে যেমন ছেলেদের জন্য আলাদা হোস্টেল আবার মেয়েদের আলাদা হোস্টেল রয়েছে, এখানে কিন্তু তেমনটি নয়। এখানে ছেলে-মেয়েরা একই হোস্টেলে ভিন্ন ভিন্ন রুমে বাস করছে। এমনকি হোস্টেলের বাইরেও ছেলে-মেয়েরা সাবলেটে বাসা শেয়ার করে থাকছে।

দেখা গেলো, একটা বাসায় দুটো রুমে মেয়েরা থাকছে আর বাকি দুটো রুমে থাকছে ছেলেরা। কেউ কাউকে চেনেও না। একেকজন এসেছে একেক দেশ থেকে। দিনের পর দিন মেয়েরা অপরিচিত পুরুষদের পাশাপাশি নিরাপদে বাস করছে, কই কোনো যৌন হয়রানির ঘটনা তো শুনি না কখনও।

এখন হয়তো অনেকেই ভাবছেন, সত্যিই তো সিঙ্গাপুরের পুরুষরা তো দেখছি সাধু! দয়া করে, এমনটি ভাবতে যাবেন না। পৃথিবীর সব দেশেই ধর্ষক রয়েছে। তেমনি সিঙ্গাপুরেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, তবে খুবই কম। কারণ, এখানকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এতোটাই কড়া যে ধর্ষণ বা কোনো যৌন হয়রানি করে কেউ পার পায় না।

দুদিন আগের ঘটনাই বলি। বাসা থেকে বের হয়েছি বাজারে যাবো ভেবে। হঠাৎ করে এমন জোরে বৃষ্টি এলো যে আমি আর নিচতলা থেকে বের হয়ে রাস্তায় যেতে পারছিলাম না। নিচেই অবশ্য বসার জায়গা রয়েছে এবং এটি বেশ খোলামেলা।

সিঙ্গাপুরের মেয়েদের পোশাকে লেখক

আমাদের
দেশে
বহুতল
ভবনের
নিচতলায়
যেভাবে
গাড়ি
পার্কিং
এর
জন্য
জায়গা
রাখা
হয়,
এটিও
তেমনই
একটি
খোলামেলা
বিশাল
জায়গা,
তবে
এর
চারপাশে
কোনো
দেয়াল
নেই।
অবাধে
যে
কেউ
এখানে
আসতে
পারে,
বসতেও
পারে।
আমি
বেশ
কিছুটা
সময়
বসে
থাকার
পর
খেয়াল
করলাম,
এক
লোক
আমার
পাশে
দিয়ে
ঘোরাফেরা
করছে।
যেহেতু
বৃষ্টি
পড়ছিল,
মানুষজনও
কম
সেখানে।
লোকটা
আমার
দিকে
কয়েকবার
তাকিয়ে,
আমার
পাশে
দিয়ে
হেঁটে
চলে
গেলো।
মনে
হলো,
সে
আমাকে
কিছু
বলতে
চাইছে,
কিন্তু
সাহস
করে
আর
কিছু
বলতে
পারলো
না।
কারণ,
প্রতিটি
ভবনের
নিচেই
রয়েছে
সিসি
ক্যামেরা।
আর
বাংলাদেশের
মত
ধর্ষণের
বিচার
পেতেও
এখানে
আঠারো
বছর
সময়
লাগে
না।

বাংলাদেশে একটি বড় অংশের মানুষের মধ্যে দেখেছি যখন কোনো যুক্তিতেই ধর্ষকদের পক্ষে সমর্থন আদায় করতে পারেন না, তখন প্রায়ই একটা উপমা ব্যবহার করে থাকেন, বিশেষ করে মেয়েদের যখন পর্দা করে চলতে বলা হয়।

উপমাটি হলো, “কলার খোসা ছিলে রাখলেই মাছি পড়ে”। তার মানে ধর্ষক বা উত্ত্যক্তকারীদের ভাবা হচ্ছে মাছি।

তা ঠিকই আছে বটে, এরা মানুষ নয়! মশা, মাছি, কীটপতঙ্গের সাথেই এদের তুলনা হওয়া উচিৎ। কিন্তু মেয়েদের ‘কলা’ ভাবা হচ্ছে, সেখানেই আমার আপত্তি। দুদিন আগেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই উপমাটি একজন আমাকে শুনিয়েছিলেন।

এই জাতীয় উপমা যারা দিয়ে থাকেন, তারাও মানুষ নয়, কীটপতঙ্গ। মেয়েরা গাছের পাকা কলা নয়, মেয়েরা মানুষ। মানুষ হয়ে জন্মেছেন মানুষের মত করে ভাবুন, তা না পারলে এক হালি কলা কিনে এনে সংসার করুন। ভুলেও মেয়েদের দিকে তাকাবেন না।

লেখক, সাংবাদিক

rokeya.lita@hotmail.com