সিঙ্গাপুরের চিঠি: রান্নার গন্ধ ও বাড়িওয়ালির গল্প

আমাদের আগের বাসাটা বেশ সুন্দর ছিল। ভাড়া বেশি হলেও কন্ডোমোনিয়াম (বড় দালান) থাকার সুবিধা হল, এসব বাসার সাথে জিম এবং সুইমিং পুল থাকে।

রোকেয়া লিটা, সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Dec 2016, 01:15 PM
Updated : 28 Dec 2016, 02:13 PM

সব মিলিয়ে আগের বাসাতে ভালই ছিলাম। হঠাৎ একদিন, বাড়িওয়ালি বললেন বাসা ছেড়ে দিতে হবে।  আমাদের বিরুদ্ধে বাড়িওয়ালির অনেক অভিযোগ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অভিযোগটি ছিল, আমাদের তরকারির ঘ্রাণ নাকি খুব ঝাঁঝালো আর বাজে!

তরকারির ঘ্রাণের কারণে  নাকি আমাদের প্রতিবেশীরা বাড়িওয়ালির কাছে অভিযোগ করেছেন- তাদের জামা-কাপড়েও নাকি আমাদের তরকারির ঘ্রাণ চলে যায়। তো বাড়িওয়ালি আমার বর ধ্রুবকে বলেছিল, আমরা যেন তরকারির রেসিপি পরিবর্তন করি।

ধ্রুব সাফ জানিয়ে দিয়েছে, “আমাদের প্রতিবেশির খাবারেও কড়া ঘ্রাণ আছে, ভদ্রতার খাতিরে আমরা বলি না আমাদের কেমন লাগে। কারণ, আমরা জাতি বৈচিত্র্যে বিশ্বাস করি। একেক দেশের মানুষের খাবারের ঘ্রাণ একেক রকম হবে এটাই স্বাভাবিক।

এসব ক্ষেত্রে, সাংস্কৃতিক সহনীয়তাই হচ্ছে চারপাশের মানুষদের নিয়ে ভেজালহীন জীবনের মূলমন্ত্র। যাই হোক, এই জাতীয় একাধিক অভিযোগ জড়ো করে বাড়িওয়ালি আমাদের বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা যেন বাসা ছেড়ে দেই। প্রয়োজনে সে আমাদের জামানতও ফেরত দিবে।

ধ্রব সেসময় ফ্রান্সে যাবে কয়েদিনের জন্য, লেখাপড়া নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। হঠাৎ বাসা ছাড়তে বলায় আমরা বেশ বিপদে পড়ে গেলাম। বাড়িওয়ালিকে আমাদের সমস্যার কথা বলেও মন গলাতে পারলাম না। সে তার সিদ্ধান্তে অটল, আমাদের বাসা ছাড়তেই হবে। বিষয়টা আমার খুব আত্মসম্মানে লাগলো।

সেটা ছিল গত আগস্টের ৮ তারিখ। ধ্রব বাড়িওয়ালিকে বোঝানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছে। আমি ধ্রুবকে বললাম, অনেক হয়েছে, আমি আর এই বাসায় থাকবো না। তুমি নতুন বাসা দেখ। রাতেই বাসাভাড়ার ওয়েবসাইটগুলো দেখে বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপন থেকে ফোন নম্বর ও ঠিকানার নোট নিয়ে রাখলাম।

সারারাত আমরা দুজন ঘুমাতেই পারলাম না। সকাল ঘুম থেকে উঠে, ওই বিজ্ঞাপনগুলোতে দেওয়া ফোন নম্বরে ফোন করলাম। তার মধ্যে একটি বাসার ঠিকানা দেখলাম, আমরা যে ভবনে থাকি তার কয়েক তলা উপরে।

আমরা ফোন করেই দেখি ওই বাড়িওয়ালা বাংলাদেশি। তিনি বললেন যে, তার বাসা ফাঁকা, আমরা যেকোনো সময় উঠতে পারবো। তবে শর্ত হলো, কুরবানির ঈদে বাংলাদেশ থেকে তার কিছু আত্মীয়-স্বজন আসবেন, তখন সপ্তাহ খানেকের জন্য আমাদেরকে বাড়িওয়ালার অন্য একটি বাসায় গিয়ে থাকতে হবে।

তার অর্থ হলো সপ্তাহ খানেকের জন্য আমাদের থাকার জায়গাটি বাড়িওয়ালার আত্মীয়-স্বজনদের ছেড়ে দিতে হবে। বিষয়টা ভীষণ আপত্তিকর, কিন্তু যেহেতু আমরা বিপদে পড়েছি, তাই বাধ্য হয়ে মেনে নিলাম।

মোটামুটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা বাড়িওয়ালিকে জানিয়ে দিলাম যে, আমরা বাসা ছেড়ে দেব। সে যদি আমাদের জামানত ও পূর্ব-পরিশোধিত বাসা ভাড়া দিয়ে দেয়, তবে পরদিনই বাসা ছেড়ে দেব।

এইবার বাড়িওয়ালি তার ভিন্ন রুপ দেখালো। সে বলল যে, “বাসা ছাড়ো সমস্যা নেই, তবে জামানত এখন দিতে পারবো না, জামানত ফেরত দিতে একমাস সময় লাগবে”। জামানত না দিলে আমরা নতুন বাসায় উঠবো কীভাবে!  কারণ, সেখানেও তো জামানত দিতে হবে।

তখন বাড়িওয়ালি আমাদের বললো, “আমি তোমাদের আরও একবার এই বাসায় থাকার সুযোগ দিয়ে একটা ঝুঁকি নিতে চাই। আমি আশা করবো, তোমরা আমার মহানুভবতার সুযোগ নিবে না”।

মুশকিল হলো, আমরা নতুন বাসা ঠিক করে ফেলেছি এবং সেখানে বাড়িওয়ালাকে কথা দিয়েছি যে তার বাসায় উঠবো আমরা।

অতএব, তাকে দেওয়া কথা আমরা হঠাৎ করে তুলে নিতে পারি না। তার ওপর আবার এই বাড়িওয়ালির কথা শুনে মনে হলো, না জানি সে আমাদের বিনা পয়সায় আশ্রয় দিয়ে মহানুভবতা দেখাতে চাইছে।

তার কথা শুনে হাসিও পাচ্ছিলো, রাগও লাগছিল। কিন্তু ধ্রুব যতটা সম্ভব নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে বাড়িওয়ালিকে জানালো, “আসলে যা কিছু হচ্ছে এখানে, তাতে আমরা নিজেরাও অনিরাপদ বোধ করছি। আপনার প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ। আমরা বরং পহেলা সেপ্টেম্বর বাসা ছেড়ে দিবো।

"আপনি নতুন ভাড়াটে পেলেই, আমাদের জামানত ফেরত দিয়েন। তাতে করে আপনারও কোন ক্ষতি হবে না, আমাদেরও সমস্যা নেই।"

ধ্রুবর এই প্রস্তাব মেনে নিলো বাড়িওয়ালী। এরপর সে নতুন ভাড়াটে আনার জন্য পর পর দুদিন বাসাও দেখালো। সবকিছুই ঠিক ছিল, কিন্তু হঠাৎ একদিন আমাদের হবু বাংলাদেশি বাড়িওয়ালা আমাদেরকে তাদের বাসায় ডাকলেন। বাসায় যাওয়ার পর তিনি জানালেন যে, হঠাৎ করে তিনি তার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছেন। তিনি বাসা ভাড়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এই বাংলাদেশি বাড়িওয়ালার কাছে আমরা আমাদের সমস্যার কথা খুলে বলেছিলাম। তিনি জানতেন যে, আমরা এরই মধ্যে বাসা ছাড়ার নোটিসও দিয়ে দিয়েছি আমাদের বাড়িওয়ালিকে। আমরা আশা করেছিলাম, একজন বাংলাদেশি আরেকজন বাংলাদেশির বিপদে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু, তা আর হলো কই?

আমরা চরম অনিশ্চয়তায় পড়লাম। একদিকে বাসা ছাড়ার নোটিস দিয়েছি, অন্যদিকে বাসা ছেড়ে কোথায় উঠবো, তার কোন ব্যবস্থা নেই।

আমরা আবার বাসা ভাড়ার ওয়েবসাইটে বাসা খোঁজা শুরু করলাম। যেটাই একটু পছন্দ হয়, ফোন করেই শুনি ভাড়া হয়ে গেছে। কিছু কিছু বাসার আবার ভাড়া অনেক বেশি যা আমাদের সাধ্যেরও বাইরে। কিছু কিছু বাসায় আবার রান্না করে খাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

সিঙ্গাপুরে এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেক বাড়িওয়ালাই ঘর ভাড়া দেন, কিন্তু ভাড়াটেদের বাসায় রান্না করে খাওয়ার অনুমতি দেন না। এটা হয়তো এখানকার সংস্কৃতির কারণেই।

এখানে মানুষজন বাসায় রান্না করে কম, বাইরে খায় বেশিভাগ সময়। একারণেই কি না জানি না, অনেক বাসা ভাড়ার বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, বাড়িওয়ালারা উল্লেখ করে দেন, “নো ইন্ডিয়ানস” অথবা অন্য কোনো দেশের মানুষের কথা যাদেরকে ওই বাসা ভাড়া দেওয়া হবে না। আর হ্যাঁ, এখানে কিন্তু ইন্ডিয়ান আর বাংলাদেশিদের একই দৃষ্টিতে দেখা হয়।

আমাদের বাসার সঙ্কট কেটে গেলো, ধ্রবর সহকর্মী অ্যাডওয়ার্ড সহযোগিতা করলো। সে একটা বাসার সন্ধান দিলো, বাসাটা ধ্রুবর অত পছন্দ হলো না। কিন্তু বাড়িওয়ালি অ্যাডওয়ার্ড এর পরিচিত, তাই সে আমাদের কাছ থেকে নামমাত্র কিছু টাকা জামানত নিয়ে বাসা ভাড়ার চুক্তিপত্র তৈরি করে ফেললেন।

নতুন বাসায় ওঠার তিন দিন আগে, হবু বাড়িওয়ালি তার বাসায় যেতে বলেছিলেন আমাদের, বাসার চাবি আনতে। সেদিন বেশ হাস্যকর একটা কাণ্ড ঘটে গেল।

বিকেল পাঁচটায় বাসা থেকে বের হলাম আমরা। সূর্য খানিকটা হেলে পড়েছে, কিন্তু গরম একটুও কম নয়। বেশ খানিকটা পথ আমরা হেঁটে হেঁটেই পৌঁছে গেলাম, কিন্তু গরমে ঘেমে গেলাম প্রায়। বাড়িওয়ালির বাসায় যাওয়ার পর উনি গেইট খুলে দিয়ে ভেতরে গেলেন। আমরাও নিজেদের জুতা খুলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম বাসার ভেতরে যাওয়ার। এমন সময় উনি ফিরে এসে দরজায় দাঁড়ালেন এবং চাবিগুলো আমাদের হাতে বুঝিয়ে দিলেন।

আমরা হাসিমুখে চাবিগুলো বুঝে নিয়ে আবার জুতোগুলো পায়ে দিলাম। এরপর আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রয়োজনীয় কিছু আলাপ সেরে বিদায় নিলাম আমরা। আমি লিফট দিয়ে নামতে নামতে ধ্রুবকে বলছিলাম, "আমি তো ভাবলাম মহিলা বলবেন ভেতরে আসেন, বসেন, একটু ঠাণ্ডা হয়ে নেন"।

ধ্রুব হাসতে হাসতে বলে, " হ্যাঁ, এরপর তোমাকে চা-কফি খেতে বলবেন, তাই না! এইটা কি বাংলাদেশ পাইছো?"

আসলেই তাই, পায়ের নিচে মাটি অথবা মাথার ওপর আকাশ কিন্তু কখনই সীমানা নির্ধারণ করে দেয় না। মানুষের আচার-আচরণই বলে দেয়, আপনি বিদেশে আছেন।

অগাস্টের ৩১ তারিখে আমরা নতুন বাসায় উঠলাম। পুরোনো বাসা ছাড়ার আগে ওই বাড়িওয়ালিকে বলেছিলাম, সে যেন এসে দেখে যায় তার আসবাবপত্র সব ঠিকঠাক আছে কি না! কিন্তু সে আসলো না বা কাউকে পাঠালোও না। শুধু বললো, “ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বরটা মেসেজ করো, জামানতের টাকা ট্রান্সফার করবো”।

পরে অবশ্য আগের বাড়িওয়ালির সঙ্গে বিষয়টা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। সেই সব টানটান উত্তেজনাপূর্ণ কাহিনি লিখবো আমার পরবর্তী চিঠিতে। সে পর্যন্ত সুস্থ থাকুন সবাই। 

লেখক: সাংবাদিক

ই মেইল: rokeya.lita@hotmail.com

ছবি কৃতজ্ঞতা: জাকারিয়া রেহমান।

রোকেয়া লিটার আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,  দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!