বিএনপির এ দুই নেতাকে রিমান্ডে নেওয়ার কোনো আবেদন ছিল না।
Published : 09 Dec 2022, 04:42 PM
বিএনপি সমাবেশের জন্য গোলাপবাগ মাঠ ব্যবহারের অনুমতি পেলেও জামিন পাননি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস।
নয়া পল্টন সংঘর্ষের মামলায় জামিন আবেদন নাকচ করে শুক্রবার বিকালে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন ঢাকার মহানগর হাকিম মোহাম্মদ জসিম।
বিএনপির এ দুই নেতাকে রিমান্ডে নেওয়ার কোনো আবেদন ছিল না। সে কারণে তাদের এজলাসে হাজির না করে হাজতখানায় রেখেই শুনানি হয়।
ফখরুল ও আব্বাসের পক্ষের জামিন শুনানি করেন আইনজীবী মাসুদ আহম্মেদ তালুকদার, জয়নুল আবেদীন, মহসিন মিয়া, খোরশেদ আলম মিয়া, বোরহান উদ্দিন, ওমর ফারুক ফারুকীসহ আরও কয়েকজন।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি আব্দুল্লাহ আবু, এপিপি আজাদ রহমান, এপিপি তাপস পাল জামিনের বিরোধিতা করে আসামিদের কারাগারে পাঠানোর আবেদন করেন।
মির্জা ফখরুলের স্ত্রী রাহাত আরা বেগম, মেয়ে সাফারুহ মির্জা এবং মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসও শুনানি চলাকালে উপস্থিত ছিলেন।
শুনানি শেষে বিচারক জামিন নাকচ করে ফখরুল ও আব্বাসকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। তখন মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসের জন্য কারাগারে ডিভিশন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা চেয়ে আবেদন করেন তাদের আইনজীবীরা।
শুনানি শেষে কারাবিধি অনুযায়ী তাদের ডিভিশন দেওয়ার নির্দেশ দেন হাকিম। এর ফলে কারাগারে প্রথম শ্রেণির বন্দির মর্যাদা পাবেন সাবেক বিএনপি সরকারের এ দুই মন্ত্রী। পাশাপাশি তারা কারাবিধি অনুযায়ী চিকিৎসাসেবাপাবেন ।
পল্টনের ঘটনায় পুলিশের ৪ মামলায় যত অভিযোগ
নয়া পল্টনে সংঘর্ষ: ২৩ জন রিমান্ডে, কারাগারে ৪৫১
১০ ডিসেম্বর: কথার খেলা গড়াল সহিংসতায়
নয়া পল্টনে পুলিশ বাধ্য হয়ে বুলেট ছুড়েছে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
কী অভিযোগ
বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ ঘিরে গত কিছুদিন ধরেই উত্তেজনা চলছে দেশের রাজনীতিতে। নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এই সমাবেশ করতে চেয়েছিল বিএনপি। কিন্তু পুলিশ তাদের অনুমতি দিয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ব্যবহারের। এ নিয়ে অনড় অবস্থানে ছিল দুই পক্ষ।
এর মধ্যে গত বুধবার বিএনপি কর্মীরা নয়া পল্টনে জড়ো হলে পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের মধ্যে আহত স্বেচ্ছাসেবক দলের এক ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতার মৃত্যু হয় হাসপাতালে।
এরপর বিএনপি অফিসে অভিযান চালিয়ে হাতবোমা পাওয়ার কথা বলা হয় পুলিশের তরফ থেকে। গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় পাঁচশ নেতাকর্মীকে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল তারপরও বলে আসছিলেন, ১০ ডিসেম্বর তাদের সমাবেশ ‘হবে’। তবে বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশের সঙ্গে ‘সমঝোতা বৈঠকের’ পর অবস্থান বদলের ঘোষণা আসে।
রাতের সেই বৈঠকের পর ভোর হওয়ার আগেই মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। দীর্ঘ সময় তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ দুপুরে তাদের গ্রেপ্তার করার কথা জানান।
সংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নয়া পল্টনে সংঘর্ষের ঘটনায় পল্টন থানায় যে মামলা হয়েছে, সেই মামলায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
“তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটা হল, তারা পুলিশের ওপর বর্বোরিচত হামলায়, ককটেল নিক্ষেপের উসকানিদাতা, পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা এটা পেয়েছি।”
বুধবারের সংঘর্ষের ঘটনায় এ পর্যন্ত মোট চারটি মামলা করেছে পিুলিশ। এর মধ্যে পল্টন থানার মামলায় ৪৭০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও দেড় থেকে দুই হাজার লোককে সেখানে আসামি করা হয়েছে। তবে ওই ৪৭০ জনের মধ্যে ফখরুল বা আব্বাসের নাম নেই।
এজাহারে বলা হয়, ১০ ডিসেম্বরের দলীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা বুধবার নয়া পল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এ সময় পুলিশ তাদের উঠে যেতে বললে তারা পুলিশের উপর হামলা চালায়।
একই সময় বিএনপি নেতাকর্মীরা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে জানিয়ে এজাহারে বলা হয়, তাতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। একপর্যায়ে পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানো গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
বিস্ফোরণ, জনসাধারণ ও যানবাহনে চলাচলে বাধা, যানবাহনের ক্ষতি সাধন, জনমনে আতঙ্ক ও ত্রাস সৃষ্টি, পুলিশের কাজে বাধা ও হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে মামলা এজাহারে।
আসামিদের মধ্যে ১৪ জনকে বৃহস্পতিবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত।
বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী, আবদুস ছালাম, শহিদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, খাইরুল কবীর খোকন, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, সেলিম রেজা হাবিবসহ ৪৩৪ জনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারক।
শুক্রবার মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকেও এ মামলায় গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হল।
১০ ডিসেম্বর: সংঘাত গড়িয়ে সমঝোতার ইঙ্গিত
১০ ডিসেম্বর সমাবেশের জন্য বিএনপি এখন চাইছে কমলাপুর স্টেডিয়াম
শুনানিতে যা হল
বিকেল ৪টা ১০ মিনিটের দিকে মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে ঢাকার সিএমএম আদালতে নিয়ে আসে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। মহানগর হাকিম মোহাম্মদ জসিমের আদালতে তাদের জামিন শুনানি হয়।
তার পক্ষে জামিন চেয়ে আইনজীবী মাসুদ আহম্মেদ তালুকদার বলেন, “মীর্জা ফখরুল একটি প্রতিষ্ঠান, একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ, অধ্যাপনা পেশা ছিল, ছোটবেলা থেকেই গণমানুষের সঙ্গে আছেন, তিনি সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী ছিলেন। আর মির্জা আব্বাস সাবেক মেয়য়, সাবেক এমপি, সাবেক মন্ত্রী। আজ সারা দেশকে আদালতে টেনে নিয়ে আসা হয়েছে।
“এজাহারে অঙ্গ সংগঠনরে নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। উনারাতো বিএনপির মূল দলের নেতা। তাদের নাম এজাহারে নেই। যাদের নাম এজাহারে এসছে তাদের মধ্যে দুইজনকে গতকাল বিজ্ঞ আদারত জামিন দিয়েছেন।”
মাসুদ আহম্মেদ তালুকদার বলেন, “বোমার কথা ককটেলের কথা বলা হচ্ছে, সেটার বিষয়ে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে যে ধারা দেওয়া হয়েছে, তা প্রযোজ্য নয়। বোমার সঙ্গে মির্জা ফখরুল বা আব্বাসের কি সম্পর্ক রয়েছে? আর তাদের সম্পৃক্ততা নেই বলেই রিমান্ড চাওয়া হয়নি। তারাতো পালিয়ে যাবেন না। তাদের সারা বিশ্ব চেনে। সুতরাং তাদের জামিন দেওয়া হোক ।”
এ আইনজীবী বলেন, “তারা বয়স্ক, তাদের নানা রকম অসুখ রয়েছে। তা ছাড়া তাদের গোপন করার কিছু ছিল না। পুলিশের সঙ্গে সবসময়ই তারা কথা বলেছেন। তাদের দৃষ্টিসীমার বাইরেও তারা ছিলেন না। সহ আসামির শর্তেও তারা জামিন পেতে পারেন।”
এর বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবুদুল্লাহ আবু বক্তব্য দেন।
শুনানি শুরুর আগে আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল শুরু হলে বিচারক নথি পর্যালোচনা করে খাস কামরায় বসে আদেশ দেওয়ার কথা বলেন। পরে আওয়ামীপন্থি এবং বিএনপিপন্থী দুই পক্ষের আইনজীবীরা হট্টগোল না করার প্রতিশ্রুতি দিলে আদালত এজলাসে বসে রায় দিতে রাজি হন।
আদালত জামিন নাকচ করে দুই আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিলে সন্ধ্যায় তাদের কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যায় পুলিশ।
নয়া পল্টনে সংঘর্ষ: উসকানির অভিযোগে গ্রেপ্তার ফখরুল ও আব্বাস
আদালত প্রাঙ্গণে উত্তাপ
বিকালে গোয়েন্দা পুলিশের একটি গাড়িতে করে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। তার আগে থেকেই বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের স্লোগানে উত্তাপ ছড়ায় আদালত প্রাঙ্গণে।
‘পুলিশের এক কর্মকর্তা আইনজীবীদের আদালত প্রাঙ্গণ ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন’– এমন অভিযোগ তুলে সিএমএম আদালতের পুরনো ভবনের প্রাঙ্গণে অবস্থান নেন বিক্ষোভরত আইনজীবীরা।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি বোরহান উদ্দিন বলেন, “কোতোয়ালি থানার একজন পরিদর্শক আইনজীবীদের আদালত প্রাঙ্গণ ছেড়ে চলে যেতে বলেন। তখন তারা যাননি। চলে যেতে বলায় আইনজীবীরা এখন অবস্থান করছেন এবং স্লোগান দিচ্ছেন।”
বিক্ষোভরত বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসের মুক্তির দাবিতেও স্লোগান দিতে থাকেন।
এর মধ্যেই পাশের জনসন রোডে আওয়ামী লীগের মিছিল শুরু হলে আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের সতর্কতা বাড়ে।
শুনানি শেষে দুই বিএনপি নেতার জামিন আবেদন নাকচ হয়ে গেলে আবারও বিক্ষোভ হয় আদালত প্রাঙ্গণে। বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা এ সময় সরকারকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেন।