নয়া পল্টনে সংঘর্ষ: ২৩ জন রিমান্ডে, কারাগারে ৪৫১

জামিন পেয়েছেন কেবল আমানউল্লাহ আমান ও আব্দুল কাদের ভূইয়া জুয়েল।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Dec 2022, 01:57 PM
Updated : 8 Dec 2022, 01:57 PM

ঢাকার নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় দুই মামলায় বিএনপির ২৩ নেতাকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত।

পল্টন ও মতিঝিল থানার এ দুই মামলায় গ্রেপ্তার ৪৭০ নেতাকর্মীর মধ্যে ৪৪৫ জনকে পাঠানো হয়েছে কারাগারে। আর শাহজাহানপুর থানার মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে আরও ছয়জনকে।

পল্টন থানার মামলায় কারাগারে যাওয়াদের মধ্যে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস ছালাম, প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, যুগ্ম মহাসচিব খাইরুল কবীর খোকন, চেয়ারপারসেন বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসও আছেন।

জামিন পেয়েছেন কেবল বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের ভূইয়া জুয়েল।

ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পুলিশের রিমান্ড এবং আসামিদের জামিন আবেদনের শুনানি করে এ আদেশ দেন। 

আগামী ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ ঘিরে উত্তেজনার মধ্যে বিএনপিকর্মীরা বুধবার নয়াপল্টনে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় সামনে জড়ো হলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে।

পরে বিএনপির কার্যালয়ে ঢুকে তল্লাশি চালিয়ে কয়েকশ নেতা-কর্মীকে আটক করে পুলিশ। বৃহস্পতিবার পল্টন, মতিঝিল, শাজাহানপুর ও রমনা থানায় দুই হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চারটি মামলা করা হয়।

গ্রেপ্তার আসামিদের এদিন সকালেই প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে নিয়ে আসা হয়। সকাল থেকেই আদালত প্রাঙ্গণে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়। গ্রেপ্তার আসামিদের স্বজনরাও উপস্থিত হয়েছিলেন আদালতে।

বিএনপিপন্থি কয়েকশ আইনজীবী এ সময় আদালত প্রাঙ্গণে জড়ো হয়ে তাদের দলের নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। কয়েকঘণ্টা পর আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরাও জড়ো হন সেখানে। সে সময় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়।

পল্টন

পল্টন থানার মামলায় ‘পুলিশের ওপর হামলা ও বেআইনি সমাবেশ’ এর অভিযোগ করা হয়েছে, আসামি করা হয়েছে ৪৭০ জনকে। 

তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার ৪৫০ আসামিকে এদিন আদালতে হাজির করা হয়। ১৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। বাকিদের কারাগারে আটক রাখার আবেদন করা হয়।

আসামিদের পক্ষে আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও মাসুদ আহমেদ তালুকদার রিমান্ডের বিরোধিতা করে জামিনের আবেদন করেন।  

শুনানি শেষে বিচারক ১৪ জনকে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেন। এরা হলেন: বিএনপির সহ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক (ফরিদপুর বিভাগ) সেলিমুজ্জামান সেলিম, কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য এ কে এম আমিনুল ইসলাম, ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাক, রমনা থানা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওয়াকিল আহম্মদ, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান শরিফ ও এসএম মাহমুদুল হাসান রনি; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাঈদ ইকবাল মাহমুদ, ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের সদস্য সচিব আল আমিন ও বাংলা কলেজ ছাত্রদলের শুভ ফরাজী, শরীয়তপুরের বিএনপি নেতা শাহাজাদ, নরসিংদীর সজিব ভূইয়া ও গাজীপুরের সারোয়ার হোসেন শেখ।

আর বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম রেজা হাবিবকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারক।

পাশাপাশি বিএনপি নেতা রিজভী, ছালাম, এ্যানি, খোকন, শিমুল বিশ্বাসসহ মোট ৪৩৪ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়। 

এ মামলার আসামিদের মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের ভূইয়া জুয়েলের জামিন মঞ্জুর করেন বিচারক।

মতিঝিল

মতিঝিল থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় ২৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও অনেককে আসামি করা হয়েছে।

তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার ২০ জনকে এদিন আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশের সাত দনের রিমান্ড আবেদনের শুনানি করে বিচারক নয় আসামিকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাজাসাবাদের অনুমতি দেন। বাকি ১১ জনকে পাঠানো হয় কারাগারে।

রিমান্ডের নয়জন হলেন: জামিল হোসাইন, হারুনুর রশীদ, রিয়াদ আহমেদ, রবিউল ইমরান, জাহাঙ্গীর আলম সেন্টু, মোস্তাক মিয়া, মাহাবুব মিয়া, খোরশেদ আলম সোহেল ও সোহাগ মোল্লা।

শাহজাহানপুর

এ থানার মামলায় মোট ৫২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ মামলায় দুই থেকে আড়াইশজনকে অজ্ঞাত হিসাবে আসামি করা হয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম আইনজীবী আজাদ রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শাহজাহানপুর থানার মামলার ৬ আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো রিমান্ড আবেদন ছিল না।”

শুনানিতে যা হল
এজলাসে   দুই  পক্ষের  আইনজীবীদের  দুই  ঘণ্টা অপেক্ষার পর  পল্টন ও মতিঝিল থানার রিমান্ডে চাওয়া আসামিদের এজলাসে তোলা হয়। অতিরিক্ষ মুখ্য মহানগর হাকিম পুরানো ভবনের দ্বিতীয় তলায় ওই এজলাসে তখন তিল ধারণের জায়গা ছিল না। রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ মিলিয়ে তিন শতাধিক আইনজীবী এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

রিমান্ড আবেদনের উল্লেখযোগ্য অংশ পড়ে শোনান আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তারা। এ সময় বিচারকের আসনের পেছনে ডায়াসে প্রায় ১৫ জন পুলিশ এবং আদালতের ৬/৭ জন কমর্চারীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। পরে আসামিপক্ষের আপত্তিতে সরে যান পুলিশ সদস্যরা।


শুনানিতে আসামিদের আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, “শুধু গায়েবী মামলা নয়, গায়েবী বাদীও রয়েছে। গায়েবী লোকজন বাদী
হয়ে এখন মামলা করছে। চাল ডাল মজুদের কথা বলা হয়েছে। এটা পুলিশের বানানো কথা। আর মজুদ করলেও তা অন্যায় বা অপরাধ নয়।

“আলামতের কথা বলা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে বিস্ফোরক, ইটের ভাঙ্গা টুকরো, লাঠির কথা। মাননীয় আদালত জানেন যে এ সব আসামির অনেকে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ছিলেন। তারা বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা।”

শুনানির এক পযার্য়ে এ আইনজীবী বলেন, “দ্রব্যমূল্যে মানুষ এখন দিশেহারা। চাল, ডাল নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ভীষণ রকম বেড়ে গেছে।” তার এ কথায় আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরা হৈ চৈ করে ওঠেন।

মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, যাদের রিমান্ডে চাওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে কয়েকজন নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন– এমন  আইনজীবীও রয়েছেন।

আসামিদের আরেক আইনজীবী  জয়নুল আবেদীন বলেন, “আমার নিজের জুনিয়র আইনজীবী সালাউদ্দিন হিমেল রয়েছেন, আইনজীবী রয়েছেন আরো কয়েকজন।”

রিমান্ড কোন ঘটনায় চাওয়া যায়, সে বিষয়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা তুলে ধরেন জয়নুল।

আইনজীবী মোসলেহ উদ্দিন জসীম, ওমর ফারুক ফারুকীও এ সময় আসামিদের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন।

রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি আবদুল্লাহ আবু আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তির বিরোধিতা করে রিমান্ড ও অবশিষ্ট আসামিদের কারাগারে পাঠানোর জন্য আবেদন জানান। শুনানি শেষে বিচারক আদেশ দেন।

আরও দুই মামলা

এ দুটি মামলার বাইরে শাজাহানপুর থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলায় ৫২ জনের নাম উল্লেখ করে ২০০ থেকে ২৫০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি দেখানো হয়েছে।

আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা এস আই শাহ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ মামলায় ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালতে কাগজপত্রও নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু এ মামলায় আসামিদের এজলাসে তোলা বা শুনানির জন্য কাউকে দেখা যায়নি।”

এছাড়া পুলিশের কাজে বাধা ও হামলা এবং যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টির অভিযোগে রমনা মডেল থানায় করা মামলায় ১৬৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও অনেককে আসামি করা হয়েছে।

এ মামলায় মোট পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদেরও রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। তবে শুনানি হয়নি।