Published : 08 Dec 2022, 12:41 AM
গত কয়েক বছর দেশে রাজনীতির মাঠ শান্তই ছিল, জাতীয় নির্বাচনের এক বছর আগে এক কর্মসূচি ঘিরে উত্তাপ ছড়াচ্ছে সেই অঙ্গনে।
ঢাকায় বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সেই সমাবেশ ঘিরে এতদিন পুলিশ, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কথার লড়াই চলে আসছিল, বুধবার বিকালে তা সহিংসতায় রূপ পেয়েছে।
নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সেই সংঘর্ষে এক যুবক নিহত হয়েছেন। তিনি বিএনপি সমর্থক ছিলেন বলে তার স্বজনের কাছ থেকে জানা গেছে।
সংঘর্ষের পর বিএনপির কার্যালয়ে ঢুকে তল্লাশি চালায় পুলিশ। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার সেই অভিযানে সেই কার্যালয় থেকে তিনশর মতো নেতা-কর্মীকে আটক করে পুলিশ।
আটক নেতাদের মধ্যে দলটির কেন্দ্রীয় নেতা আমানউল্লাহ আমান, রুহুল কবীর রিজভী, ফজলুল হক মিলন, শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস রয়েছেন।
কার্যালয়ে ঢুকে পুলিশের এমন অভিযানকে ‘জঘন্য’ বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি দাবি করেছেন, পুলিশ অভিযানের পরিকল্পনা নিয়েই এসেছিল।
তবে পুলিশ সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলছে, বিএনপির কার্যালয় থেকে হাতবোমা ছুড়ে মারায় পুলিশ বাধ্য হয়ে অভিযান চালায়।
পুলিশের এই অভিযানের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সারাদেশে বিক্ষোভের কর্মসূচি দিয়েছে দলটি।
এদিকে বিএনপি শনিবার নয়া পল্টনে তাদের বিভাগীয় সমাবেশ করতে চাইলেও বুধবার ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক কড়া ভাষায় বলেছেন, সড়কে কোনোভাবেই সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না, বিএনপিকে সমাবেশ করতে চাইলে কোনো মাঠে যেতে হবে।
দেশের রাজনীতিতে অশান্তির এই আঁচ লেগেছে বিদেশিদের আচরণেও। যুক্তরাজ্যের পর যুক্তরাষ্ট্রও ১০ ডিসেম্বর ঘিরে তার দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে চলাফেরায় সতর্ক করেছে।
এর একটি প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে লোক প্রশাসনের শিক্ষক ও জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজকে যা ঘটল, এমন পরিস্থিতি খুবই ন্যক্কারজনক। কোনো অবস্থায় এটাকে গঠনমূলক ইভেন্ট হিসেবে চিত্রিত করার সুযোগ নেই। দুটো রাঙা চোখ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে, যে কোনো সময় পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।”
সহিংসতায় উদ্বেগ জানানোর আগে বাংলাদেশে ১৪ দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিশন যৌথ এক বিবৃতিতে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সেই বিবৃতি আসার এক দিন পরই রাজনৈতিক সহিংসতায় একজন নিহতের ঘটনাটি ধরে অধ্যাপক কলিমুল্লাহ বলেন, “আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসকে সামনে রেখে রাষ্ট্রদূতদের এ বিবৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অংশগ্রহণমূলক ভোটের পথে তাদের কথাগুলো তুলে ধরেছে।
“১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের প্রাক্কালে এভাবে প্রাণ সংহারের ঘটনা আরেকটা পেরেক ঠুকে দেবে এ অনভিপ্রেত পরিস্থিতির ঘটনায়। এটা ডেফিনিটলি রাজনীতির মাঠ অশান্ত করবে।”
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে মানুষের মন থেকে শঙ্কা দূর করতে ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্বই বেশি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“শাসক দলের দায়-দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। যেহেতু তারা স্টিয়ারিং হুইল ধরে আছেন। যারা মাঠের রাজনীতি করেন, আগে সরকারে ছিল বিএনপি ও তার মিত্ররা দায়িত্বপূর্ণভাবে জনস্বার্থে কাজ করতে হবে। সহিংসতাকে নতুন করে উস্কে দেবে না আশা করি।”
দেশের রাজনীতির পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “আমাদের এ রাজনীতির ধারা হচ্ছে বুর্জোয়া ধারা। তারা যে রাজনীতিটা করছে, তাদের ভেতরকার ক্ষমতা দখল ও দ্বন্দ্বের ভুক্তভোগী হচ্ছে জনসাধারণ। এ খেলাতে জনসাধারণের কোনো অংশগ্রহণ নেই।”
চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে রাজনীতিতে এমন সহিংসতা এড়াতে পারস্পরের প্রতি সহনশীল হওয়ার উপর জোর দেন তিনি।
“এটা একটা সঙ্কট তো বটেই। আমরা একটা রাজনৈতিক শঙ্কার মধ্যে রয়েছি, দেশবাসী উদ্বিগ্ন। বুর্জোয়া রাজনীতির পরিবর্তে সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতি দরকার ছিল। এ বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না।”
“আমরা বলবোই যে সমঝোতা হওয়া দরকার, পারস্পরিক সহনশীলতা দরকার। তবে এসব বলাই হবে; কিন্তু কার্যকর হবে না,” কিছুটা হতাশার সুর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কণ্ঠে।
১০ ডিসেম্বর: বিএনপি অনমনীয়, সরকারও কঠোর
স্পষ্ট কথা, রাস্তায় সমাবেশ করতে দেব না: ডিএমপি কমিশনার
বিএনপি কার্যালয়ে পুলিশের অভিযানকে ‘জঘন্য’ বললেন ফখরুল
বিএনপি অফিসে অভিযানে পুলিশ বাধ্য হয়েছে: যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব
বিএনপি অফিস থেকে প্রিজন ভ্যানের মিছিল
সহিংসতায় উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্রের, ঢাকায় নাগরিকদের জন্য সতর্কতা
অস্থিরতার কেন্দ্রে এক সমাবেশ
নির্দলীয় সরকারের দাবি জানিয়ে আসা বিএনপি গত অক্টোবর থেকে বিভাগে বিভাগে সমাবেশ করার পর ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশের কর্মসূচি দেয়।
ঢাকায় সমাবেশ নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে করতে পুলিশের অনুমতি চায় দলটি। তবে সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে বলার পর শুরু হয় টানাপড়েন।
এর মধ্যে গত রোববার বিএনপি নেতারা ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করার পর বরফ গলার ইঙ্গিত মিলেছিল। কিন্তু সোমবার পুলিশ কঠোর অবস্থান নেয়। বিএনপিও নয়া পল্টনে অনমনীয় থাকার কথা জানায়।
সমাবেশ কেন্দ্র করে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে সরগরম ছিল কয়েকদিন ধরে; তাদের সঙ্গে বুধবার বিকালে বাঁধে পুলিশের সংঘর্ষ।
বিকালে তারা যখন বিএনপি কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন, তারই এক পর্যায়ে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে নয়া পল্টন এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফকিরাপুল থেকে নাইটিঙ্গেল মোড় পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তদের মধ্যে মকবুল নামে ৩২ বছর বয়সী একজনকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
বিএনপির কার্যালয়ের সামনে পুলিশ সদস্যদের অবস্থান মঙ্গলবার থেকেই ছিল। বুধবার বিশেষায়িত বাহিনী সোয়াট সদস্যদেরও দেখা যায় নয়া পল্টনে।
পুলিশ দাবি করেছে, বিএনপির কার্যালয় থেকে তাদের উপর হাতবোমা ছোড়া হয়েছিল বলে ‘বাধ্য হয়ে’ অভিযান চালাতে হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেছেন, বিএনপি কার্যালয় থেকে পুলিশকে লক্ষ করে বোমা ছোড়া হয়েছিল। এরপরই পুলিশ কার্যালয়ের ভেতরে অভিযান চালায়।
তল্লাশি চালিয়ে ওই কার্যালয়ের ভেতর থেকে ১৫টি হাতবোমা পাওয়ার দাবি করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুণ অর রশিদ। তিনি বলেন, পরে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল এসে তিন দফায় তা ফুটিয়ে নিষ্ক্রিয় করে।
এদিকে পুলিশের অভিযানের সময় বাধার মুখে কার্যালয়ে ঢুকতে না পারা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উল্টো পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, “বেলা ৩টার দিকে পুলিশ রবার বুলেট দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে আমাদের অফিস আক্রমণ চালায়। আর এরপরে আমি যখন এখানে এসে প্রবেশ করতে চাই, আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আমাকে আটকিয়ে রাখা হয়।”
ফখরুল বলেন, “প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী যৌথভাবে এই অভিযান চালিয়েছে। তারা সবচেয়ে হীন কাজটা করেছে যে, তারা নিজেরা এখানে ব্যাগে করে কিছু কিছু বিস্ফোরক নিয়ে এসেছে এবং সেটা ভেতরে রেখে, আমরা যেটা খবর পেয়েছি, তারা এখন বিএনপির উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে আরকি।”
বিএনপির নেতা-কর্মীরা নয়া পল্টনে স্থায়ী অবস্থানের পরিকল্পনা নিয়েছিল বলে দাবি করেন পুলিশ কর্মকর্তা হারুণ, যেকথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল বলে আসছিলেন।
অতিরিক্ত কমিশনার হারুণ বলেন, তারা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে একটি কভার্ডভ্যান থেকে ১৬০ বস্তা চাল উদ্ধার করেন, যা বিএনপি কার্যালয়ে নেওয়ার জন্য আনা হয়েছিল। এছাড়া কার্যালয়ের ভেতরে প্রায় পৌনে ৩ লাখ পানির বোতল পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, “১০ ডিসেম্বর সমাবেশকে কেন্দ্র করে তারা এসব মজুদ করেছিল। সমাবেশকে সামনে রেখে তারা আজই বিএনপি অফিসের সামনে বসে পড়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল এবং বসে পড়েছিল।”
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এর আগে বলেছিলেন, নয়া পল্টনে অবস্থানের কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। ১০ ডিসেম্বর সমাবেশের পর বিএনপির নেতা-কর্মীরা বাড়ি ফিরে যাবেন।
পুলিশি অভিযানের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সারাদেশে বিক্ষোভের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। তবে সর্বশেষ এই কর্মসূচি দেওয়ার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শনিবারের সমাবেশের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
এদিকে বুধবার নয়া পল্টনে বিএনপি কার্যালয়ে অভিযানের মধ্যে দলটিকে কঠোর বার্তা দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
তিনি বলেছেন, “আমাদের কথা সুস্পষ্ট, তারা রাস্তায় সমাবেশ করতে পারবে না। খোলা মাঠে তাদের সমাবেশ করতে হবে। আর তা না হলে আইনানুগভাবে যতখানি কঠোর হওয়া যায় ততখানি হবে পুলিশ।”