রোজায় যেসব পণ্যের চাহিদা লাফিয়ে বাড়তে দেখা যায়, সেগুলোর বাজার শান্ত রাখাটা সবসময়ই বড় চ্যালেঞ্জ। তাতে ভোজ্যতেল অবশ্যই পড়ে। রোজার আগ দিয়ে এর বাজারটাই এবার দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে অস্থির।
Published : 13 Feb 2025, 03:53 PM
রোজা শুরু হতে বেশি বাকি নেই। এরই মধ্যে প্যাকেটজাত সয়াবিন তেলের সংকট তীব্র। থেকে থেকে এটা অবশ্য চলছে কিছুদিন ধরেই। এরই মধ্যে একবার সয়াবিনের দাম বাড়ানো হয় উল্লেখযোগ্যভাবে। তখন স্পষ্ট হয়েছিল, দাম বাড়াতেই এমন সংকটের সৃষ্টি। আগেও আমরা সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোয় সরকারের সম্মতি আদায়ে এ ‘প্রক্রিয়া’ ব্যবহৃত হতে দেখেছিলাম। চলমান সংকটেও কোনো কোনো দোকানে অবশ্য প্যাকেটজাত তেল মিলছে। কিন্তু কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। সরবরাহ স্বাভাবিক থাকাকালে এক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় বরং মিলত। এ বাজারে আরও কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। যেমন, সয়াবিনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের অন্য পণ্য গছিয়ে দেওয়া।
‘সরবরাহ সংকট’ থাকলে এসব ঘটতেই পারে। কিন্তু সয়াবিন আমদানি তো কমেনি; পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয়ও তেলের ঘাটতি নেই। আমদানি বরং গেল বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আরও আমদানি প্রক্রিয়াধীন। রোজায়ও সয়াবিনের কোনো সংকট হবে না বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তার মানে, পণ্যটি সরবরাহের কোনো এক পয়েন্টে সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা অপরাধমূলক কাজ বলে বিবেচিত হবে কিনা, ওই প্রশ্ন উঠতে পারে।
প্যাকেটজাত সয়াবিন তেলের দাম সম্ভবত আরও বাড়ানো হবে এবং সরবরাহও হবে স্বাভাবিক। ততদিনে আমরা ভুলে যাব, নিকট অতীতেই কী ঘটেছিল। তবে তাদের পক্ষে ভুলে যাওয়া কঠিন, কোনো নিত্যপণ্যের দাম ৮-১০ টাকা বাড়লেও যাদেরকে এর ধকল সইতে হয়। অন্য কোনো নিত্যপণ্যের দাম একই হারে কমে এলে অবশ্য তারা কিছুটা স্বস্তি পাবে। সম্প্রতি সবজির দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসতে দেখা গেছে। চাষীদের জন্য এটা অবশ্য দুঃসংবাদ। ন্যূনতম দামটাও না পেয়ে ক্ষেতেই সবজি নষ্ট করে ফেলছে তাদের অনেকে।
রোজা আসতে আসতে শীতের সবজির সরবরাহ কমে আসবে অবশ্য। তখন সবজির পাশাপাশি সয়াবিন তেলের দামও বাড়বে হয়তো। খোলা সয়াবিনও বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। ভালো দাম মিলছে বলে মাঝে প্যাকেট ভেঙে তা খোলা সয়াবিন হিসেবে বিক্রির প্রবণতা বেড়েছিল। পাম অয়েলও আমরা কম ব্যবহার করি না। শিল্পের উপকরণ হিসেবে এর ব্যবহার বিবেচনায় নিলে পাম অয়েলই বেশি পরিভোগ হয়ে থাকে। অবশ্য পাম অয়েল আমদানি হচ্ছে কম। আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম নাকি বাড়তির দিকে। মাত্র কয়েকটি উৎসের ওপর এর সরবরাহ নির্ভরশীল বলে পাম অয়েলের বাজারে মাঝে মাঝেই অস্থিরতা দেখা দেয়। তখন সয়াবিনের বাজারও হয় অস্থির।
ভোজ্যতেলে আমরা বহুলাংশে আমদানিনির্ভর বলে এর আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে বৈকি। তবে ডলারের দাম বেশি হলে আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল থাকলেও লাভ নেই। দেশে এমন একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছে অনেকদিন ধরে। তাতে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুফলও মিলছে না। সয়াবিন তেলের দাম কম রাখতে অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্য এর কর-শুল্ক কমিয়েছে। এলসিসহ আমদানি প্রক্রিয়ায় বড় কোনো সংকটও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তারপরও সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত কেন, বোধগম্য নয়। সরকারের উচিত হবে জরুরিভাবে এদিকে দৃষ্টি দেওয়া। খোলা সয়াবিন আর পাম অয়েলের দাম স্বাভাবিক রাখতেও উদ্যোগী হতে হবে। রোজায় ইফতার সামগ্রী তৈরিতে এগুলোর চাহিদা বাড়ে দেশব্যাপী। ইফতার তৈরির অন্যান্য উপকরণের বাজার স্বাভাবিক না থাকলেও সংকট দেখা দেবে। ঘরে-বাইরে যেখানেই ইফতার সামগ্রী তৈরি হোক; এর ব্যয় নিয়ন্ত্রণে না থাকলে জনজীবনে ছড়াবে অস্থিরতা।
সয়াবিন তেলের ‘সংকটে’ সরকার চাইছে দেশে উৎপাদিত রাইস ব্রান তেলের ব্যবহার বাড়াতে। তবে স্বাস্থ্যবান্ধব বলে প্রচার থাকলেও এ ভোজ্যতেল এখনও জনপ্রিয় হয়নি। দামও অপেক্ষাকৃত বেশি। টিসিবির কার্যক্রমে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য রাইস ব্রান তেল বিতরণ করতে দেখা যাচ্ছে। বেশ কমে মিলছে বলে এটা হয়তো গ্রহণ করছে স্বল্প আয়ের মানুষ। তবে তারা খুশি হয় প্যাকেটজাত সয়াবিন তেল পেলে। সুখবর যে, কিছুদিন বন্ধ থাকার পর টিসিবির ‘ট্রাক সেল’ চালু হয়েছে। ফ্যামিলি কার্ডের বাইরে থাকারাও এখান থেকে পণ্য কিনতে পারবে। সংকটকালে রাষ্ট্রীয় অর্থের এমন ব্যবহারে কারও আপত্তি নেই। বরং দাবি রয়েছে কার্যক্রমটি বিস্তৃত করার। কেননা বিতরণকৃত পণ্যের তুলনায় ক্রেতা অনেক বেশি।
ট্রাক সেলে রোজার জন্য জরুরি কিছু পণ্যও যোগ করা হয়েছে। দেওয়া হচ্ছে ছোলা, খেজুর। এগুলোর আমদানিও সন্তোষজনক বলে জানা যাচ্ছে। ছোলাসহ ডালজাতীয় পণ্যের চাহিদা এ সময়ে অনেক বাড়ে। বাড়ে চিনির চাহিদা। সরকার চিনিতেও কর ছাড় দিয়েছে— যাতে দাম না বাড়ে। রোজায় পেঁয়াজের চাহিদাও বিপুলভাবে বাড়তে দেখা যায়। এর দাম মাঝে অনেক বাড়লেও বাজার এখন স্থিতিশীল। রোজা চলাকালে মূল মৌসুমের পেঁয়াজ এসে যাবে। আমদানিও অব্যাহত। পেঁয়াজের দাম হয়তো নিয়ন্ত্রণেই থাকবে।
মাঝে তেলেসমাতি হলেও নতুন আলু ওঠার পর থেকে এর দাম নিম্নগামী। আলুর দাম এত কমেছে যে, সেটাও চাষীদের জন্য দুঃসংবাদ। এ অবস্থায় আলু উৎপাদনে তারা আগ্রহ হারালে সেটা আরেক সংকটের জন্ম দেবে। বিগত সরকার আমলের শেষ দিক থেকেই যেতে হয়েছে আলু আমদানিতে। এখন অবশ্য এর প্রয়োজন নেই। বিক্রিতে ঝুঁকি থাকলে ব্যবসায়ীরাও আলু আনতে চাইবে না। এক্ষেত্রে চালের কথা উঠতে পারে। কর-শুল্ক ব্যাপকভাবে কমালেও মাঝে তেমন চাল আমদানি হয়নি। কারণ দামে পোষাচ্ছিল না। এ অবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তা ঠিকঠাক রাখতে সরকার নিজে উদ্যোগী হয়েছে আমদানিতে।
অন্যান্য পণ্যে না থাকলেও চালে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে বলে স্বীকার করা হচ্ছে। এ কারণে আমন মৌসুমেও চালের বাজারে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। এটি এখনও স্থিতিশীল হয়নি। কোনো কোনো বছর রোজায়ও চালের দাম বাড়তে দেখা যায়। সরকারের সতর্ক পদক্ষেপে এবার সেটা না হলেই আমরা বাঁচি। রোজায় অবশ্য চালের চাহিদা বাড়ার কথা নয়। সে কারণেও এর বাজার হয়তো কিছুটা শান্ত হয়ে আসবে।
রোজায় যেসব পণ্যের চাহিদা লাফিয়ে বাড়তে দেখা যায়, সেগুলোর বাজার শান্ত রাখাটা সবসময়ই বড় চ্যালেঞ্জ। তাতে ভোজ্যতেল অবশ্যই পড়ে। রোজার আগ দিয়ে এর বাজারটাই এবার দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে অস্থির। তবে আমদানি যেমন হচ্ছে, তাতে সরবরাহ সংকট হওয়ার কারণ নেই। অনেক সময় অতি-আমদানির কারণে কোনো কোনো পণ্যের দাম কমে যেতেও দেখা যায়। কোনো কোনো ঈদের বাজারে মসলার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটতে দেখা গিয়েছিল। বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না, এমন পণ্যে অতি-আমদানির সংকট দেখা দিলে ব্যবসায়ীদের মুশকিলে পড়তে দেখা যায়। এবার কোনো কোনো পণ্য আমদানির প্রবাহ দেখেও অনেকে এমন আশংকা করছেন। কোনো কোনো পণ্য আমদানিতে নতুন ব্যবসায়ীদের তৎপর দেখা যাচ্ছে।
একাধিক বড় প্রতিষ্ঠান আবার অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে পড়ে ব্যবসায় অনুপস্থিত। এ কারণে বাজারে সরবরাহ সংকট দেখা দেওয়ার খবর অবশ্য নেই। এজন্য বলা হয়ে থাকে, পণ্যবাজারে অধিকসংখ্যক ব্যবসায়ীর উপস্থিতি ভালো। বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেশি থাকলে সরকারকেও ওই বাজারে কারসাজির আশংকা করতে হয় কম। তবে ভোজ্যতেল, চিনি, আটা-ময়দার মতো পণ্যের বাজারে বড় ব্যবসায়ীদের উপস্থিতিই স্বাভাবিক। এদের সংখ্যা যাতে খুব কমে না যায়, সেদিকে সরকারকে রাখতে হবে দৃষ্টি। এসব পণ্যের বাজার নিবিড়ভাবে মনিটরও করে যেতে হবে। রোজার আগ দিয়ে এর প্রয়োজন বাড়ে বৈকি।
চালের বাজারেও বড় ব্যবসায়ীরা ‘কারসাজি’ করছে কিনা, ওই প্রশ্ন উঠেছে। এও ঠিক, সরবরাহ সংকট দেখা দিলেই কেবল কারসাজির সুযোগ ঘটে। আলুর বাজারেও সংকট চলাকালেই উঠেছিল এমন অভিযোগ। দাম পড়তে থাকার সময় কিন্তু কারোরই ক্ষমতা নেই কারসাজি করে এটা বাড়ানোর। এজন্য দেশে উৎপাদিত কিংবা আমদানিকৃত যে পণ্যই হোক, তার সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার ওপর সবিশেষ জোর দেওয়া হয়। সরবরাহ বিপুলভাবে বেড়ে গেলে দাম এতটা কমে যেতেও দেখা যায় যে, উৎপাদন ব্যয়ও উঠে আসে না। হালে সবজির ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে বলেই অভিযোগ। সামনে এমন কোনো ফসল কি চাষীদের হাতে আসবে, যার দামে এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব?
রোজায় অতি-আমদানির সংকটে পড়ে কোনো ব্যবসায়ীও ক্ষতিগ্রস্ত না হোক। ছোট ব্যবসায়ীদের পক্ষে কিন্তু এমন ক্ষতি সামলে ওঠা কঠিন। তাদের সম্ভাব্য ক্ষতির প্রশ্নটা উঠছে এ কারণেও যে, রোজায় খাদ্যপণ্যের চাহিদা হ্রাসের শঙ্কা রয়েছে। গেল মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে এলেও এখনও এটা রয়েছে আগের ধারায়। দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্ফীতি উচ্চস্তরে থাকায় এটা বিপুলসংখ্যক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা খেয়ে ফেলেছে এর মধ্যে।
কর্মসংস্থান পরিস্থিতিও খারাপ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, বিশেষত শিল্পে নতুন করে সংকট দেখা দিয়েছে। বিনিয়োগ বাড়বে না, এটাও ধরে নেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় রোজায় খাদ্যপণ্যের চাহিদা অন্যান্যবারের মতো বাড়বে না বলেই ধারণা। এমন প্রক্ষেপণ ঠিক হলে পণ্যবাজার অস্থির না হয়ে সেটা বরং ক্রেতার অনুকূলে থাকার কথা। বেশ কিছু মুসলিমপ্রধান দেশে রোজায় খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে দেখা যায় ব্যবসায়ীদের। আমাদের দেশে অবশ্য প্রবণতা রয়েছে যতটা সম্ভব ‘ব্যবসা’ করে নেওয়ার। ওই প্রেক্ষাপটেও এমন আলোচনা গুরুত্ব পাবে যে, ভোক্তার চাহিদা হ্রাসের কারণে পণ্যবাজার এবার কিছুটা শান্ত থাকে কিনা!
রোজায় অবশ্য বাড়বে রেমিট্যান্স আসা। এমনিতেও এর প্রবাহ ভালো। তবে এর বাইরের জনগোষ্ঠীই তো সুবিপুল। তাদের মধ্যে অতি-দরিদ্রও কম নেই। বছরের পর বছর বহাল মূল্যস্ফীতিতে সংখ্যাটি বেড়েছে বৈকি। রোজায় এদের জীবনে স্বস্তি জোগাতে সব রকম খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। চালের সংকটে মাঝে ফ্যামিলি কার্ডে চাল জোগানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাতেও বাজারে যায় খারাপ সংকেত। কিন্তু যথেষ্ট আমদানি আর পরিশোধনের পরও সয়াবিন তেল নিয়ে সংকট কোনোভাবেই মানা যায় না। এমন সংকটে গুজব ছড়ায়; সরকারের ভাবমূর্তিও হয় দ্রুত খারাপ। সুধীমহলে প্রশ্ন ওঠে তার দক্ষতা নিয়ে।
অন্তর্বর্তী সরকারে কয়েকজন বড় অর্থনীতিবিদ রয়েছেন। বাণিজ্য উপদেষ্টাও এসেছেন একটি প্রতিষ্ঠিত বিজনেস গ্রুপ থেকে। এদিকে গভর্নর সাহেব ব্যাংকসহ আর্থিক খাত মেরামতে উদ্যোগী। আসছে রোজায় আমরা তাদের সম্মিলিত ভূমিকার সুফলটাই দেখতে চাইব। অনেক আগে থেকে এবার রোজার পণ্যসামগ্রী আমদানি স্বাভাবিক রাখার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। আশা করব, দেশে উৎপাদিত পণ্যের বাজারও এবার অস্থির হবে না পরিবহন ব্যয় কিংবা চাঁদাবাজি বেড়ে ওঠায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে ‘বিশেষ অভিযান’ চলছে। এর প্রভাবও রোজার পণ্যবাজারে পড়ার কথা।