“যে মানুষটা দেশেই নাই তার নাম করে কেন রোগী ভর্তি করবেন? এটা কার স্বার্থে?”
Published : 20 Jun 2023, 12:50 PM
কুমিল্লা থেকে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে এসে নবজাতক হারানোর পর মা মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যুর ঘটনায় সেন্ট্রাল হাসপাতালের ওপর দায় চাপাচ্ছেন প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সংযুক্তা সাহা।
তিনি দাবি করেছেন, আঁখিকে যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, তখন তিনি দেশেই ছিলেন না। তাকে ‘না জানিয়ে’ ওই রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে। সুতরাং শিশু ও মায়ের মৃত্যুতে তার কোনো দায় ‘ছিল না’।
“যে মানুষটা দেশেই নাই তার নাম করে কেন রোগী ভর্তি করবেন? এটা কার স্বার্থে? আমি যদি অপারেশন না করি,যদি নাই থাকি, তাহলে রোগী ভর্তি করালেন কোন আক্কেলে? এটা অবশ্যই একটা বেআইনি ব্যবস্থা। এ ঘটনার জন্য একমাত্র দায়ী সেন্ট্রাল হাসপাতাল।”
আঁখি ও তার সন্তানের মৃত্যু নিয়ে তোলপাড়ের মধ্যে মঙ্গলবার রাজধানীর পরিবাগে নিজের বাসায় সাংবাদিকদের ডেকে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন ডা. সংযুক্তা সাহা। সেন্ট্রাল হাসপাতালে আঁখির অস্ত্রপচারের দশ দিন পর এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানা গেল।
আঁখি ও তার সন্তানের মৃত্যুতে যে সেন্ট্রাল হাসপাতালের অবহেলা ছিল, গত সোমবার তা স্বীকার করে নেন ঢাকার গ্রিনরোডের নামি এ চিকিৎসা কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক ডা. এটিএম নজরুল ইসলাম। তবে তিনি প্রথমত সংযুক্তা সাহাকেই দায়ী করেছিলেন।
কী গাফিলতি ছিল, সে প্রশ্নে নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, “গাফিলতি ছিল প্রথমত ডা. সংযুক্তা সাহার, তারপর ওটির চিকিৎসকদের। কারণ সে সময় তারা সিনিয়র ডাক্তারদের ডাকেনি।”
অন্যদিকে সংযুক্তা সাহা তার বাসায় সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, সিজারিয়ান অপারেশন বন্ধ করার জন্য তিনি যে ‘সামাজিক আন্দোলন’ শুরু করেছেন, সে কারণে একটা পক্ষ তার বিরুদ্ধে ‘এসব কাজ করছে’।
“ওই মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল হচ্ছে। আমি সবাইকে আহ্বান জানাব, আপনারা এই অনিয়মের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।"
সেন্ট্রাল হাসপাতালে ২০০৭ সাল থেকে কনসালটেন্ট্ হিসেবে কাজ করার কথা জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, কোনো চিকিৎসকের অধীনে রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে নিজস্ব কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা এখানে নেই। বরং বছরের পর পর ধরে কোনো চিকিৎসকের ‘লিখিত সম্মতি না নিয়েই’ রোগী ভর্তি করা হয়। মাহবুবা রহমান আঁখিকে ভর্তি করার সময়ও তার ‘সম্মতি নেওয়া হয়নি’।
“আঁখিকে ভর্তির সময় আমার উপস্থিতির ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছে যে আমি বাংলাদেশে আছি। হাসপাতালের এ ধরনের অসদাচরণ এবং অপরাধমূলক পদক্ষেপ… আমার সুনামকে বেআইনিভাবে পুঁজি করেছে। এটা কিছু আর্থিক লাভের জন্য রোগীকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। হাসপাতাল তাদের অনিয়মের সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য আমাকে সহজ লক্ষ্যে পরিণত করেছে।”
সেন্ট্রাল হাসপাতালে এ ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকলে কেন আগে বলেননি, সেই প্রশ্ন রাখা হয়েছিল এই চিকিৎসকের কাছে।
উত্তরে তিনি বলেন, “এতদিন নিশ্চয় তাদের কোনো সমস্যা হয়নি বলে আমার দোষ দেয়নি। এখন আমার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে।”
সংযুক্তা সাহা সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, গত জানুয়ারি মাসে তিনি ১৪৯টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ১৩১টি, মার্চে ১০৭টি, এপ্রিলে ১২৫টি, মে মাসে ১৪০টি স্বাভাবিক ডেলিভারি করিয়েছেন। যত স্বাভাবিক ডেলিভারি হয়েছে তার মধ্যে একটা বড় অংশের এর আগে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান হয়েছিল।
তবে তার কাছে মোট কতজন নারী চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন, তাদের কতজনকে অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে, সেই তথ্য দেননি তিনি।
সাংবাদিকরা বিষয়টি জানতে চাইলে ডা. সংযুক্তা সাহা বলেন, “এটা ফাইল দেখে বলতে হবে। ডেটা না দেখে বলতে পারব না।”
তিনি দাবি করেন, সিজারিয়ান ডেলিভারির বিরুদ্ধে ‘জনসচেতনতা তৈরির অংশ হিসেবে’ তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতেন।
যা যা হয়েছে
অস্ত্রোপচার ছাড়া সন্তান জন্ম দিতে নিজের ইচ্ছের কথা স্বামীকে জানিয়েছিলেন কুমিল্লার তিতাস উপজেলার আঁখি। সেজন্য গর্ভে সন্তান আসার পর থেকে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সংযুক্তা সাহার চিকিৎসা নেন তিনি।
প্রসবব্যথা উঠলে গত ৯ জুন মধ্যরাতে কুমিল্লা থেকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে আঁখিকে নিয়ে আসেন তার পরিবার। আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলীর ভাষ্য, প্রসূতিকে ভর্তির সময় চিকিৎসক সংযুক্তা হাসপাতালেই আছেন বলা হলেও আসলে তিনি ছিলেন না।
সেই রাতে ওই চিকিৎসকের সহকারীরা প্রথমে স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা প্রসবের চেষ্টা করেন। সে সময় জটিলতা তৈরি হলে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুটি ওইদিনই মারা যায়।
সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আঁখিকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার দুপুরে কিছু আগে তার মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় সেন্ট্রাল হাসপাতালে সব ধরনের অস্ত্রোপচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসকদের অনলাইনে কোনো ধরনের প্রচারে এসেছে নিষেধাজ্ঞা।
গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহা ওই হাসপাতালে আপাতত কোনো বিশেষজ্ঞ সেবা দিতে পারবেন না বলে নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটা প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছিল ওই হাসপাতালে। কোথায় অপারেশন হয়েছিল, তাদের আইসিইউ ছিল না কি না- সেটাও তারা দেখেছে।
অপারেশন থিয়েটার ও আইসিইউ ‘মানসম্মত না হওয়ায়’ তাদের সব অপারেশন বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনে ইতোমধ্যে ধানমণ্ডি থানায় মামলাও করেছেন আঁখির স্বামী। সংযুক্তা সাহার দুই সহযোগী চিকিৎসক শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা ও মুনা সাহাকে গ্রেপ্তার করে ওই মামলায় কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। সংযুক্তা সাহাও সেই মামলার আসামি।
আঁখি ও তার সন্তানের মৃত্যুর পর সেন্ট্রাল হসপিটালের অব্যবস্থাপনা নিয়ে যত অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর বিষয়ে সাংবাদিকরা সোমবার প্রশ্ন রাখেন হাসপাতালটির জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক চিকিৎসক এটিএম নজরুল ইসলামের কাছে।
এ হাসপাতালে একজন চিকিৎসক প্রতিদিন দেড়শ থেকে দুইশ জন রোগী দেখেন বলে তথ্য মিলেছে। একজন চিকিৎসক এত বেশি রোগী দেখলে ভালো চিকিৎসা আসলে সম্ভব কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “কোয়ালিটি সার্ভিস দিতে গেলে একজন চিকিৎসকের দৈনিক এত রোগী দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু সংযুক্তা সাহা দেখতেন, কী বলব আর এটি নিয়ে।”
সংযুক্তা সাহার বিষয়টি হাসপাতাল জানত কি না এমন প্রশ্নে নজরুল বলেন, এ বিষয়ে তার ‘জানা নেই’।
“ডাক্তারের কাছে এলে চিকিৎসা তো মূলত তারাই দেয়। তারপর কোনো একটা ঘটনা ঘটলেই সেটা আমাদের কাছে আসে। বাইরে বিষয়গুলোতে আমাদের অবগত করা হয় না। এজন্যই আমরা এই বিষয়গুলো জানতে পারিনি,” বলেন তিনি।