পসার বাড়াতে সোশাল মিডিয়ায় প্রচারে চিকিৎসকরা, কতটা নীতিসিদ্ধ?

ফেইসবুকে দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসকরা তাদের সফলতার গল্প নিজেরা বলছেন অথবা রোগী ও তাদের স্বজনদের মুখ দিয়ে বলাচ্ছেন। এটাকে অনৈতিক মনে করছেন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকরা।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 June 2023, 07:31 PM
Updated : 18 June 2023, 07:31 PM

মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যু সামনে এনেছে রোগী বাগাতে সোশাল মিডিয়ায় চিকিৎসকদের তৎপরতা।

কুমিল্লার তিতাস উপজেলার এই তরুণী এমন প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে এসেছিলেন ডা. সংযুক্তা সাহার কাছে, অস্ত্রোপচার ছাড়া প্রসব করাতে। কিন্তু এই চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতে ওই হাসপাতালে প্রসব করাতে গিয়ে নবজাতকটিরও মৃত্যু হয়েছে, শেষে রোববার আঁখিও মারা গেছেন।

ফেইসবুকে ডা. সংযুক্তা সাহার অনুসারীর সংখ্য ৫ লাখ ৩৪ হাজারের বেশি। তিনি নিয়মিত স্বাভাবিক গর্ভধারণ নিয়ে ভিডিও আপলোড করেন, অনেক সময় লাইভেও আসেন।

সবশেষ গত ৭ জুন প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি কয়েকজন নারীকে দেখাচ্ছেন, যাদের অস্ত্রোপচার ছাড়াই সন্তান হয়েছে।

আঁখির ঘটনার পর গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক সংযুক্তা সাহা ওই হাসপাতালে আপাতত কোনো বিশেষজ্ঞ সেবা দিতে পারবেন না বলে নির্দেশনা এসেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে।

চিকিৎসকদের পসার বাড়ানোর লক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে কোনো ধরনের ‘প্রচার চালানোর’ ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

সোশাল মিডিয়ায় প্রচার নিয়ে কথা বলতে রোববার ডা. সংযুক্তা সাহার মোবাইলে কল করলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। হোয়াটসঅ্যাপে কল দিলেও তিনি কেটে দেন।

Also Read: সোশাল মিডিয়ায় সেন্ট্রাল হাসপাতালের ডাক্তারদের প্রচারে মানা

Also Read: সেন্ট্রাল হাসপাতালে সব অস্ত্রোপচার বন্ধ

Also Read: আঁখি এখন সন্তানের পাশে, দেখা হল না দুজনার

Also Read: নবজাতকের মৃত্যু: সেন্ট্রাল হসপিটালের দুই চিকিৎসক গ্রেপ্তার

রোগী বাগাতে যেভাবে প্রচার

ডা. সংযুক্তার মতো অনেক চিকিৎসকের তৎপরতা দেখা যায় সোশাল মিডিয়ায়। ফেইসবুকে এমন সব পোস্টে দেখা গেছে, চিকিৎসকরা তাদের সফলতার গল্প নিজেরা বলছেন অথবা রোগী ও তাদের স্বজনদের মুখ দিয়ে বলাচ্ছেন।

কয়েকজন চিকিৎসকের ফেইসবুক পাতায় দেখা গেছে তাদের ফোন নম্বর, চেম্বার বা হাসপাতালের ফোন নম্বর দিয়ে পরামর্শ বা চিকিৎসা নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

ত্বকের চিকিৎসক তাসনিম খানের ফেইসবুক ফলোয়ারের সংখ্যা ৩ লাখের বেশি। তিনি ত্বকের নানা রোগের সার্জারির ভিডিও আপলোড করেছেন, লাইভে রোগীদের সঙ্গে কথোপকথনের ভিডিও আছে তার মধ্যে।

একটি ভিডিওতে তিনি মুখের বলিরেখা দূর করার প্রক্রিয়া দেখাচ্ছেন। আরেকটি ভিডিওতে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আঁচিল দূর করার প্রক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

জানতে চাইলে ডা. তাসনিম খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি যে ‘আধুনিক প্রযুক্তি’ নিয়ে কাজ করছেন, সেগুলো মানুষকে বোঝাতে এমন পদক্ষেপ। কারণ এসব চিকিৎসার জন্য এক সময় মানুষকে দেশের বাইরে যেতে হত।

“এখন এ ধরনের চিকিৎসা দেশেও হচ্ছে, সেটা তো অবশ্যই মানুষকে একটু জানাতে হয়। এছাড়া আমরা পেশেন্টদের জানাতে চাই, কী ধরনের কাজগুলো হচ্ছে, কী রোগের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। এছাড়া অনেক অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রামও আমি করি।”

প্লাস্টিক অ্যান্ড কসমেটিক সার্জন ডা. ইকবাল আহমেদের ফেইসবুক ফলোয়ার ১ লাখ ৯৭ হাজারের বেশি। তার পোস্ট করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটে প্লাস্টিক সার্জারি করেছেন এমন একজন রোগীকে ভিডিওতে এনেছেন তিনি। ওই নারী ওই পেটের ওই অস্ত্রোপচার নিয়ে রিভিউ দিচ্ছেন। ওই নারী বলছেন, পেটের সার্জারি করার পর তার ‘খুব ভালো লাগছে’।

ওই ফেইসবুক পাতায় দেওয়া মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করলে এক নারী ফোন ধরেন। তিনি বলেন, “স্যার একটু আগে চেম্বার থেকে বাসায় চলে গেছেন।”

কথা বলতে ওই চিকিৎসকের নম্বর চাইলে ওই নারী বলেন, “স্যারের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর দেওয়া নিষেধ আছে।”

আইন কী বলছে?

জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকরা বলছেন, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে রোগী আকৃষ্টের বিষয়টি অনৈতিক। এটি বন্ধে নীতিমালা তৈরি করা দরকার।

চিকিৎসকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ ডক্টর ফাউন্ডেশনের গভর্নিং বডির সদস্য ডা. নিরুপম দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চিকিৎসকরা সোশাল মিডিয়ায় যে বিজ্ঞাপন দেন, তাতে অনেক রোগীই বিভ্রান্ত হয়। এজন্য এটা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ।

“এই ধরনের বিজ্ঞাপন অনৈতিক। রোগীরা চিকিৎসক বেছে নিতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়। তিনি যে নরমাল ডেলিভারির বিজ্ঞাপন দিলেন, এটা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক সময় জোর করেও নরমাল ডেলিভারি করানো হচ্ছে। এতে রোগীর ক্ষতি হচ্ছে। আমি বিএমডিসিকে অনুরোধ করব ফেসবুক ভিডিও, টিকটক ভিডিও যেগুলোতে রোগী আকর্ষণের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, তা বন্ধ করেন। পৃথিবীর কোনো দেশে এটা নেই।”

বাংলাদেশে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিতরা কীভাবে কাজ করবেন, তা নিয়ন্ত্রিত হয় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) দ্বারা। এজন্য একটি ‘কোড অব প্রফেশনাল কন্ডাক্ট’ রয়েছে।

বিএমডিসির রেজিস্ট্রার ডা. মো. লিয়াকত হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নীতিমালায় চিকিৎসকরা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করতে পারবেন কি না, তা বলা নেই।

“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কয়েক বছর ধরে এসেছে। আমাদের নীতিমালা হয়েছে এরও আগে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে ঠিকই। কিন্তু আমাদের কাছে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো টুলস নাই।”

বিএমডিসির কোড অব প্রফেশনাল কন্ডাক্টে (এটিকিউয়েট অ্যান্ড ইথিকস) ‘প্র্যাকটিস প্রমোশন’ অংশে বলা হয়েছে, কোনো চিকিৎসক তার পেশার পসারের জন্য প্রচারমূলক কার্যক্রম চালাতে পারবেন না।

‘কোড অব প্রফেশনাল কন্ডাক্টে’ বিষয়টি এখন না থাকলেও বিএমডিসির সাম্প্রতিক এক বৈঠকে সোশাল মিডিয়ার বিষয়টি যুক্ত করার কথা এসেছে বলে জানান তিনি।

ডা. লিয়াকত বলেন, “আমরা যখন এটার আপডেট করব, তখন আমরা চিকিৎসকদের আচরণ এবং নীতিমালার যে বিষয়টি আছে, সেটার মোডিফিকেশন সম্ভব যদি হয়, তা আমরা করব।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা.এ বি এম খুরশীদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কিছু বিষয় আইনে লেখা না থাকলেও তা অনৈতিক।

চিকিৎসকদের সোশাল মিডিয়া ব্যবহারের বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

ডা. খুরশীদ বলেন, “এখন এই মিডিয়ার যুগে আমি একটা অপারেশন করলাম, এটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিলাম। কালকে আমার কাছে রোগী আসতে শুরু করল এটা দেখে। আসলে এটার রেজাল্ট কিন্তু যা দেখানো হয়েছে, তা নয়।

“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কতটা কী করতে পারবে, সেটা বিচারের কোনো কাঠামো বা মানদণ্ড আমাদের এখানে নাই। বিষয়টি নিয়ে আমাদের প্রফেশনাল লিডার যারা আছেন, তারা ভাবনা চিন্তা করতে পারেন। আমরাও বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে পারি যে হাউ টু হ্যান্ডল দ্য মিডিয়া। আমি মনে করি এটার একটা সুর্নির্দিষ্ট নীতিমালা এবং আইন থাকা উচিৎ যে একজন চিকিৎসক কীভাবে মিডিয়াতে বিহ্যাভ করবেন।”