দাবদাহে ক্ষতির কারণে খামার মালিকরা মুরগি ও ডিমের দাম বাড়ার যে আভাস দিয়েছিলেন, তাই ঘটেছে।
Published : 11 May 2024, 01:07 AM
এপ্রিলে তীব্র গরম পড়ার আগে আগে টাঙ্গাইলের সখিপুরের জাকিয়া পোল্ট্রি ফার্মের কর্ণধার জাহিদ হোসেন প্রতিটি ডিম বিক্রি করেছেন ৮ টাকা ১০ পয়সা করে। এখন দাম পাচ্ছেন ১০ টাকা ৫ পয়সা হিসাবে।
এই ১ টাকা ৯৫ পয়সা বাড়তি দর তার গত এক মাসের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে আছে সংশয়।
জাহিদের খামারে ডিম পাড়ার মুরগি ছিল ২৫ হাজার। ডিম পেতেন প্রায় ২২ হাজারের বেশি। মুরগির বিপরীতে উৎপাদন ছিল ৮৮ শতাংশ।
এখন ২০ হাজার মুরগিতে দিনে ডিম আসে ১৫ থেকে ১৬ হাজার, উৎপাদনের হার নেমেছে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশে। ফলে বেড়েছে উৎপাদন খরচ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জাহিদ বলেন, “যখন ৮ টাকা করে পেতাম, তখন দুই মাসে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা করে লস হইছে। এটা শুধু ডিমেই লস। আর মুরগি মারা গেছে সেটা আলাদা লস। এখন যে টাকা পাচ্ছি এ রকম পেলে আগের লস কিছুটা পূরণ হবে। তবুও লস থেকে যাবে।”
এপ্রিলে দাবদাহে পোলট্রি খাতে যে ক্ষতি হয়েছে, তা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। মাসের শেষে মুরগির খামার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন-বিপিএ জানিয়েছিল, সারা দেশে দিনে এক লাখের মত মুরগি মরেছে।
গত ২৬ এপ্রিল এই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সমিতি এও শঙ্কা প্রকাশ করে যে, এর প্রভাব পড়তে পারে মুরগি ও ডিমের দামে। ঘটেছেও তাই।
দুই সপ্তাহের মধ্যে ডিমের দাম ডজনে বেড়েছে ২০ থেকে ২৪ টাকা, ব্রয়লার মুরগির কেজিতে বেড়েছে ৪০ টাকার মত। আর সোনালি মুরগির দাম বছর চারেক আগের দেশি মুরগির দামকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। কেজিপ্রতি দাম হয়ে গেছে ৪০০ টাকা।
ডিমের দামে কী চিত্র
এপ্রিলের শেষে ডিমের দাম ছিল পড়তি। হালি নেমে এসেছিল ৪০ টাকায়। এখন ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে ৪৮ টাকা।
বৃহস্পতিবার ঢাকার পাইকারি বাজারেই দাম ছিল ৪৫ টাকা ২০ পয়সা। খামার পর্যায়ে দাম ছিল ৪০ টাকা ২০ পয়সা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণায় জানিয়েছে, গত অর্থবছরে দেশে মাথাপিছু ডিমের প্রাপ্যতা ছিল ১৩৪টি। এই হিসাবে প্রতিটি ডিমের জন্য দুই টাকা বাড়তি দরে খরচ বাড়বে ২৬৮ টাকা।
দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাজারে পূর্ণ প্রতিযোগিতা আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন নতুন না। পাইকারি আড়ত ও খামার পর্যায়ে এই দাম নির্ধারণের বড় কোম্পানিগুলোই পালন করে মুখ্য ভূমিকা।
তারা এসএমএসে দাম জানিয়ে দিলে বাকিরা তা যে অনুসরণ করে, সেটি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সেমিনারে একাধিকবার বলা হয়েছে। এভাবে এসএমএসে দাম জানানো গ্রহণযোগ্য না- এমন কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সমাধান হয়নি।
বাজারে কাজী ফার্মস, সিপি বাংলাদেশ, প্যারাগন, আফতাব বহুমুখী ফার্মস, বাংলাদেশ হ্যাচারিসহ বেশ কয়েকটি বড় ডিম উৎপাদনকারী কোম্পানি রয়েছে, যেগুলো নিজস্ব পরিবেশকদের মাধ্যমে ডিম সরবরাহ করে।
আর ঢাকার তেজগাঁও, যাত্রাবাড়ী ও মিরপুর, গুলিস্তানের কাপ্তান বাজারের মুরগি পট্টিসহ অন্যান্য পাইকারি বাজার দেশের বিভিন্ন এলাকার খামারিদের কাছে থেকে ডিম ও মুরগির সরবরাহ পায়।
আড়তদাররা বলছেন, গরমে মুরগি মারা যাওয়ায় খামারি পর্যায় থেকে দাম বেড়ে গেছে।
যাত্রাবাড়ীতে ডিমের আড়ত লাকসাম ট্রেডার্সে ডিম কিনতে আসা খাবার হোটেল ব্যবসায়ী রহিম সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার দিনে ৫০টা ডিম লাগে। দুই দিনের লাইগ্যা একলগে ১০০টা কিনি। এক মাস আগেও ৯৪০ টাকায় কিনছি। এহন আইজ ১১৩০ টাকা দিতে হইব।
“আমরা তো দরদাম করি না। পাইকারি যা দাম তাই রাহে, ডিম নিতে আইলে হেরা গইন্যা দেয়, আমি টাকাডা গুইন্যা দেই।”
লাকসাম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আল-আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তো ছোটো পাইকার। দিনে ১০ থেকে ২০ হাজার ডিম বিক্রি করি। সপ্তাহখানেক আগেও এক হাজার ৮০ টাকায় ১০০ ডিম আনতে পারতাম। আইজকা (বৃহস্পতিবার) বিক্রি করতাছি ১ হাজার ১৩০ টাকা দরে। দাম বাড়লে আমাগো না বাড়াইয়া উপায় আছে?’’
প্রতি হাজারে ২০ থেকে ৩০ টাকা মুনাফা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে ভেঙে যাওয়া, নষ্ট, দাগ পড়া ডিমও বাদ দিতে হয়।
খামারি কত টাকা পাচ্ছেন?
ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার মল্লিকবাড়ি ইউনিয়নে শামছুল ইসলামের খামারে এক হাজার ২০০ মুরগি রয়েছে। গত বুধবার খামারের ৪২০০ ডিম নিয়ে তিনি আসেন ঢাকার তেজগাঁওয়ে।
প্রতি ডিমের দর সাড়ে ৯ টাকা পেয়েছেন জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ঈদের পর থেকে ৮ টাকা থেকে আট টাকা ২০ পয়সা দরে ডিম বিক্রি করেছি। এই প্রথম গতকাল সাড়ে ৯টাকা পেলাম।”
সেই ডিম পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি ১১ টাকায়। ছোট পাইকার তার সঙ্গে ৩০ পয়সা যোগ করে বিক্রি করছেন দোকানদারের কাছে ১১ টাকা ৩০ পয়সা দরে, যা ভোক্তার কাছে ১২ টাকায় দাঁড়াচ্ছে।
তবে এক দিন পরেই টাঙ্গাইলের জাকিয়া পোল্ট্রি ফার্মের জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, তিনি ১০ টাকা ৫ পয়সা দরে ডিম বিক্রি করেছেন। ফলে এই ডিম বাজারে এলে দাম আরো বেড়ে যায় কি না, তা নিয়ে আছে সংশয়।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার এনোয়েতপুর ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামের মারুফ পোল্ট্রি ফার্মের কর্ণধার সোহরাব হোসেন বলেন, “আমার এখন ১২ হাজার মুরগি আছে। এখান থেকে ডিম পাই আট হাজার। গরমের আগে আরও হাজারখানেক ডিম বেশি পাইতাম। আর মুরগি মরছে তিনশ থেকে চারশ।”
সোহরাব আগে প্রতিটি ডিমের জন্য পেতেন আট টাকা করে। এখন পান ১০ টাকা করে। তারপরও লোকসান হচ্ছে বলে দাবি তার।
তিনি বলেন, “ভারতের সঙ্গে আমাদের দেশের দাম মেলানো হয়। ভারতের চেয়ে আমাদের দেশে মুরগির খাবারের দাম বেশি। খাদ্যের দাম ভারতের সমান করলে ভারতের সমান দামে মানুষদের ডিম খাওয়াব।”
দাম কি এতটা বাড়ার কথা?
গরমে উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিলেও এই সময়ে ডিমের দাম এতটা বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো কারণ নেই বলে মনে করেন খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) এর সভাপতি সুমন হালদার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সারা দেশে পাঁচ কোটি মুরগি চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে সাড়ে তিন থেকে চার কোটি ডিম উৎপাদন হয় দৈনিক। গরমে ডিমের চাহিদা একটু কম থাকে, মুরগি কিছু মারা গেলেও ডিম উৎপাদনে খুব একটা প্রভাব পড়েনি।
“গত এক মাসে মুরগির ফিডের দাম তো বাড়েনি। ডিমের দাম বাজারে বাড়লেও খামারিদের কোনো লাভ হচ্ছে না। বাড়তি দাম তারা পাচ্ছে না, এই যে দাম বাড়ল, তার পুরোটাই যাচ্ছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের পকেটে।”
রাজধানীর পাইকারি পর্যায়ে ডিমের বড় বাজারের একটি তেজগাঁও আড়ত। এ আড়তে দিনে ২০ লাখ ডিম বিক্রি হয়।
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দিনে এক লাখের বেশি ডিম কম আসছে আড়তে। খামারিরা দাম বাড়িয়েছে। আমরা তো ডিম যা আসবে তাই বিক্রি করে দেই।”
এক লাফে ব্রয়লার ২৪০, সোনালি ছাড়াল ৪০০
রোজার ঈদের আগে আগে ব্রয়লার মুরগির দাম ২০০ টাকা থেকে লাফ দিয়ে ২৫০ বা ২৬০ টাকা হয়ে যায়। ঈদ শেষে চাহিদা কমায়, সেই সঙ্গে গরমের কারণে মড়ক শুরু হলে খামারিরা মুরগি দ্রুত বাজারে ছেড়ে দিতে থাকেন। দ্রুতই দাম আবার ২০০ টাকায় নেমে আসে।
এর মধ্যেই খামারিদের সংগঠন ১০ দিনে ১০ লাখ মুরগির মৃত্যুর তথ্য গণমাধ্যমে সরবরাহ করে দাম বাড়ার শঙ্কা প্রকাশ করে।
গত ১০ দিনে দাম বেড়ে আবার ব্রয়লারের দাম পৌঁছে গেছে ২৪০ টাকায়, সোনালি মুরগির দাম ছাড়িয়েছে চারশর ঘর, কোথাও কোথাও দাম রাখা হচ্ছে ৪১০ কি ৪২০ টাকা।
এই দামে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এক সময়ের ‘সস্তার ব্রয়লার মুরগি কেনা কঠিন হয়ে গেছে।
দিনমজুরি করে আয় করা বিমল রবি দাস বললেন, “যহনি খাবারের দাম বাইড়া যায়। তহন পেটে চাপ পইড়া যায়।
“এবার মুরগির দাম বাইড়া আমগো সাধ্যের বাইরে চইল্যা গেল। আগে মাঝেমধ্যেই মুরগি খাইতাম, কিন্তু এহন খাওয়ার পথ বন্ধ হইয়া গেল।”
বিমল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মো. মুহসিন হলে মুচির কাজ করেন। তার পরিবারে আট সদস্যের মধ্যে আয় করেন চারজন। আগে খাবারের তালিকায় সপ্তাহে তিন দিন ব্রয়লার মুরগি রেখে কোনোমতে সংসার চালিয়ে নিতেন। পছন্দের এই খাবার এখন সপ্তাহে একদিনের বেশি খেতে পারবেন না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাবদাহে মুরগি মারা গিয়ে খামারিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেই ক্ষতি পুষিয়ে দাম বাড়ানো হয়েছে।
কারওয়ান বাজারে মা আয়েশা ব্রয়লার হাউজের বিক্রেতা আমজাদ হোসেন বলেন, “মুরগির সরবরাহ কিছুটা কম। আমাদের কাছে গত চার-পাঁচদিন ধরে যে মাল দিচ্ছে, এগুলোর রেট অল্প অল্প করে বেশি ধরছে। এক সপ্তাহ আগেও ২১০ টাকা কেজি ছিল। আজ ২৪০ টাকা বিক্রি করতেছি।”
একই বাজারের সোনালি মুরগির দোকান জননী মুরগির আড়তের বিক্রেতা আব্দুল ওয়াহাব বলেন, “আমাদের একটা নির্দিষ্ট রেট দিয়ে দেয় সরবরাহকারীরা। সেই রেটেই আমাদের কিনতে হয়। ইদানীং রেট বাড়াইয়া দিছে।”
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৮০টাকা। এর যৌক্তিক মূল্য ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা, যা এখন হয়েছে তা ঠিক আছে। এর চেয়ে কম হলে তা খামারির জন্য লস।
“কারণ, খামারির উৎপাদন খরচ যেমন বেড়েছে তেমন গরমের কারণে মুরগি অনেক মারাও গেছে। এই গরমে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগি মারা গেছে ১৫ লাখ। আর ডিমের যে লোয়ার মুরগি আছে সেগুলো মারা গেছে ৫ লাখ।”
পুরনো খবর
উত্তাপে মরছে মুরগি, খামারিদের মাথায় হাত