“দিনে ১০ থেকে ১৫টা করে মুরগি মরতেছে। সব সময় ফ্যান দিয়া রাখতেছি। তবু অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।”
Published : 25 Apr 2024, 01:26 AM
তীব্র গরম গাজীপুরের ব্রয়লার খামারি হারুনুর রশিদের আর্থিক লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে মুরগি লালনপালন করে আসা মানুষটির এমন অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম।
শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামে হারুনের খামারটি বেশ বড়সড়। ১০ হাজার মুরগি তুলে বড় করছেন। বাজারে দাম ভালো, তাই ভালো মুনাফার আশা ছিল। এখন বিনিয়োগ উঠে আসলেই খুশি তিনি।
গরম বাড়ার পর গত দুই দিনে তার খামারের প্রায় ২০০ মুরগি মারা গেছে। গরম কমছে না কোনো মতে, সামনে কী হয়, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় তিনি।
বাকিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে নানা ওষুধপাতির পেছনে ৬০ হাজার টাকা খরচ করেছেন, খামারে নতুন করে বৈদ্যতিক পাখা লাগিয়েছেন; আরও যা যা দরকার তা করার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মুরগি মরে যাওয়া আর ওষুধ খাওয়ানোসহ নানা খরচ হিসাব করলে লাখ টাকার বেশি লস হইল আমার। মুরগিগুলোকে সুস্থ রাখব কীভাবে তা নিয়ে অনেক চিন্তায় পড়ে গেছি।
“গরমে যেন না মরে তাই ফার্মে অনেকগুলো ফ্যান লাগিয়েছি। এগুলোর আবার বিদ্যুৎ বিলও হচ্ছে অনেক। সব মিলিয়ে প্রচণ্ড অস্বস্তিতে আছি। আর কয়েকদিন যদি এই অবস্থাই চলতে থাকে তাহলে আমি ভয়াবহ বিপদে পড়ে যাব।”
খামারিদের মত বিক্রেতাদেরও একই দশা। তাদের দোকানে তোলা মুরগি মরে যাচ্ছে। ঈদের পর এখনও স্বাভাবিক চাহিদায় ফেরেনি বাজার। ফলে মুরগি তুললে তা রাখতে হচ্ছে বেশি সময়, রাতের বেলায় যখন দোকানে কেউ থাকে না, তখন বেশি দুশ্চিন্তার কথা বলছেন বিক্রেতারা।
কারওয়ান বাজারের মা ফাতেমা চিকেন হাউজের বিক্রেতা মো. জিসান বলেন, “এক দিনে ১০ থেকে ১৫ টা করে মুরগি মরতেছে। সব সময় ফ্যান দিয়া রাখতেছি। তবু অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আমরা মানুষরাই তো এই গরমে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি, অনেকেই তো মারা গেল।”
পাশের নূরজাহান চিকেন ব্রয়লার হাউজের বিক্রেতা মো. সাইদুল আলম বলেন, “ছোট এই দোকানে ৫টা ফ্যান লাগাইছি যাতে মুরগি না মরে। তবুও মরে গেছে কিছু।”
এর মধ্যে ক্রেতার জন্য অবশ্য কিছুটা সুখবর আছে। ঈদের আগে আগে লাফ দিয়ে ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতিকেজি ২৫০ থেকে ২৬০ টাকায় উঠে গিয়েছিল। চাহিদা কমা আর মুরগি টিকিয়ে রাখা নিয়ে অনিশ্চতার মধ্যে দাম কমে ২০০ থেকে ২১০ টাকায় নেমেছে। এটি কয়েক দিন আগে ১৯০ টাকাতেও নেমেছিল।
ডিম ব্যবসায়ীদেরও মাথায় হাত
তেজগাঁওয়ের ফকিন্নি বাজারে মো. ওয়াজউদ্দিন বলেন, “গত বছর গরমে আমার দুই হাজার ডিম নষ্ট হইছিল। সেগুলো আনার পরের দিনই দেখি নষ্ট। তাই বুদ্ধি করে এই গরমে ডিম কমিয়ে কমিয়ে আনি। তবুও যেগুলো ৪ থেকে ৫ দিন বিক্রি হয় না, সেগুলো দেখা যায় নষ্ট হয়ে যায়।”
মুরগির মত ডিমের দামও কিছুটা কমেছে।
তেজগাঁও এক নম্বর রেলগেইট এলাকার ডিম ব্যবসায়ী মো. আব্দুল আলিম বলেন, “গরমে মানুষ ডিম তেমন খায় না। চাহিদা কমে, তাই দাম কমতেছে।
“এখন হাঁসের ডিম পাইকারিতে বিক্রি করতেছি ১০০ ডিম ১২০০ টাকা। পোল্ট্রির লাল ডিম ১০০ পিস ৮৮০ টাকা আর সাদাটা ৭৮০ টাকা।”
প্রতিদিন দুই থেকে তিনশত ডিম নষ্ট হচ্ছে জানিয়ে এই পাইকারি বিক্রেতা বলেন, “এ অবস্থা চলতে থাকলে ক্ষতির সম্মুখীন হব।”
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী মো. মুজিবুর লাল ডিম ৩৮ থেকে ৪০ টাকা, সাদা ডিম ৩৫ টাকা আর হাঁসের ডিম ৫০ টাকা হালিতে বিক্রি করছিলেন।
কাজী ফার্মের বিক্রয় বিভাগের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বলেন, “৫ দিন ধরে দাম একটু কম। এখন ৮ টাকা ১০ পয়সা করে বিক্রি করছি। ১৪ এপ্রিল ৯ টাকার বেশি ছিল।
“গরমে চাহিদা একটু কমেছে। মুরগি ডিম পাড়ার পর ফার্ম থেকে আমাদের এখানে ডিম এলে সেদিনই আমরা ডেলিভারি দিয়ে দেই। এরপর কী হয় তা বলতে পারি না। তবে খুব বেশিদিন গরমে ডিম রাখা যায় না।”
করণীয় কী
খামারিরা এখন কী করবে- এই প্রশ্নে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. তারেক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্রয়লার মুরগির গ্রোথ একটু বেশি। বেশি স্বাস্থ্যবান, তাই তার গরম অনুভব হয় বেশি। এক্ষেত্রে যে জায়গায় মুরগি উৎপাদন করা হয় সে জায়গা বড় করতে হবে বা মুরগি কমাতে হবে। বেশি ঘন করা যাবে না।”
উচ্চ তাপমাত্রার কারণে পানি গরম হয়ে যায় বলে সরাসরি টিউবল থেকে উঠিয়ে ঠান্ডা পানি খাওয়ানোর পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। সেই পানিতে গ্লুকোজ সলিউশনসহ বা কিছু ওষুধ মুরগিকে একটু স্বস্তি দেবে বলেও মত তার।
এই প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞ খাবারের রুটিন পাল্টানোর পরামর্শও দিয়েছেন। বেশি গরম পড়ে বলে দুপুরে খাবার কম দিয়ে সকালে ও বিকালে তা বাড়ানোর কথা বলছেন।
এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণ ফ্যান রাখা, শেডের উপরে যদি টিন থাকলে তার ওপর যেন সরাসরি সূর্যতাপ না পড়ে, সে জন্য এর ওপরে বা টিনের নিচে চাটাই জাতীয় কিছু বসানোর কথা বলেছেন তিনি।
ডিম সংরক্ষণেও একই ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “ডিম কয়েকদিন বেশি সংরক্ষণ করতে ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হবে। রুমে এসি থাকলে ভালো, আর এসি না থাকলে যদি গ্রাম হয় তাহলে ঘরে বালি বা মাটিতে রাখা যেতে পারে।”
ডিম থেকে বাচ্চা ফোটাতে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ব্যবহার করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “এই তাপে ৭ দিনেই ডিমের ভেতরে বাচ্চার চোখ তৈরি হয়ে যায়। এখন যে তাপমাত্রা এতে এমনিতেই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে যাবে। ৩৭ ডিগ্রির চেয়ে গরম যত বেশি হবে, ডিম তত দ্রুত নষ্ট হবে।
“আর খাওয়ার জন্য বাণিজ্যিকভাবে যে ডিম বাজারে আছে তা থেকে হয়ত বাচ্চা হবে না, তবে সেটার প্রোটিন নষ্ট হয়ে যায়, ডিমও নষ্ট হয়ে যায়।”
ডাব-তরমুজের রমরমা
মুরগি-ডিমের বিপরীত চিত্র ডাব, তরমুজসহ দেশীয় ফলের বাজারে। চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে গেছে দাম।
কারওয়ান বাজারের ডাব বিক্রেতা লাল মিয়া ছোট জাতের ডাব বিক্রি করেন। এগুলো নোয়াখালীর জানিয়ে তিনি বলেন, “এগুলো ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বেচতাম আগে। এখন কিনতেই হয় ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। আর বেচি ৯০ টাকায়। আর মাঝারি আকারের ডাব ১২০ টাকা। বড়গুলো ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা।”
তার তথ্য বলছে, আগে বড় ডাব পাইকারিতে ১০০টি কিনতে হত ৬ হাজার টাকায়। এখন তা ১১ হাজার, অর্থাৎ বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
মো. শাহজাহান নামে একজন ক্রেতা বললেন, “৫ থেকে ৬ দিন আগেও এই আগুন দাম ছিল না বাজারে। এখন শরীরের দিকে মায়া করে ডাব খাই। কিন্তু দাম শুনে অবাক হই।”
মো. সেলিম নামে আরেকজন বললেন, “কারওয়ান বাজার ও আশেপাশে তো দাম কম। বাইরে গেলে তো আরও বেশি। গতকাল আমার কাছে ডাবের দাম চাইছে ২০০ টাকা। ১৯০ টাকা বলছে শেষ দাম। পরে কিনি নাই।”
তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়া এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচে তরমুজ বিক্রি করছিলেন মো. জাকির। তিনি জানালেন, এখন বাজারে খুলনা অঞ্চল থেকে আসা তরমুজ বেশি। এগুলো এক কেজি থেকে সর্বোচ্চ চার কেজি হয়ে থাকে। গরমের কারণে চাহিদা অনেক, কিন্তু সরবরাহ কম।
“আমার কাছে আছে ছোট মাল। এগুলো এক থেকে দেড় কেজি হয়ে থাকে। এগুলো আমি কিনছি ৪৭ টাকা পিস। বিক্রি করতেছি ৭০ টাকা পিস হিসেবে।”
তাহলে তো অনেক লাভ করছেন- এমন কথায় তিনি বললেন, “এগুলো হিসাবেই। এক হাজার তরমুজ আছে এখানে। দেখা যাবে দুইশর মত নষ্ট হয়ে যাবে।”
কারওয়ান বাজারের তরমুজ বিক্রেতা মো. হারুন বলেন, “গরম বেশি পড়ছে তাই দাম বেশি।”
এই বাজারে তরমুজ কেটে ১০ টাকা পিস হিসেবেও বিক্রি করতে দেখা যায়। অনেকেই এক খণ্ড, কেউ কেউ দুটি বা তিনটিও খাচ্ছেন।
রিকশা থেকে নেমে ক্লান্ত শরীর নিয়ে রিকশাচালক হাসান মিয়া এক খণ্ড তরমুজ কিনলেন। তরমুজের আকার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলেও বিক্রেতা বললেন, তিনি বেশি দামে কিনছেন।
বিক্রেতা হাসিবুর রহমান বলেন, “মৌসুম শেষ প্রায়। আর যে গরম পড়ছে, চাহিদা বেশি। তাই মাল যে দামে পাই তাতেই ব্যবসা করতেছি।”
তরমুজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাম বেশি চাইছেন আনারস বিক্রেতারাও।
তাদের একজন মো. সোহেল বলেন, “আমি কিনে আনছি ১৫ টাকা পিস। বিক্রি করতেছি ৩০ টাকা পিস। গরম বেশি তো তাই অনেক মাল নষ্ট হবে। এজন্য একটু লাভ হাতে রেখে বিক্রি করতেছি।”