ডা. নারায়ণ বলেন, “একজন নিউরোলজিস্ট হিসেবে আমি রাবেয়ার উন্নতি দেখে অভিভূত।
Published : 28 Apr 2024, 09:22 PM
প্রায় আট বছর আগে রাবেয়া এবং রোকাইয়া জন্মেছিল মাথা জোড়া লাগানো অবস্থায়। তাদের মস্তিষ্ক ছিল একটি। এ অবস্থায় দুই বোনের বাঁচার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ।
তবে রোববার ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা পরবর্তী সবশেষ অবস্থা জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রাবেয়া এসেছে হেঁটে। আর রোকাইয়াকে হুইল চেয়ারে করে নিয়ে আসেন তাদের বাবা রফিকুল ইসলাম।
সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, মাথা জোড়া লাগানো জমজ শিশুর কয়েক দফা অস্ত্রোপচারের পর একজন রাবেয়া ফিরছে স্বাভাবিক জীবনে। সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। অপর শিশু রোকাইয়া স্বাভাবিক নয়, তবে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতিও প্রত্যাশার চেয়ে বেশি হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে দুই শিশুরি চিকিৎসায় জড়িত চিকিৎসকরাও উপস্থিত ছিলেন।
রাবেয়া এবং রোকাইয়ার শারীরিক অবস্থা বর্ণনা করেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. নারায়ণ চন্দ্র সাহা।
তিনি বলেন, গত চারদিন এই দুই শিশুর বর্তমান অবস্থার চূড়ান্ত মূল্যায়ন করা হয়। তাতে চিকিৎসকরা দেখেছেন, রাবেয়ার চলাফেরা স্বাভাবিক, সে হাতে লিখতে ও গান গাইতে পারে। আর রোকাইয়ার এখনও নানা স্নায়বিক সমস্যা আছে। তাকে নিয়মিত চিকিৎসা দিতে হবে।
ডা. নারায়ণ বলেন, “একজন নিউরোলজিস্ট হিসেবে আমি রাবেয়ার উন্নতি দেখে অভিভূত। আমাদের যা চিন্তা ছিল তার চেয়ে বেশি সে পারফর্ম করছে। তার ডানপাশে একটু দুর্বলতা আছে। সেজন্য আমরা পরিকল্পনা করেছি, সেভাবে অনুযায়ী কাজ করলে সে পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে বলে আশা করি।
“রোকাইয়ার শারীরিক কিছু সমস্যা আছে। তার ফিজিক্যাল থেরাপি লাগবে, কিছু ওষুধ লাগবে। একটা ইনজেকশন আছে, আমরা সেটা দিব। তাহলে তার কিছুটা উন্নতি হবে, তবে তার কিছুটা ডিজঅ্যাবিলিটি থাকবে।”
রাবেয়ার রোকাইয়ার বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমার দুই সন্তানকে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছি। তাদের চিকিৎসার জন্য অনেকের কাছে গিয়েছি। আমাদের সন্তানদের জন্য চিকিৎসকরা যা করেছেন তা কোনোদিন ভুলব না।”
সামরিক চিকিৎসা সার্ভিস মহাপরিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এই দুটি জমজ শিশু অস্বাভাবিকতা নিয়ে জন্ম নিয়েছিল। তাদের দুটি দেহ, দুটি প্রাণ কিন্তু একটি মস্তিষ্ক। শিশু দুটির অবর্ণনীয় কষ্ট, তাদের পিতামাতার অসহায়ত্বের কথা জানতে পেরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসার নির্দেশ দেন।
“মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিভিন্ন হাসপাতালের শতাধিক চিকিৎসক। ৩৩ ঘণ্টার অস্ত্রোপচার শেষে আমরা সফল হয়েছি। রাবেয়া ও রোকাইয়ার অস্ত্রোপচার পরবর্তী চিকিৎসা এখনও চলমান। দুটি শিশুর প্রতি দায়বদ্ধতা, মমত্ববোধ থেকে শত ব্যস্ততার মধ্যেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসার খোঁজখবর নিচ্ছেন।”
এই দুটি শিশুর চিকিৎসায় শুরু থেকেই জড়িত স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।
তিনি বলেন, “এই দুটি শিশু যে এই পর্যায়ে এসেছে সেটাও বিরাট সাফল্য বলে আমি মনে করি। এই কাজটি করতে আমাদের দেশের চিকিৎসকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।”
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা সিএমএইচের কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুশিউল মনিরসহ চিকিৎসকরা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে রাবেয়াকে কথা বলার অনুরোধ করেন তার বাবা এবং চিকিৎসকরা। তবে সে তার বাবার সঙ্গে খুব আস্তে আস্তে কয়েকটি কথা বললেও মাইকের সামনে কিছু বলেনি। সংবাদ সম্মেলনের পুরোটা সময় রোকাইয়া হুইল চেয়ারে ঘুমিয়েছিল। সংবাদ সম্মেলন শেষে সবার সঙ্গে হেঁটে বের হয়ে যায় রাবেয়া।
২০১৬ সালের ১৬ জুলাই জোড়া মাথা নিয়ে জন্ম নেয় পাবনার চাটমোহরের আটলংকা গ্রামের রফিকুল ইসলাম ও তাসলিমা খাতুন দম্পতির সন্তান রাবেয়া-রোকাইয়া।
চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেলের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয় তাদের।
২০১৯ সালের ৪ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য দুই বোনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হাঙ্গেরি নেওয়া হয়। ২৫ জানুয়ারি সেখানেই প্রাথমিক অস্ত্রোপচার হয় ওই দুই শিশুর।
এরপর সে বছরের ৭ অগাস্ট ঢাকার সিএমএইচে প্রায় ৩৩ ঘণ্টা সময় নিয়ে দুই শিশুর জমজ মস্তিষ্ক আলাদা করার সবচেয়ে জটিল অস্ত্রোপচারটি করা হয়।
এই অস্ত্রোপচারে হাঙ্গেরি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সিএমএইচের নিউরো অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, নিউরো ও প্লাস্টিক সার্জনরাসহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট, হার্ট ফাউন্ডেশন, নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউট, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও শিশু হাসপাতালের শতাধিক সার্জন ও অ্যানেসথেসিওলজিস্ট অপারেশনে অংশ নেন।
এরপর ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি এবং ১৩ মার্চ আড়াই ঘণ্টার দুটি অস্ত্রোপচার হয়। এর মাধ্যমে তাদের মাথার ক্ষতস্থান নতুন কোষ দিয়ে পূর্ণ করা হয়।
২০২২ সালের শেষের দিকে রাবেয়ার মাথার বামদিকের চামড়ায় ক্ষত শুরু হয়, পরে তা বেড়ে মাথার খুলি দৃশ্যমান হয়। এই জটিলতা সমাধানে বাংলাদেশ ও হাঙ্গেরির চিকিৎসকরা ২০২২ সালের ৭ মার্চ সিএমএইচে ক্রেনিওপ্লাস্টির মাধ্যমে সেটি সমাধান করেন।