রনো ভাই ছিলেন শয়নে-স্বপনে, নিদ্রায়-জাগরণে, প্রজ্ঞায় ও বিশ্বাসে কমিউনিস্ট। তার বিশ্বাস ছিল মানুষের ওপর। তার অবস্থান ছিল মানুষের পক্ষে।
Published : 12 May 2024, 06:39 PM
অনেকেই জেনে থাকবেন সপ্তদশ শতকে ইংরেজ মহাকবি জন মিল্টন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উদ্দেশে একটি লিখিত বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই বক্তৃতাটি পরবর্তী সময়ে বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে ধ্রুপদী সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি মূলত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ কথার প্রকাশ। পরে বক্তৃতাটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয়েছিল। এটি দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তুলনামূলক সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যসূচি হিসেবে গৃহীত। রচনাটি মূলত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে নানা সূত্র ও যুক্তিপূর্ণ পদবাচ্যে সমৃদ্ধ।
এই রচনার পেছনে একটি প্রেক্ষাপট ছিল। মিল্টন বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন ১৬৪৪ সালে। তার আগে দুটি ঘটনায় মিল্টন ক্ষুদ্ধ ছিলেন। একটি ছিল ১৬৩৮ সালের। ওই সময় কবি জন লিলবার্নেকে বিধ্বংসী বই আমদানির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় এবং পাঁচশ পাউন্ড জরিমানা করা হয়। পরের ঘটনাটি ১৬৪৩ সালের। ওই বছর দেশটির সংসদ ‘অনুমোদন আদেশ ১৬৪৩’ শীর্ষক একটি অধ্যাদেশ সামনে নিয়ে আসে। একই বছর বিবাহ বিচ্ছেদের পক্ষে জন মিল্টন নিজের রচনার জন্য অনুমোদন জটিলতায় ভুক্তভোগী ছিলেন। এহেন বাস্তবতায় ক্ষুদ্ধ জন মিল্টন বিরল এই বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই বক্তৃতাই ‘এরিওপেজিটিকা’ (Areopagitica) শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
রনো ভাইয়ের মৃত্যুতে গল্পটি মনে পড়লেও সমসাময়িক ইতিহাসে হুবহু এরকম কোনো ঘটনা আমাদের দেশে নেই। তবে অন্য প্ৰেক্ষাপট আছে যা থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম রচনার উদাহরণ আমাদের সামনে দেখতে পাই। দেশের বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা, বাণিজ্য এবং বিজ্ঞানসহ সকল অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্যে একটি বিষয়সূচি বাধ্যতমূলক করেছে। বিষয়টির নাম ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’। বিষয়টি পড়ানোর জন্যে এমন একজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইতিহাসের শিক্ষার্থী নন, তার প্রাতিষ্ঠানিক পাণ্ডিত্যপূর্ণ ডিগ্রিও নেই। তিনি ইতিহাসবিদ ছিলেন না, ইতিহাসের শিক্ষকও ছিলেন না। এমনকি তিনি ইতিহাসের ছাত্রও ছিলেন না। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬০-এর দশকে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র এবং সে বিষয়েও পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি জেলজুলুমের কারণে। পরে অবশ্য আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন।
সেই তিনি ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ পড়াতে এসে দেখলেন শিক্ষার্থীদের উপকারে আসে এমন তাৎপর্যপূর্ণ বইপুস্তকের বড় অভাব। তিনি নির্ধারিত কোনো বইয়ের ওপর নির্ভর না করে প্রতিটি পাঠদানের পূর্বে বিষয়ভিত্তিক নোট আকারে বক্তৃতাগুলো লেখা শুরু করলেন। বক্তৃতা শেষে শিক্ষার্থীদের লিখিত নোটগুলো তাদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। একপর্যায়ে সেই বক্তৃতাগুলোই ‘পলাশী থেকে যুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামের তিনখণ্ডের ধ্রুপদী এক সাহিত্যকর্ম হিসেবে প্রকাশিত হয়।
বইটির লেখকের নাম হায়দার আকবর খান রনো। যিনি ঢাকার রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ‘রনো ভাই’ নাম সমধিক পরিচিত। এই রনো ভাইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার চেনা পরিচয় না থাকলেও ৯০-এর দশকের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকার সময়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’য় বেবী আপার (বেবী মওদুদ) সঙ্গে কাজ করার সময়ে এবং পরে আমার স্ত্রী রাশিদা আসমার সুবাদে রনো ভাই সম্পর্কে কিছুটা জানার সুযোগ পাই। এরপর ওনার লেখালেখির প্রতি আমি আগ্রহী হয়ে উঠি।
তার লেখা পড়ে মনে হয়েছে তিনি একজন উঁচু পর্যায়ের রাজনৈতিক দার্শনিক। তার লেখালেখির পরিধি ছিল সাহিত্য, রাজনীতি, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজ এবং দর্শনকে ঘিরে। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন সাহিত্যসমালোচকও। তিনি সাহিত্যের নিখাদ এবং পরিপূর্ণ রাজনৈতিক বিশ্লেষণ তুলে ধরতেন বস্তুনিষ্ঠতার জায়গা থেকে। আমাদের দেশের মাইকেল মধুসূদন, নজরুল, জীবনানন্দ, মানিক বন্দোপাধ্যায়, জসীম উদদীন, সুকান্ত, শওকত আলী থেকে শুরু করে বিদেশের শেক্সপিয়র, হেগেল, মার্কসসহ কত কত লেখক-দার্শনিকের রচনাবলীর আগাগোড়া যেন তার নখদর্পণে ছিল। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে খুব উঁচু অবস্থানে থেকেও তিনি ছিলেন সাধারণ্যে মিশে থাকা অসাধারণ এক প্রতিভা। তার লেখার একটা দর্শন ছিল। ওই দর্শন ছিল মানুষের পক্ষে কথা বলা। এই অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন পারিবারিকভাবেই।
পিতৃভূমি নড়াইল হলেও তিনি জন্মেছিলেন কলকাতায় ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে। ওইসময় প্রকৌশলী বাবার চাকরিসূত্রে তাদের পরিবার কলকাতায় বাস করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্থ প্রকৌশলী হিসেবে তার বাবার পদায়ন ছিল চট্টগ্রাম ফ্রন্টে। তার জন্মের সময় বাবা ছিলেন চট্টগ্রামে। পরে শৈশবে বাবার কাছে যুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছেন, শুনেছেন যুদ্ধের পরের এবং আগের অনেক গল্প এবং গল্পের পেছনের গল্পও।
ওই সময় কলকাতার কাগজের সব খবরে থাকত ব্রিটিশরা সব জায়গায় কেবল জিতছে আর জিতছে। কিন্তু এর বিপরীতে ভারতবর্ষের মানুষ বিশেষ করে কলকাতা আর বঙ্গের মানুষ ছিল নেতাজির সুভাষ চন্দ্র বসুর গুণগ্রাহী। নেতাজি যেহেতু জাপানের পক্ষের, তাই কলকাতার মানুষের মনে ছিল নেতাজি আর বাইরে তাদের ঘিরে থাকা ব্রিটিশদের খপ্পর। তাই খবরের কাগজ বিলি করার সময় হকাররা বলতেন, ‘সিধা পড়ে উল্টো বুঝুন’। কমরেড রনো ভাই সারাজীবন তার রাজনীতি ও লেখালেখির মাধ্যমে দেশের মানুষকে সত্যের খোঁজ দেবার চেষ্টা করে গেছেন, শৈশবে বাবার কাছ থেকে শোনা ব্রিটিশদের খপ্পরকে ইঙ্গিত করা ‘সিধা পড়ুন, উল্টো বুঝুন’ কথার তাৎপর্য রক্ষা করে।
রনো ভাইয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক চৰ্চার খবর জেনে আমার মধ্যে একটা প্রাকধারণা উদয় হয়েছিল জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশকারী তিনি বুঝি নিপাটি একজন রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। জীবনের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন জনদরদী কণ্ঠস্বর এবং গণমানুষের পক্ষের একজন সংগঠক। অভিজাত ঘরের সন্তান হয়েও ষাটের দশকের শুরুর দিকে তৎকালীন নিষেধাজ্ঞার খপ্পরে থাকা কমিউনিস্ট পার্টির গোপন পত্রিকা পড়ে সাম্যবাদী রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেন। সেই সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী গণআন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে দেশের কয়েকটি ফ্রন্টে গুরুত্বপূর্ণ কমান্ড পরিচালনা করেন। স্বাধীনতার পর তিনি সরকারের চার মূলনীতিকে সমর্থন করলেও সরকারের অনেক কিছুর সঙ্গে একমত হননি তার রাজনৈতিক দার্শনিক অবস্থান থেকেই। তিনি বাংলাদেশের বামপন্থীদের মস্কো-পিকিং পন্থায় ভাগ হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে নানা ভাগ-উপভাগের কারণগুলোর সৎ স্বীকারোক্তি করে গেছেন। সত্য প্রকাশে তার মাঝে দ্বিধা কাজ করেনি। একই কথা বলা যায় তার লেখালেখি নিয়েও।
তিনি রাজনৈতিক দ্বিমতকে ব্যক্তিগত রেষারেষির পর্যায়ে নিয়ে যাননি। কোনো একটি রাজনৈতিক দল ত্যাগ করলেও বন্ধুত্ব এবং সৌজন্যতা ত্যাগ করেননি। স্বাধীনতা-উত্তর মাওলানা ভাসানীর রাজনীতি রহস্যময় হয়ে উঠলে, তিনি ভাসানীর কাছে ছুটে গিয়েছিলেন, ভাসানীকে নিজের পক্ষে আনবার জন্য। কেননা, রনো ভাই ছিলেন শয়নে-স্বপনে, নিদ্রায়-জাগরণে, প্রজ্ঞায় ও বিশ্বাসে কমিউনিস্ট। তার বিশ্বাস ছিল মানুষের ওপর। তার অবস্থান ছিল মানুষের পক্ষে। তিনি ছিলেন মানুষের পক্ষের একজন কমরেড।
এই শতকের প্রথম দিকে নীতির দ্বন্দে তিনি ওয়ার্কার্স পার্টি ছেড়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন। দ্বন্দ্বের কারণটাও পরে আমরা সাধারণরা টের পেয়েছিলাম। যাদের সঙ্গে বিতণ্ডায় দল ছেড়ে দিলেন তাদের কেউ কেউ ক্ষমতার স্পর্শে নিজেরা এবং নিজেদের পারিবারিক বলয়ের কারও কারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তিবাণিজ্য, মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগও পরে গোপন থাকেনি। রনো ভাইয়ের মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সৎ রাজনীতিকেরা সমাজ ও রাজনীতির অনেক কিছুই আগে থেকেই দেখতে পেতেন।
বাংলাদেশের অনাগত বিপদের আভাসটিও তিনি দিয়ে গেছেন। বিপদটি হচ্ছে মৌলবাদের উত্থান। আওয়ামী লীগের বিকল্প যদি হয় বিএনপি; আওয়ামী লীগের ঘাড়ে সাম্প্রতিক ভূত হেফাজত আর বিএনপির অন্তরের ভূত জামায়াত। বামপন্থীদের জায়গাটি আর বামপন্থীদের হাতে নেই, এটি এখন নিয়ে নিয়েছে মৌলবাদীরা। তবে এর থেকে উত্তরণের জন্যে তিনি পথ বাতলে দিয়ে গেছেন শুভবাদের সকলকে সাংস্কৃতিক জাগরণের ডাক দেবার কথা বলে গেছেন। কিন্তু প্রশ্ন থাকে বাকি তবু। বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? প্রায় সকলেই যে সাদা আর কালো বিড়ালের লুকোচুরি দৌড়ে বেশ পারঙ্গম, মুখে তারা যত যাই বলুক আর আমরা উপর্যুপরি যতই শুনি ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহিষ্ণুতা’।
তিনি পুঁজিবাদের ডামাডোলে চুরিচামারি আর লুটপাটের টাকায় গজিয়ে ওঠা গণমাধ্যমকে অনেকটা এড়িয়ে চলেছেন। এর বিপরীতে তার কাজটি করে গেছেন। বক্তৃতাবাজির চেয়ে সংগঠন, রাজনীতি এবং মানুষের কল্যাণ নিয়ে গভীর ভাবনায় এবং এর প্রাসঙ্গিক তত্ত্ব নিয়ে নির্মোহ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সময়ের কাজটি তিনি সময়ে করেছেন, সময়ের ডাকটিও তিনি সময়ে দিতে চেয়েছেন। ১৯৮০-এর দশকে তার দুটি রচনা খুব সাড়া ফেলেছিল। একটি ছিল পিকিংপন্থী বন্ধুদের প্রতি আর অন্যটি ছিল মস্কোপন্থী বন্ধুদের প্রতি।
তিন মার্কসবাদের সরল-সহজ ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন ইতিবাচক বিশ্লেষণ ও প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরে। গ্রাম আর শহরের গরীব মানুষদের জেগে উঠবার তাগিদ বোধ করেছেন। সেই নিশানা তিনি দেখিয়ে গেছেন। গ্রামের অর্থনীতির বিশেষ করে কৃষির বিবর্তনের এবং পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে রাজনীতি ও জাগরণের নতুন কৌশলের তাগিদ দিয়ে গেছেন। তার তাগাদা যারা শুনবার তারা যদি শুনে থাকেন।
তিনি লেলিন এবং স্তালিনকে প্রগতি ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বরাজনীতির শুভবাদের পক্ষে নায়কের আসনে দেখে গেছেন। তা কেবল দেখে যাওয়াতে থেমে থাকেননি তিনি। লেখালেখিতেও তুলে ধরেছেন সেটা। পশ্চিমা বিশ্ব আন্তর্জাতিক ইতিহাসের নানা বাঁক ও মোড়কে নিজেদের স্বার্থে এবং সাম্রাজ্যবাদী খায়েশের পক্ষে বিবিধ তৎপরতা ও প্রকল্প হাতে নিয়ে থাকে। আর স্ট্যালিনের মতো নায়ককেও কলঙ্কিত করতে থাকে বারবার। এরকম একটি সিলসিলায় পশ্চিমা উচ্ছিষ্টভোগী আমাদের এক বুদ্ধিজীবী ঢাকার মঞ্চে স্তালিনকে বিকৃতভাবে তুলে ধরে একটি নাটক নির্দেশনা দেন ২০১৯ সালে। রনো ভাই এতে মর্মাহত হন। মর্মাহত হয়ে তিনি চুপ করে বসে থাকেননি। এটিকে তিনি ব্যক্তিগত রেষারেষি এবং শত্রুতার পর্যায়েও নিয়ে যাননি। তিনি এর বছর দুয়েকের মধ্যে ২০২১ সালে স্তালিনবিরোধী সকল ষড়যন্ত্র আর দেশি-বিদেশ সকল মিথ্যাচার খণ্ডন করে প্রকাশ করলেন 'স্তালিন' শিরোনামের এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। রনো ভাইয়ের রুচি ছিল এমনই। বুদ্ধিবৃত্তিক ফটকাবাজির জবাব বুদ্ধি দিয়েই দিয়েছেন, ফটকাবাজদের দুর্গন্ধ থেকে নিজেকে রক্ষা করেই।
তিনি জানতেন ইতিহাস মানে অতীত খুঁজে সত্য বের করা, একই সঙ্গে তিনি এটিও দেখিয়ে গেছেন সাম্প্রতিক ইতিহাস বলেও একটি কথা থাকে। এই তাৎপর্য বিশদভাবে প্রতীয়মান হয় দেশের গ্রাম আর শহরের, সমাজতন্ত্রের সত্তর বছর, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তার রচনাসম্ভারের দিকে নজর বুলালে।
গণমানুষের রাজনীতি তার জীবনে কেবল কথার কথা, লেখা বা বক্তৃতার বিষয় ছিল না। তিনি টঙ্গীর শ্রমিকদের সংঘটিত করতে বস্তিতে শ্রমিক তোলাতে থেকেছেন দিনের পর দিন, তারপর তার ডাকে শ্রমিকরা সাড়া দিয়েছে, রাষ্ট্রের গণবিরোধী সেনা আর পুলিশ শ্রমিক তল্লাটে তাকে কব্জা করার জন্যে ডজন ডজনবার হানা দিয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের মানবঢালসম আশ্রয় থেকে তাকে কব্জা করতে পারেনি। তিনি গ্রামের মানুষদেরও সংঘটিত করতে গ্রামে গ্রামে বিচরণ করেছেন। এসব নিয়ে তিনি আত্মজীবনী লিখে গেলে তা হতে পারত এক রোমাঞ্চকর সাহিত্যকর্ম।
তিনি আত্মমোহ আর আত্মপ্রচার এড়িয়ে চলেছেন। আমার মনে হয় আত্মমোহ আর আত্মপ্রচারের মধ্যে তিনি বুর্জোয়া ব্যাপারটার গন্ধ পেতেন। তাই তিনি একজন কমরেড হয়ে সেই প্রজ্ঞাটুকু সমুন্নত রেখে গেছেন সচেতনভাবে। আত্মজীবনীমূলক রচনা এড়িয়ে যাবার ইঙ্গিত তিনি রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করেছেন এক জায়গায়: “আমিও রেখে যাব করমুষ্টি ধূলি, আমার সমস্ত সুখ-দুঃখের শেষ পরিণাম রেখে যাব এই নামগ্রাসী আকারগ্ৰাসী সকল-পরিচয়গ্রাসী নিঃশব্দ ধূলিরাশির মধ্যে।”
বুদ্ধিবৃত্তিক দার্শনিক রাজনীতির অন্দর থেকে গ্রামের খেটে খাওয়া এবং শহরের শ্রমিক তল্লাটের মানুষদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে শুভবাদের পক্ষে রাজনীতি করে যাওয়া প্রজন্মের শেষ মানুষদের একজন ছিলেন কমরেড হায়দার আকবর খান রনো।