বিদ্যুতের দাম বাড়াবে মূল্যস্ফীতি, বিকল্পও ‘ছিল না‘

টানাটানির আয়ের মানুষকে হিসাব নিকাশের ফর্দ নিয়ে আবার ভাবতে হচ্ছে, যেমনটি চিন্তিত মিরপুরের মৌসুমী এক ফল বিক্রেতা।

জাফর আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 March 2024, 06:37 PM
Updated : 4 March 2024, 06:37 PM

মিরপুরের মৌসুমী ক্ষুদ্র এক ফল বিক্রেতা জাহিদ পাটোয়ারি হিসাব করে দেখেছেন বিদ্যুতের সবশেষ দাম বাড়ার কারণে তার বিল বেড়ে যাবে ১০০ টাকা করে। তার শঙ্কা বিদ্যুতের এ দফায় দাম বাড়ানোর অজুহাতে আরেক দফা বাড়বে পণ্যের দাম। এ দুই মিলে তার সীমিত আয় রোজগার দিয়ে মাসের খরচে আবারও বড় একটা চাপ তৈরি হবে।

এমনিতেই টানাটানির সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তার উপর এটা-সেটার দাম প্রতিমাসেই বাড়ানো হচ্ছে মন্তব্য করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে দেশে সব ধরনের জিনিপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরা কোনওভাবেই হিসাব মিলাইতে পারতেছি না।

“হিসাব করে দেখেছি এখন আমার বিদ্যুৎ বিল প্রায় ১০০ টাকা বেড়ে যাবে। আগে আমাদের গরমের মৌসুমে প্রায় ৫০০-৬০০ টাকা বিল আসত।

আবারও সকল জিনিসপত্রের দাম আরও এক দফা বেড়ে যাবে। আয় তো আর বাড়ছে না।“

অনেকটা হতাশার সুরে ছোট্ট পুঁজির এ ফল বিক্রেতা বলেন, “দুই বাচ্চা নিয়ে আমাদের চারজনের সংসার। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার পর থেকে আমরা আগের মতো খাইতে পারতেছি না।

“বাচ্চাদেরতো আর বুঝাইতে পারি না। তাদের জন্য সপ্তাহে একটা ফার্মের মুরগি কিনে প্রতি বেলায় একটু একটু করে দেয়। আর আমরা স্বামী স্ত্রী দুজনে প্রায় সময় আলু ভর্তা দিয়ে খাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে আমার মতো গরিব মানুষ অনাহরে-অর্ধাহারে পড়ে যেতে পারে।”

পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী বাজারে ভুগতে থাকা এ ব্যক্তির মতো একেবারে সীমিত আয়ের মানুষ হয়ত চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির হিসাব নিকাশ সেভাবে বোঝেন না। তবে বিদ্যুৎসহ কিছু সেবার মূল্য বাড়লে তা তাদের উপর কীভাবে চাপ তৈরি করে তা বুঝতেছেন বেশ কিছুদিন ধরেই।

সরকার খুচরায় বিদ্যুতের দাম সাড়ে ৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে যা ফেব্রুয়ারি থেকেই কার্যকর হবে। জাহিদ পাটোয়ারি যেভাবে তার মাসের হিসাব নিকাশে টান পড়বে বলে ভাবতে শুরু করেছেন তেমনি অর্থনীতির বিশ্লেষক ও গবেষকরা মনে করছেন, তা চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি আরও উসকে দিতে পারে।

গত জানুয়ারিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতির পারদ বেড়ে উঠেছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে।

তবে তারা আবার এও মনে করেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক এ সংকটের সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ছাড়া সরকারের হাতে বিকল্পও তেমন একটা ছিল না।

গত বৃহস্পতিবার সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম সাড়ে ৮ শতাংশ এবং পাইকারিতে ৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।

বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা অনুযায়ী “বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভারিতে গড়ে পাইকারিতে প্রতি ইউনিটের দর আগের ৬ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বেড়ে ৭ টাকা ০৪ পয়সা হয়েছে। খুচরায় ৮ টাকা ২৫ পয়সা থেকে বেড়ে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা হয়েছে।“

অর্থনীতির গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মূল্যস্ফীতি বাড়ার সবচেয়ে বড় উপাদান হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধি। তাই বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মূল্যস্ফীতি অবশ্যই বাড়বে। তবে সেটা দুই অংকের ঘরে পৌঁছাবে কি না সেটা এখনই বলা যাবে না।”

দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিকল্পও তেমন একটা নেই উল্লেখ করে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এর সাবেক এই জ্যেষ্ঠ গবেষক বলেন, “একদিকে আমাদের রাজস্ব (কম আদায়) পরিস্থিতি, ভর্তুকী কমিয়ে আনা এবং আইএমএফ এর শর্তপূরণ সকল দিক দিয়েই বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির বিকল্প খুব একটা ছিল না।”

তিনি বলেন, “বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে মানুষ ধরে নেয় যে, বিদ্যুতের দাম বাড়ছে এখন পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। আবার উৎপাদনকারীদের মধ্যেও পণ্যের দাম বাড়ানোর একটা প্রবণতা আছে। এমন পরিস্থিতিতে সকল পণ্যেরই দাম বেড়ে যায়।”

মূল্যস্ফীতির হিসাব নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন “মূল্যস্ফীতির হিসাব নির্ণয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির প্রভাব উল্লেখযোগ্য। এবারে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির প্রভাবও মূল্যস্ফীতির হিসাবে পড়বে। অর্থাৎ সাধারণ মূল্যস্ফীতি অবশ্যই বাড়বে।

“তবে কতটা বাড়বে তা বাজারের হালনাগাদ তথ্য এলেই বলা যাবে।“

অ্যাকাউন্টিং অনুবিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

চলতি মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা বিনিময় হার সমন্বয় করতে পারে এমন একটা আভাসের কথা তুলে ধরে জায়েদ বখত বলেন, “এতে ডলারের দাম বাজারমূল্যের প্রায় কাছাকাছি চলে আসতে পারে। তখন পণ্যের আমদানি ব্যয় আরও কিছুটা বেড়ে যেতে পারে। তখন মূল্যস্ফীতির ওপর আরেকটা চাপ আসতে পারে বলে আমার আশংকা।“

বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য ব্যাংকে ১ ডলারের বিপরীতে ১১০ টাকা। তবে নগদ কেনাবেচায়, রেমিটেন্সে ও খোলাবাজারে তা আরও কয়েক টাকা বেশি।

এমন প্রেক্ষাপটে সরকার রোজাকে সামনে রেখে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমদানি শুল্ক কমিয়ে এবং সরবরাহ বাড়িয়ে বাজার সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র‌্যাপিড) চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক মনে করেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং দেশেএর অর্থনীতির বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অন্যদিকে ব্যালান্স অব পেমেন্টে (চলতি হিসাব ভারসাম্য) ক্রাইসিস থাকলে সরকারের পক্ষে নীতি নেওয়াটা অনেক কঠিন হয়ে যায়।

“আমাদের রাজস্ব কম হওয়ায় সম্পদের অপ্রতুলতা আছে। এরমধ্যে যদি ভর্তুকি টানতে হলে সরকারের ব্যয় আরও বেড়ে যায়। তখন বৈদেশিক খাত থেকে আরও বেশি ঋণ নিতে হবে। সেই ঋণ আবার দেশের অর্থনীতির ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে, এই রকম একটি সমস্যায় পড়ে যেতে পারে সরকার।“

এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েই সরকারকে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

আরও পড়ুন:

Also Read: বিদ্যুতের দাম বাড়ল খুচরায় ৮.৫%, পাইকারিতে ৫%

Also Read: মার্চে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে: প্রতিমন্ত্রী

Also Read: রোজার আগে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’: রিজভী

Also Read: বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দাম বাড়ল

Also Read: ভর্তুকির চাপ কমাতে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি: মন্ত্রণালয়