খুচরায় যারা বেশি ব্যবহার করেন তাদের বেশি বেড়েছে এবং যারা ‘লাইফ লাইনে’ বা একেবারে কম ব্যবহার করেন তাদের সামান্যই বেড়েছে, বলেন বিদ্যুৎ সচিব।
Published : 29 Feb 2024, 07:53 PM
ভর্তুকি সমন্বয়ের অংশ হিসেবে নতুন বছরে বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা মূল্য বাড়ানো শুরু করেছে সরকার।
এর অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার রাতে পাইকারিতে গড়ে ৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, খুচরায় বাড়ানো হয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। এরমধ্যে যারা বেশি ব্যবহার করেন তাদের বেশি বেড়েছে এবং যারা ‘লাইফ লাইন’ বা একেবারে কম ব্যবহার করেন তাদের সামান্যই বেড়েছে।
রাতেই একাধিক প্রজ্ঞাপনে বিদ্যুতের সমন্বয় করা নতুন মূল্যহার ও আনুষঙ্গিক চার্জ জানিয়ে দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
বিদ্যুৎ সচিব বলেন, “বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভারিতে গড়ে পাইকারিতে প্রতি ইউনিটের দর আগের ৬ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বেড়ে ৭ টাকা ০৪ পয়সা হয়েছে। খুচরায় ৮ টাকা ২৫ পয়সা থেকে বেড়ে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা হয়েছে। অর্থাৎ খুচরায় ভারিত গড়ে বাড়ল ৭০ পয়সা।”
ফেব্রুয়ারি থেকে খুচরা বিদ্যুতের দাম ও মাসুল
খুচরা বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করে জারি করা প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, পাইকারির মতো খুচরা বিদ্যুতের বিলও ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কার্যকর হবে।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি এতে ডিমান্ড চার্জও আগের মাসিক ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪২ টাকা করা হয়েছে। নিম্নচাপ (২৩০ ও ৪০০ ভোল্ট) বা এলটি গ্রাহকদের মধ্যে আবাসিক গ্রাহকদের (এলটি-এ) জন্য এ চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর সঙ্গে নতুন হার অনুযায়ী, মাসে ৫০ ইউনিটের কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের ইউনিটপ্রতি আগের ৪ টাকা ৩৫ পয়সার পরিবর্তে এখন দিতে হবে ৪ টাকা ৬৩ পয়সা।
>> ব্যবহারসীমা ৭৫ ইউনিটের মধ্যে থাকলে ইউনিটপ্রতি আগের ৪ টাকা ৮৫ পয়সার পরিবর্তে এখন গুনতে হবে ৫ টাকা ২৬ পয়সা।
>> ব্যবহার ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিটের মধ্যে থাকলে ইউনিটপ্রতি আগের ৬ টাকা ৬৩ পয়সার পরিবর্তে এখন গুনতে হবে ৭ টাকা ২০ পয়সা।
>> ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীরা ইউনিটপ্রতি ৬ টাকা ৯৫ পয়সার পরিবর্তে এখন গুনবেন ৭ টাকা ৫৯ পয়সা।
>> ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের মধ্যে ব্যবহারকারীরা ইউনিটপ্রতি আগের ৭টাকা ৩৪ পয়সার পরিবর্তে এখন দেবেন ৮ টাকা ০২ পয়সা।
>> ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের মধ্যে ব্যবহারকারীরা ইউনিটপ্রতি আগের ১১ টাকা ৫১ পয়সার পরিবর্তে এখন দেবেন ১২ টাকা ৬৭ পয়সা।
>> ৬০১ ইউনিট থেকে বেশি ব্যবহারকারীরা ইউনিটপ্রতি আগের ১৩ টাকা ২৬ পয়সার পরিবর্তে এখন গুনবেন ১৪ টাকা ৬১ পয়সা।
এলটি-বি বা সেচ ও কৃষিকাজের গ্রাহকরা মাসিক ডিমান্ড চার্জ ৩৫ টাকার পরিবর্তে ৪২ টাকা করে দেবেন।
>> সেই সঙ্গে এনার্জি চার্জ আগের ৪ টাকা ৮২ পয়সার পরিবর্তে ৫ টাকা ২৫ পয়সা করে দেবেন।
এলটি-সি ১ বা ক্ষুদ্র শিল্পের গ্রাহকরা মাসিক ডিমান্ড চার্জ দেবেন ৪০ টাকার পরিবর্তে ৪৮ টাকা।
>> এ খাতের গ্রাহকরা বিদ্যুতের বিল ইউনিটপ্রতি আগের ৯ টাকা ৮৮ পয়সার পরিবর্তে এখন থেকে দেবেন ১০ টাকা ৭৬ পয়সা করে।
এলটি-সি ২ বা নির্মাণ খাতের জন্য ডিমান্ড চার্জ আগের ১০০ টাকার পরিবর্তে ১২০ টাকা করা হয়েছে।
>> এ খাতের জন্য ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে আগের ১৩ টাকা ৮৯ পয়সার পরিবর্তে ১৫ টাকা ১৫ পয়সা।
এলটি-ডি ১ বা শিক্ষা, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল গ্রাহকদের জন্য ডিমান্ড চার্জ আগের ৫০ টাকার পরিবর্তে ৬০ টাকা করা হয়েছে।
>> এ ধরনের গ্রাহকরা বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দাম ৬ টাকা ৯৭ পয়সার পরিবর্তে করা হয়েছে ৭ টাকা ৫৫ পয়সা।
এলটি-ডি ২ বা রাস্তার বাতি ও পানির পাম্পের জন্য ডিমান্ড চার্জ ৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯০ টাকা করা হয়েছে।
>> এ খাতে বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি মূল্য ৮ টাকা ৯১ পয়সার পরিবর্তে ৯ টাকা ৭১ পয়সা করা হয়েছে।
এলটি-ডি ৩ বা ব্যাটারি চার্জিং স্টেশনের ডিমান্ড চার্জ আগের ৭৫ টাকার পরিবর্তে ৯০ টাকা করা হয়েছে।
>> এমন গ্রাহকরা বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি মূল্য ফ্ল্যাট ৮ টাকা ৮৪ পয়সার পরিবর্তে ৯ টাকা ৬২ পয়সা করা হচ্ছে।
এলটি-ই বা বাণিজ্যিক ও অফিসের গ্রাহকদের ডিমান্ড চার্জ ৭৫ টাকার পরিবর্তে করা হয়েছে ৯০ টাকা।
>> এ খাতে বিদ্যুতের দাম ফ্ল্যাট ১১ টাকা ৯৩ পয়সার পরিবর্তে করা হয়েছে ১৩ টাকা ০১ পয়সা।
এলটি-টি বা অস্থায়ী গ্রাহকদের ডিমান্ড চার্জ ১০০ টাকার পরিবর্তে ১২০ টাকা করা হয়েছে।
>> বিদ্যুতের মূল্য ১৮ টাকা ৫২ পয়সার পরিবর্তে করা হয়েছে ২০ টাকা ১৭ পয়সা।
একইভাবে ১১ কেভি বা মধ্যম চাপ, ৩৩ কেভি বা উচ্চ চাপ ১৩২ কেভি ও ২৩০ কেভি বা অতি উচ্চ চাপের গ্রাহকদের জন্য নতুন করে বিদ্যুতের দর সাজানো হয়েছে।
এমটি-৬ বা মধ্যম চাপের অস্থায়ী গ্রাহকরা ইউনিটপ্রতি ১৯ টাকা ০২ পয়সা হারে বিদ্যুৎ বিল দেবেন, যা তালিকায় সর্বোচ্চ। তাদের ডিমান্ড চার্জ ১২০ টাকা।
পাইকারি দর
ইতোমধ্যে বিদ্যুতের পাইকারি বিদ্যুতের হুইলিং চার্জ ও বিতরণ সংস্থাগুলোর জন্য পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহার ঘোষণা করে দুটি প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে যা ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কার্যকর হবে।
পাইকারি বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, “সরকার ভর্তুকি সমন্বয়ের লক্ষ্যে, জনস্বার্থে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক বিভিন্ন বিতরণ সংস্থা বা কোম্পানিকে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার…পুনঃনির্ধারণ করিল।“
নতুন প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির বা ডিপিডিসির ২৩০ কেভি লাইনে পাইকারি মূল্য আগের প্রতি ইউনিট ৮ টাকা ১০৪০ পয়সা থেকে বেড়ে এখন হয়েছে ৮ টাকা ৪৪ পয়সা। ১৩২ কেভি লাইনের বিদ্যুতের মূল্য আগের ইউনিটপ্রতি ৮ টাকা ১৩ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮ টাকা ৪৭ পয়সা।
এছাড়া ৩৩ কেভি লাইনের বিদ্যুতের মূল্য ইউনিট প্রতি ৮ টাকা ২২ পয়সা থেকে বেড়ে এখন হয়েছে ৮ টাকা ৫৬ পয়সা।
একইভাবে পিডিবিসহ অন্য পাঁচটি বিতরণ কোম্পানির জন্য পাইকারি বিদ্যুতের দাম কাছাকাছি হারে বাড়ানো বা সমন্বয় করা হয়েছে।
কী বললেন প্রতিমন্ত্রী
এর আগে দুপুরে সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, এখন বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ পড়ছে ১২ টাকার মতো। বিক্রি করা হচ্ছে ৭ টাকায়। চলতি বছর বিদ্যুতে ৪৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। পাইকারি দর ৬ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৭ টাকা ০৪ পয়সা করা হয়েছে। এতে ভর্তুকির পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকা কমবে।
পিডিবির তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, দাম বাড়ানোর পরও প্রায় ৩৬ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।
ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছে ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায়। তেল-গ্যাস ও কয়লার আন্তর্জাতিক বাজারদর ক্ষেত্র বিশেষে একই থাকলেও আগের চেয়ে ডলার প্রতি ৪০ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। এখানেই বিশাল ব্যবধান তৈরি হয়েছে। ডলারের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য কাজ চলছে।
তিনি বলেন, “জ্বালানি তেলের দাম আধুনিক প্রাইসিংয়ে যাচ্ছি। ইনডেক্স ও ফর্মুলা করা হয়েছে। প্রতিমাসে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় হবে।“
বিদ্যুতের দাম বাড়ছে সর্বোচ্চ ৭০ পয়সা: প্রতিমন্ত্রী
বিদ্যুৎ বিভাগের ব্যাখ্যা
রাতে বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয়ের বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের ব্যাখ্যায় বলা হয়, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিদ্যুৎ বিভাগ মনে করে এ সমন্বয় গ্রাহকদের কাছে সহনীয় হবে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকেই নতুন বিল সমন্বয় কার্যকর হবে।
“সরকার, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩ এর ধারা ৩৪ক তে প্রদত্ত্ব ক্ষমতাবলে, জনস্বার্থে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সঞ্চালন নিশ্চিত করতে হুইলিং চার্জ, বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার ও খুচরা মূল্যহার এবং বিদ্যুৎ সম্পর্কিত বিবিধ সেবার জন্য চার্জ/ফি পুন: নির্ধারণ করেছে।“
এতে বলা হয়, বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য প্রতি ইউনিটে ৩৪ পয়সা সমন্বয় করা হয়েছে। (প্রতি ইউনিট ৬.৭০ টাকা হতে ৭.০৪ টাকা হয়েছে, গড় সমন্বয়-৫ শতাংশ)।
>> খুচরা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট গড়ে ৭০ পয়সা সমন্বয় করা হয়েছে। (প্রতি ইউনিট ৮.২৫ টাকার বিপরীতে ৮.৯৫ টাকা হয়েছে, গড় সমন্বয় ৮.৫০ শতাংশ)।
>> লাইফ লাইন গ্রাহকের ৪.৩৫ টাকা হতে ৪.৬৩ টাকা করা হয়েছে, সমন্বয় ২৮ পয়সা (১কোটি ৬৫ লাখ লাইফ লাইন গ্রাহক রয়েছে)।