অধ্যাদেশ আকারে জারি করলেই গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা কাঠামো ও কর্তৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে।
Published : 17 Apr 2025, 09:38 PM
শান্তিতে নোবেলজয়ী ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর সরকারের কর্তৃত্ব কমিয়ে গ্রাহক বা উপকারভোগীর ক্ষমতা বাড়াতে আইন সংশোধনের প্রস্তাবে সায় দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘গ্রামীণ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর খসড়ায় নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এখন রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা সেরে অধ্যাদেশ আকারে জারি করলেই গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা কাঠামো ও কর্তৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে।
এই ব্যাংকে সরকারের অংশীদারত্ব ২৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। বাকি ৯০ শতাংশ থাকবে উপকারভোগীদের হাতে।
অধ্যাদেশ জারি হলে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকটির কর্তৃত্ব চলে যাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে।
উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তগুলো ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেন, “আগে গ্রামীণ ব্যাংক একটা মূল্যবোধ নিয়ে কাজ করতো। যারা গ্রামীণ ব্যাংকের উপকারভোগী, তাদের এই ব্যাংক পরিচালনায় ভূমিকা ছিল। কিন্তু বিগত সময়ে বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে রাজনৈতিকভাবে টার্গেট করা হয়েছিল এবং গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানায় তার সেই দর্শন থেকে সরিয়ে অনেকাংশে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়।
“আজকের অধ্যাদেশটা সংশোধনের ফলে যেটা দাঁড়াল, তা হচ্ছে, পরিশোধিত মূলধন আগে ছিল সরকার ২৫ শতাংশ আর উপকারভোগীরা ৭৫ শতাংশ। এখন সরকার থাকবে ১০ শতাংশ আর উপকারভোগীরা ৯০ শতাংশ।”
উপদেষ্টা বলেন, আগে গ্রামীণ ব্যাংক কেবল ভূমিহীনদের জন্য কাজ করত। এখন বিত্তহীনদের একটি সংজ্ঞা সংযোজন করা হয়েছে।
“ইউনিয়ন পরিষদের পরিসর থেকে বের করে সিটি করপোরেশন, পৌরসভাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরিচালনা বোর্ডের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যারা উপকারভোগী তাদের মধ্য থেকে নয়জন নির্বাচিত হয়ে আসবেন। সেই নয়জনের মধ্য থেকে আবার তিনজন মনোনীত হবেন। তাদের মধ্যে থেকেই একজন চেয়ারম্যান নিযুক্ত হবেন। অধ্যাদেশে গ্রামীণ ব্যাংককে জনস্বার্থ সংস্থা হিসাবে বিবেচনা করার বিধান আনা হয়েছে।“
দেশের প্রান্তিক ও দারিদ্র্য পীড়িত জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারীদের জন্য জামানত ছাড়া ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের উদ্দেশ্যে ১৯৮৩ সালে ‘গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ’ এর মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক গঠন করা হয়।
পরে অধ্যাদেশটি বাতিল করে ২০১৩ সালে ‘গ্রামীণ ব্যাংক আইন‘ প্রণয়ন করা হয়। সেই আইনেই এতদিন ব্যাংকটি পরিচালিত হচ্ছিল।
১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দীর্ঘ ২৮ বছর গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি এখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান।
ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনের চেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ও মুহাম্মদ ইউনূসকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
অধ্যাদেশ জারি হলে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন হবে ৩০০ কোটি টাকা। ঋণগ্রহীতারা ধীরে ধীরে মূলধনে অবদান বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ মালিকানা অর্জন করবেন। বোর্ড ঘোষিত যে কোনো লভ্যাংশ মূলধনের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে বিতরণ করা হবে।
আইন সংশোধনের ফলে চেয়ারম্যান নিয়োগে সরকারের ভূমিকাও আর থাকবে না। চেয়ারম্যান নিয়োগ হবে পর্ষদের সদস্যদের ভোটে। ১২ সদস্যর পর্ষদের ১১ জনই ব্যাংকের গ্রাহকদের ভোটে নির্বাচিত হবেন। চেয়ারম্যানের ক্ষমতা কমবে, সেই ক্ষমতা যাবে পর্ষদের হাতে। পর্ষদ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেবে বাছাই কমিটির মাধ্যমে।
অধ্যাদেশের বিধি তৈরিসহ উদ্ভূত কোনো সমস্যায় সরকারের পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে গ্রামীণ ব্যাংকের পর্ষদকে।
গ্রামীণ ব্যাংক পল্লী এলাকার পাশাপাশি সারা দেশে শহর এলাকাতেও যাতে শাখা খুলতে পারে সেই সুযোগ রাখা হয়েছে অনুমোদিত খসড়ায়।
এখন ব্যাংকের শাখা খুলতে সরকারের অনুমোদন নিতে হয়। অধ্যাদেশ জারি হলে সেই অনুমোদন দেব বাংলাদেশ ব্যাংক।
বর্তমান আইনে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জোবরা গ্রামে মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার কোনো উল্লেখ নেই। অধ্যাদেশে এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা যুক্ত করা হচ্ছে।
সেখানে বলা হয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প বলতে ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধীনে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার জোবরা গ্রামে পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমকে বোঝায়। এ প্রকল্প পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পায় এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক এতে অংশগ্রহণ করে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অধ্যাপক ইউনূসকে অবসরের বয়স পেরিয়ে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে আদালতে গিয়েও তিনি আর সেই পদে ফিরতে পারেননি।
গত ১৫ বছরে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মসূচি এবং ইউনূসকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছরের ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে তিনি দেশত্যাগ করলে সেই ইউনূসের নেতৃত্বেই অন্তর্বর্তী স রকার গঠিত হয়।
আরো তিন অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন
বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘গ্রামীণ ব্যাংক আইন, ২০১৩’ যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রণীত ‘গ্রামীণ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিং-সাপেক্ষে উপদেষ্টা পরিষদে চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়েছে।
বৈঠকে ‘সরকারি হিসাব নিরীক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়াও ভেটিং-সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
উপদেষ্টা রিজওয়ানা বলেন, “সরকারি হিসাব নিরীক্ষা নিয়ে ১৯৭৪ সালের একটা আইন ছিল। সেই আইনের সম্পূরক হিসাবে এই অধ্যাদেশের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অডিটের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কিছু স্ট্যান্ডার্ড আছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক কিছু স্ট্যান্ডার্ড ও প্র্যাক্টিসগুলো যেন বাংলাদেশে কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেলরা মেনে চলেন। যাতে করে সরকারি অর্থের সঠিক ব্যয় নিশ্চিত করা যায়।”
বৈঠকে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিং-সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়েছে।
এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একক আধিপত্য কমিয়ে আনা।
এ বিষয়ে উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “একটা শিল্প গোষ্ঠী কীভাবে কয়েকটা ব্যাংকে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে কত টাকা এই দেশ থেকে সরিয়ে নিয়েছে এবং তহবিল তসরুফ করেছে সেটা অনেকেই জানেন। এই জিনিসটা ভবিষ্যতে যাতে আর না হতে পারে, সেজন্য করপোরেট সেক্টরে, ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা ও আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ পাস করা হয়েছে। আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আমরা দিচ্ছি।”
বৈঠকে আরেকটি সম্পূরক অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন হয় রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে পৃথক করার জন্য।
এ বিষয়ে প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, “জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের একটা সুপারিশের ভিত্তিতে এই অধ্যাদেশটা করা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে নীতি প্রণয়ন ও রাজস্ব আদায় বাস্তবায়ন করা দুটো আলাদা প্রতিষ্ঠান হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করেছিলেন। সেই মোতাবেক দুটি কাজকে আমরা আলাদা করছি।”
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।