টেলিকম ২০১৯: টাকা আদায়ে টানাপোড়ন, আলোচনায় ফাইভ-জি

নিরীক্ষা আপত্তির প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার বিরোধে দেশের দুই বড় মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবির সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির টানাপোড়েনে পার হল ২০১৯।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Dec 2019, 06:55 AM
Updated : 5 Jan 2020, 08:39 AM

ওই টাকা আদায়ে অপারেটরের লাইসেন্স বাতিলের হুমকি, ব্যান্ডউইথ ক্যাপাসিটি সীমিত করাসহ ‘এনওসি’ বন্ধের মত কঠোর পদেক্ষেপ নেয় বিটিআরসি, যা প্রভাব ফেলেছে গ্রাকদের ওপর।

বিষয়টি এখন গড়িয়েছে আদালতে, গ্রামীণফোনের মালিক কোম্পানি টেলিনর সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসার জন্য রাষ্ট্রপতিকেও উকিল নোটিস পাঠিয়েছে।    

অবশ্য নতুন বছর এই বিরোধের সমাধান নিয়ে আসবে বলেই আশা প্রকাশ করেছে অপর অপারেটর রবি।

এ বছর দেশে মোবাইল ফোনের গ্রাহক সংখ্যা পৌঁছে গেছে প্রায় সাড়ে ১৬ কোটিতে। আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটির ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। এরই মধ্যে বিদায়ী বছরে আলোচনায় এসেছে দেশে পঞ্চম প্রজন্মের (ফাইভ-জি) মোবাইল ফোন সেবা চালুর প্রস্তুতি।

অপারেটর বনাম নিয়ন্ত্রক

নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গ্রামীণফোনের কাছে ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা পাওনা চেয়ে গত এপ্রিল মাসে চিঠি দিয়ে টেলিযোগাযাগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিটিআরসি। পাশাপাশি রবির কাছে চাওয়া হয় ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

কয়েক দফা চেষ্টায় সেই টাকা আদায় করতে না পেরে লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দিয়ে নোটিস পাঠানো হয় দুই অপারেটরকে। বিটিআরসির দাবি করা টাকার ওই অঙ্ক নিয়ে আপত্তি তুলে নিরীক্ষাকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করে গ্রামীণফোন ও রবি।

তাগাদা দেওয়ার পরও ওই টাকা পরিশোধ না করার যুক্তি দেখিয়ে গত ৪ জুলাই গ্রামীণফোনের ব্যান্ডউইথ ক্যাপাসিটি ৩০ শতাংশ এবং রবির ১৫ শতাংশ সীমিত করতে আইআইজিগুলোকে নির্দেশ দেয় বিটিআরসি।

কিন্তু তাতে গ্রাহকের সমস্যা হওয়ায় ১৩ দিনের মাথায় গত ১৬ জুলাই ওই নির্দেশনা প্রত্যাহার করে নেয় বিটিআরসি। তবে কমিশনের চেয়ারম্যান জহুরুল হক সেদিনই জানিয়ে দেন, টাকা না দিলে ‘এনওসি’ বন্ধের মত কঠোর পদক্ষেপে যাবেন তারা। 

এর ধারাবাহিকতায় কয়েক দিন পর গ্রামীণফোন ও রবিকে বিভিন্ন প্রকার সেবার অনুমোদন ও অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দেওয়া স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয় বিটিআরসি। এর ফলে আটকে যায় দুই অপারেটরের ফোরজি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের কাজ।

অপারেটর দুটি বলেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওই পদক্ষেপের ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের পাশাপাশি এ খাতের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর ‘নেতিবাচক প্রভাব’ পড়ছে। এ সমস্যা দিন দিন বেড়ে চললেও বছর শেষেও নিষেধাজ্ঞা ওঠেনি।

বিটিআরসি সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তিতে রাজি না হওয়ায় দুই অপারেটর আদালতে যায়। বিরোধ মেটাতে উদ্যোগী হন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল।

তাতে মীমাংসা না হওয়ায় গ্রামীণফোন ও বিটিআরসির কর্মকর্তাদের মধ্যে দুই দফা বৈঠকে কোনো সফলতা না আসায় অপারেটরকেই দায়ী করেন অর্থমন্ত্রী।

টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিটিআরসির সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার নিরীক্ষা দাবির নোটিসের ওপর হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখে গত ২৪ নভেম্বর গ্রামীণফোনকে অবিলম্বে দুই হাজার কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

কিন্তু সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য এরপর রাষ্ট্রপতিকে উকিল নোটিশ পাঠায় গ্রামীণফোনের মালিক কোম্পানি টেলিনর। 

বিষয়টিকে দুঃখজনক হিসেবে বর্ণনা করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, “বাংলাদেশে ব্যবসা করবে একটি প্রতিষ্ঠান, সেই প্রতিষ্ঠানটি আমাদের রাষ্ট্রপতিকে উকিল নোটিস দিয়ে আর্বিট্রেশনের জন্য চাপ দেবে, এটা বোধহয় খুব সহজে গ্রহণ করার মত অবস্থা না।”

নিরীক্ষা আপত্তির ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকার বিরোধ নিয়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অপারেটর রবিও উচ্চ আদালতে গেছে। বিষয়ও এখনও বিচারধীন।

রবির চিফ কর্পোরেটর অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার শাহেদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “২০১৯ সাল টেলিকম সেক্টরের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। বিতর্কিত নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে এই সেক্টরে অচলবস্থার সৃষ্টি হয়। যার ফলে দুই হাজার কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ হতে বঞ্চিত হয় বাংলাদেশ। টেলিকম সংশ্লিষ্ট অনেক প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ সংকুচিত হয় এবং তারা আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়।”

নতুন বছরে সকল বিতর্কের অবসান হবে আশা প্রকাশ করে শাহেদ আলম বলেন, “নতুন বছরে আমরা নতুন নতুন টেকনোলজি ও ইনোভেটিভ সার্ভিস দিয়ে আমাদের গ্রাহক তথা দেশের সাধারণ জনগণের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারব বলে আমাদের বিশ্বাস।”

গত বছরের মূল্যায়ন ও আগামী বছরের সম্ভাবনা নিয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যান জহুরুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বর্তমানে টেলিযোগাযোগ খাত সোনালী সময় অতিক্রম করছে। অন্যান্য বছরগুলোর মত ২০১৯ সাল ছিল ডিজিটাল উন্নয়ন ও অগ্রগতির বছর। এজন্য আমি এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

“আশা করছি সরকারি, বেসরকারি এবং এ খাতের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত সকলের সহযোগিতায় ২০২০ সাল অতীতের সকল উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে অতিক্রম করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে।”

রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে শনিবার বিশ্ব টেলিযোগাযোগ ও তথ্য সংঘ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

আলোচনায় ফাইভ-জি

পুরো বছর ধরেই ফাইভ-জি প্রযুক্তি চালুর প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনায় ছিল টেলিকম খাত। ২০১৮ সালে ফাইভ জি প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক কার্যক্রমও চালানো হয়।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলে আসছেন ২০২০ সালে ফাইভ-জি জগতে পা দেবে বাংলাদেশ। আর এটি নতুন সভ্যতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।

দেশে ফাইভ-জি মোবাইল সেবা চালুর উদ্যোগ হিসেবে আগামী বছরের জানুয়ারী নাগাদ একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়নের দিকে এগোচ্ছে বিটিআরসি। ২০২৬ সালের মধ্যে সারাদেশে ফাইভ-জি সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়ে ইতোমধ্যে রোডম্যাপও তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশে রাষ্ট্রয়াত্ত অপারেটর টেলিটকের মাধ্যমেই ফাইভ-জি সেবার শুরু হবে বলে ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী।

পুরনো খবর: