তবে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে’ আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার জন্য আগে একটি ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ তৈরির ওপর জোর দিচ্ছেন গ্রামীণফোনের কর্তারা।
ঠিক কোন কোন বিষয়ে দুই পক্ষের দর কষাকষি হবে, কোন বিষয়গুলো আলোচনা থেকে বাদ যাবে, কোন প্রক্রিয়ায় অডিট আপত্তির দাবি হিসাব করা হবে, কে কতটা ছাড় দেবে- এসব বিষয়ে আগে একটি সীমারেখা টেনে নিয়ে তারপর তারা মূল আলোচনা শুরু করতে চাইছেন। আর একেই তারা বলছেন আলোচনার ‘ফ্রেমওয়ার্ক’।
গ্রামীণফোনের ডেপুটি সিইও এবং সিএমও ইয়াসির আজমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই ফ্রেমওয়ার্কে বলা হবে কীভাবে আমরা আপত্তিগুলোর সমাধান করব। একটি অ্যামিকেবল ও ট্রান্সপারেন্ট ওয়েতে সমাধান বের হয়ে আসবে, আমরা আশাবাদী।”
গ্রামীণফোনের কাছে নিরীক্ষা আপত্তির দাবির ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং রবির কাছে ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে বলে দাবি করে আসছে বিটিআরসি।
কয়েক দফা চেষ্টায় সেই টাকা আদায় করতে না পেরে লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দিয়ে নোটিস পাঠানো হয়েছে দুই অপারেটরকে।
অন্যদিকে টাকার ওই অঙ্ক নিয়ে আপত্তি রয়েছে গ্রামীণফোন ও রবির; বিটিআরসি সালিশের মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তিতে রাজি না হওয়ায় দুই অপারেটর ইতোমধ্যে আদালতে গেছে।
খোদ অর্থমন্ত্রী এই বিরোধ মীমাংসার উদ্যোগ নেওয়ার পর গ্রামীণফোনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নানা পর্যায়ে আলোচনা শুরু করেছে সরকার।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ও বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হককে নিয়ে ইতোমধ্যে দুই দফা গ্রামীণফোনের সিইও মাইকেল ফোলির সঙ্গে বৈঠক করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
অর্থমন্ত্রী নিরীক্ষা আপত্তির টাকা নিয়ে গ্রামীণফোন ও রবিকে যেমন আশ্বস্ত করেছেন, তেমনি এনবিআরকেও পথ দেখিয়েছেন।
গ্রামীণফোনের ডেপুটি সিইও এবং সিএমও ইয়াসির আজমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অডিট আপত্তির ওই ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকার মধ্যে মূল বকেয়ার (প্রিন্সিপাল অ্যামাউন্ট) পরিমাণ ধরা হয়েছে দুই হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। বিলম্বের মাশুল ও সুদ মিলিয়ে ধরা হয়েছে ৬ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। আর এনবিআরের পাওনা ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা।
“আমরা প্রথম থেকে বলছি, এই নিরীক্ষায় মেজারমেন্টের যে প্রক্রিয়া ফলো করা হয়েছে সেখানে আপত্তি রয়েছে এবং প্রিন্সিপাল অ্যামাউন্ট নিয়ে আমাদের প্রশ্ন রয়েছে।”
প্রক্রিয়া নিয়ে গ্রামীণ ফোনের আপত্তি কেন?
ইয়াসির আজমান বলেন, তারা প্রথম অডিটের ক্লেইম পেয়েছিলেন ২০১৯ সালের এপ্রিলে। সেখানে বলা হয়, ২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণফোন যে রেসপন্স করেছিল, তার ভিত্তিতে ওই অডিট আপত্তি দেওয়া হয়েছে।
আর প্রিন্সিপাল অ্যামাউন্ট নিয়ে গ্রামীণ ফোনের আপত্তি কোথায়?
ইয়াসির আজমান বলেন, ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে তরঙ্গ ব্যবহারের চার্জ হিসেবে গ্রামীণ ফোনকে যে টাকা দিতে বলা হয়েছিল, সেখানে বিটিআরসি ভুল করে কম চেয়েছে বলে অডিটর মনে করছে।
“এখন আমাদের বলা হচ্ছে গ্যাপ অ্যামাউন্ট দিতে হবে এবং কম্পাউন্ড রেইটে ইন্টারেস্ট দিতে হবে। প্রতিবছর অডিট করার কথা, তা তারা করেনি। বিটিআরসি যেটা ক্লেইম করেছে সেটা ভুল। আর আমাদের তারা বলছে সেজন্য ইন্টারেস্ট দিতে হবে!”
প্রিন্সিপাল অ্যামাউন্ট যেভাবে হিসাব করা হয়েছে, সেখানেও ‘ভুল’ রয়েছে দলে দাবি করেন গ্রামীণফোনের ডেপুটি সিইও।
শোনা যাচ্ছে, বিলম্বের মাশুল বাদ দিয়ে এখন শুধু নিরীক্ষা আপত্তির মূল টাকা পরিশোধের বিষয়ে গ্রামীণ ফোনের সঙ্গে সরকারের আলোচনা চলছে। তবে ইয়াসির আজমান বিষয়টি খোলাসা করতে চাননি।
তিনি বলেন, “আমরা মনে করি, প্রিন্সিপাল অ্যামাউন্ট ক্রটিপূর্ণ। ইন্টারেস্ট বাদ দিয়ে শুধু প্রিন্সিপাল অ্যামাউন্ট দেওয়ার বিষয়ে এ মুহুর্ত বলা ডিফিকাল্ট, কারণ আলোচনা হচ্ছে একটি ফ্রেমওয়ার্ক ডেভেলপ করার জন্য, যে ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে আমারা একটা সমাধান খুঁজে পাব।”
মীমাংসায় পৌঁছাতে পারলে গ্রামীণফোনকে কী পরিমাণ টাকা দিতে হতে পারে জানতে চাইলে ইয়াসির আজমান বলেন, “আসলে এমন কোনো হিসাব নেই। এখানে অনেকগুলো ব্যাপার আছে- প্রসেসের ব্যাপার আছে, ক্যালকুলেশনের ভুল আছে।
“আমাদের একটি এগ্রিমেন্ট হয়েছে যে আলোচনার মাধ্যমে আমরা সমাধানে আসব। ফলে এখন নির্দিষ্ট করে কোনো অংক বলাটা ঠিক হবে না, তাতে প্রসেসটাকে অসম্মান করা হবে। টাকার অঙ্কটা আলোচনার মাধ্যমেই বের হয়ে আসবে।”
গ্রামীণফোনের ডেপুটি সিইও বলেন, বিষয়টি নিয়ে ‘জল ঘোলা’ হোক, তা তারা চাননি। শুরুতেই তারা আদালতে যাওয়ার কথা ভাবেননি।
“যেহেতু আমাদের শেয়ার হোল্ডারদের অধিকার রক্ষা করতে হবে, সেহেতু আমাদের কোর্টে থাকতে হচ্ছে। বাংলাদেশে আমাদের ৩০ হাজার শেয়ার হোল্ডার রয়েছে, বিদেশি শেয়ার হোল্ডার রয়েছে, বিভিন্ন রকমের বিনিয়োগকারীরা রয়েছেন।
“একটি ফ্রেমওয়ার্কে আসতে পারলে কোর্ট থেকে বের হয়ে আসব- এই কমিটমেন্ট আমাদের আছে। সরকারও বলছে, তারাও শোকজ থেকে ফিরে আসবে।”
আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আশার কথা বললেও কতদিনে তা সম্ভব হবে- সে ধারণা দিতে পারছেন না ইয়াসির আজমান।
তিনি বলেন, “যত দ্রুত একটি ফ্রেমওয়ার্ক করা যায় সে চেষ্টা দুই পক্ষই করব। সামনে আরও মিটিং হবে, আমরা এখান থেকে বের হয়ে আসব। বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে দুই পক্ষই আত্মবিশ্বাসী, সমাধান হবে।”
অডিট আপত্তির টাকা আদায়ের জন্য চাপ দিতে বিটিআরসি বিভিন্ন ধরনের টেলিযোগাযোগ সেবার অনুমোদন ও অনাপত্তিপত্র দেওয়া বন্ধ রাখায় গ্রামীণফোনকে যে ভুগতে হচ্ছে, সে কথাও বললেন কোম্পানির চিফ মার্কেটিং অফিসার।
“সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটে, পাঁচ মাসে গ্রামীণফোনের শেয়ারের দাম ৩০ শতাংশ কমে গিয়েছিল প্রথম মিটিংয়ের (অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে) আগ পর্যন্ত।
“তাছাড়া কাস্টমাররা নতুন নতুন প্রডাক্ট পাচ্ছে না। নেটওয়ার্কে লং টার্মে সমস্যা হবে। তাতে সরকার ও গ্রাহকরেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো অপারেটরের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ বন্ধ করে রাখা উচিত না। আমাদের ইকুইপমেন্ট বন্দরে পড়ে আছে।”
বিটিআরসি সালিশের মাধ্যমে অডিট আপত্তির দাবি নিষ্পত্তিতে রাজি না হলেও এরবিআরের দাবির বিষয়টি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমেই ‘অনেকটা সমাধান’ করা সম্ভব হয়েছে বলে জানান ইয়াসির আজমান।
“এনবিআর চেয়ারম্যান বলেছেন, তাদের অংশ নিয়ে কোনো ইনটারেস্ট নেই। ওখানে মূল কিছু অংশ কোর্টে আছে, দুই পক্ষই প্রসেস ফলো করছে। সমস্যা হচ্ছে বিটিআরসির অংশ নিয়ে।”
গ্রামীণফোন তাদের সব পাওনাই যথাসময়ে এবং সঠিক পরিমাণে পরিশোধ করেছে দাবি করে উপপ্রধান নির্বাহী বলেন, “৬৬ হাজার কোটি টাকা দিয়েছি গত ২২ বছরে। গত বছর দিয়েছি আট হাজার ৪০০ কোটি টাকার উপরে।
“যে কোম্পানিটা এত টাকা নিয়মিত দিয়ে যাচ্ছে,সে কেন বছর বছর অডিট না হওয়ার কারণে ডিসপিউটেড জিনিসটা দেবে না? ডিসপিউট হতেই পারে।”
এই নিরীক্ষা আপত্তির সমাধান হয়ে গেলে প্রতিবছর অডিট করার ওপর জোর দিয়ে ইয়াসির আজমান বলেন, “অডিট কেন ২২ বছর বা ১৫ বছর পরে হবে?... আমরা চাই, প্রতিবছর অডিট হয়ে যাবে। অডিট হয়ে যাওয়ার পর আপত্তি থাকবেই, আমাদের কথাও তখন শুনতে হবে।”
আর এ ধরনের ঘটনা বার বার ঘটতে থাকলে বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে বলেই মনে করেন ইয়াসির আজমান।