জিপি-রবির টুজি-থ্রিজি লাইসেন্স কেন বাতিল হবে না: বিটিআরসির নোটিস

দুই দফা চাপ দিয়েও নিরীক্ষা আপত্তির ‘পাওনা’ টাকা আদায় করতে না পেরে দেশের দুই শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবির বিরুদ্ধে ‘চূড়ান্ত’ পদক্ষেপে গেল সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Sept 2019, 12:08 PM
Updated : 5 Sept 2019, 02:15 PM

টাকা না দেওয়ায় গ্রামীণফোন ও রবির টু জি ও থ্রি জি সেবার লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে না- তা জানতে চেয়ে বৃহস্পতিবার দুই অপারেটরকে ‘কারণ দর্শাও’ নোটিস পাঠিয়েছে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।

কমিশনের চেয়ারম্যান জহুরুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১ এর ৪৬(২) ধারা মোতাবেক মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবির টু জি ও থ্রি জি সেবার লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে না, আগামী ৩০ দিনের মধ্যে তা জানাতে বলা হয়েছে নোটিসে।”

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নোটিসের জবাব না দিলে বা পাওনা টাকা পরিশোধ না করলে পরবর্তী পদক্ষেপ বিষয়ে সোয়া ১২ কোটি গ্রাহকের এই দুই অপারেটরে প্রশাসক নিয়োগের মত পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে বলে জানান বিটিআরসি প্রধান।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিটিআরসির ওই নোটিসকে ‘অযৌক্তিক’ আখ্যায়িত করে গ্রামীণফোন বলেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই ‘অন্যায্য’ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা তারা নেবে।

আর রবি বলেছে, এই পদক্ষেপের ফলে বিনিয়োগকারী ও গ্রাহকদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে।

বিটিআরসির দাবি, গ্রামীণফোনের কাছে নিরীক্ষা আপত্তির দাবির ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং রবির কাছে ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে তাদের। টাকা শোধে বিলম্বের মাশুল ও সুদও ধরা হয়েছে এর মধ্যে।

প্রথম ধাপে ব্যান্ডউইথ কমিয়ে দিয়ে এবং দ্বিতীয় ধাপে বিভিন্ন ধরনের সেবার অনুমোদন ও অনাপত্তিপত্র দেওয়া বন্ধ রেখেও কাজ না হওয়ায় সরকার এমন পদক্ষেপে যেতে বাধ্য হয়েছে বলে বিটিআরসি কর্মকর্তাদের ভাষ্য।

আর এই ‘চূড়ান্ত পদক্ষেপে’ নেওয়ার এখতিয়ার সরকারের আছে মন্তব্য করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গত ২৮ অগাস্ট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “গা যেহেতু করছে না, আমরা তো জাতীয় অর্থ পানিতে ফেলে রাখতে পারি না। এই ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দিতে পারি না।”

 

বিটিআরসি নোটিস পাঠানোর পর এক বিবৃতিতে গ্রামীণফোন বলেছে, “বিটিআরসির নোটিসটি অযৌক্তিক। সেই সঙ্গে একটি বিতর্কিত অডিট দাবির বিষয়ে আমাদের গঠনমূলক সমাধান প্রস্তাবের বিপরীতে তাদের অনীহার আরেকটি বহিঃপ্রকাশ। নোটিসটি পর্যালোচনা করার পর গ্রামীণফোন এ বিষয়ে উত্তর দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

“আমাদের প্রতিষ্ঠান, শেয়ারহোল্ডার ও সম্মানিত গ্রাহকদের অধিকার রক্ষায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার অন্যায্য যে কোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আমরা প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”

আর রবি আজিয়াটা লিমিটেডের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার শাহেদ আলম বলেছেন, “লাইসেন্স বাতিলের কারণ দর্শানোর নোটিস টেলিযোগাযোগ খাতে বিনিয়োগকারীদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং গ্রাহকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে। যথাসময়ে আমরা কারণ দর্শানোর নোটিসের জবাব দেব।”

বিটিআরসির দাবি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে সালিশের মাধ্যমে বিষয়টির মীমাংসা করার প্রস্তাব দিয়েছিল রবি আর জিপি। কিন্তু তাতে সাড়া না দিয়ে বিটিআরসির পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের আইনে এ ধরনের ক্ষেত্রে সালিশের কোনো সুযোগ নেই।

তাগাদা দেওয়ার পরও ওই টাকা পরিশোধ না করার যুক্তি দেখিয়ে গত ৪ জুলাই গ্রামীণফোনের ব্যান্ডউইথ ক্যাপাসিটি ৩০ শতাংশ এবং রবির ১৫ শতাংশ সীমিত করতে আইআইজিগুলোকে নির্দেশ দেয় বিটিআরসি।

কিন্তু তাতে গ্রাহকের সমস্যা হওয়ায় ১৩ দিনের মাথায় ওই নির্দেশনা প্রত্যাহার করে নেয় বিটিআরসি। এরপর ২২ জুলাই গ্রামীণফোন ও রবিকে বিভিন্ন প্রকার সেবার অনুমোদন ও অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দেওয়া স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

বিটিআরসি ‘এনওসি’ দেওয়া বন্ধ রাখায় গ্রামীণফোন ও রবি বর্তমান সেবা চালিয়ে নিতে কোনো সমস্যায় পড়ছে না। তবে তারা নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ বা বিটিএস স্থাপন করতে পারছে না, যন্ত্রাংশ আমদানির অনুমতি পাবে না, নতুন কোনো প্যাকেজ তারা বাজারে ছাড়তে পারছে না, চলতি প্যাকেজে কোনো পরিবর্তনও আনতে পারছে না।

দেশে গ্রাহকের হাতে থাকা ১৬ কোটি ৮২ হাজার নিবন্ধিত মোবাইল সিমের মধ্যে ৭ কোটি ৪৭ লাখ সিম গ্রামীণফোনের। আর রবির ৪ কোটি ৭৬ লাখ সিম রয়েছে গ্রাহকের হাতে। এই হিসাবে মোট গ্রাহকের ৪৬.৪৯ শতাংশ গ্রামীণফোন এবং ২৯.৬৫ শতাংশ রবির সেবা নিয়ে থাকেন।

দেশের ৯ কোটি ৪৪ লাখ ইন্টারনেট গ্রাহকের মধ্যে ৮ কোটি ৮৬ লাখই মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যা মোট গ্রাহকের ৯৩.৮৭ শতাশংশ।

বিটিআরসির এই পদক্ষেপে কী প্রভাব পড়বে গ্রাহকের ওপর?

 

সমাধান আসবে?

বিটিআরসির এই পদক্ষেপের বিষয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে চায়নি মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন 'অ্যামটব'।

তবে এ সংগঠনের সাবেক মহাসচিব টি আই এম নুরুল কবির মনে করেন, এই পদক্ষেপ আদৌ সহজ কোনো সমাধান দেবে কি না- তা সরকারের ভেবে দেখা উচিৎ।

 “এ নোটিস বিদেশি বিনিয়োগে প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ দুটি অপারেটরই বিদেশি। এত কঠিন অবস্থায় না গেলেও পারত।”

নিরীক্ষা নিয়ে মতভিন্নতা থাকতেই পারে এবং আলোচনার মাধ্যমেই তার মীমাংসা হওয়া উচিৎ মন্তব্য করে নুরুল কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারের অবশ্যই কোয়ালিটি অব রেগুলেশনস নিয়ে ভাবতে হবে। তারা কি শুধু টাকা কালেকশন করবে? না ইন্ডাস্ট্রির গ্রোথও দেখবে। অপারেটররা যাতে টাকাগুলো দেয় সেটাই তো উদ্দেশ্য। সেটা সুষ্ঠভাবে সমাধানের জন্য রিভিউ করা দরকার।”

তিনি বলেন, “পুরো ইন্ডাস্ট্রি নিয়েই আমি কনসার্ন ফিল করছি… এ নোটিসের মাধ্যমে কী প্রভাব পড়বে তা ভেবে দেখা দরকার, যেহেতু টেলিকমিউনিকেশন খাত বড় ধরনের ইনভেস্টর।”