অর্থ আদায়ে ‘অযৌক্তিক’ কৌশল নিয়েছে বিটিআরসি: গ্রামীণফোন

নিরীক্ষা আপত্তির টাকা আদায়ের ‘কৌশল’ হিসেবে বিটিআরসি মোবাইল ফোন সেবার বিভিন্ন অনুমোদন ও অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দেওয়া বন্ধ রাখায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে গ্রামীণফোন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2019, 03:24 PM
Updated : 25 July 2019, 03:36 PM

দেশের প্রায় অর্ধেক গ্রাহকের অপারেটর গ্রামীণফোন টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির ওই কৌশলকে বর্ণনা করেছে ‘অযৌক্তিক ও জবরদস্তিমূলক’ হিসেবে।

গ্রামীণফোনের সিইও মাইকেল ফোলি বৃহস্পতিবার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সংবাদ সম্মেলন করে কোম্পানির অবস্থান তুলে ধরেন।

তিনি অভিযোগ করেন, বিটিআরসির এই ‘চরম সিদ্ধান্তটি’ কোনোভাবেই গ্রাহকের স্বার্থ বিবেচনা করে নেওয়া হয়নি; বরং এ সিদ্ধান্তে গ্রাহককে স্বাধীনভাবে সেবা গ্রহণের সুবিধা থেকে ‘বঞ্চিত করা হচ্ছে’।

এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে বিটিআরসি গ্রাহকের নিরবচ্ছিন্নভাবে মানসম্পন্ন ফোন-কল, ইন্টারনেট ব্রাউজিং ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহারের অধিকারকে ‘খর্ব করছে’ বলেও অভিযোগ করেছে গ্রামীণফোন।

বিটিআরসির দাবি, গ্রামীণফোনের কাছে নিরীক্ষা আপত্তির দাবির ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং আরেক মোবাইল ফোন অপারেটর রবির কাছে ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে তাদের।

তাগাদা দেওয়ার পরও ওই টাকা পরিশোধ না করার যুক্তি দেখিয়ে গত ৪ জুলাই গ্রামীণফোনের ব্যান্ডউইথ ক্যাপাসিটি ৩০ শতাংশ এবং রবির ১৫ শতাংশ সীমিত করতে আইআইজিগুলোকে নির্দেশ দেয় বিটিআরসি।

কিন্তু তাতে গ্রাহকের সমস্যা হওয়ায় ১৩ দিনের মাথায় গত ১৬ জুলাই ওই নির্দেশনা প্রত্যাহার করে নেয় বিটিআরসি।

তবে এ সংস্থার চেয়ারম্যান জহুরুল হক সেদিনই জানিয়ে দেন, টাকা না দিলে ‘এনওসি’ বন্ধের মত কঠোর পদক্ষেপে যাবেন তারা।  

এর ধারাবাহিকতায় গত সোমবার গ্রামীণফোন ও রবিকে বিভিন্ন প্রকার সেবার অনুমোদন ও অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দেওয়া স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

এর প্রতিবাদ জানিয়ে গ্রামীণফোনের সিইও মাইকেল ফোলি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “ব্যবসায়িক বিরোধ নিরসনের উপায় হিসেবে কখনোই গ্রাহকের স্বার্থ, জাতীয় অর্থনীতি কিংবা দেশের ভাবমূর্তিকে জিম্মি করা উচিত নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অন্যান্য পক্ষের ওপর যে প্রভাব পড়েছে তা সত্যিই দুঃখজনক।”

তিনি বলেন, ওই অডিট আপত্তি নিয়ে প্রতিবাদ জানানোর আইনগত অধিকার গ্রামীণফোনের আছে।

“নিয়ন্ত্রক সংস্থার এধরনের বলপূর্বক টাকা আদায়ের কৌশল নজিরবিহীন এবং তাদের এই আচরণ ওই বিরোধপূর্ণ অডিটের উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।“

দেশে গ্রাহকের হাতে থাকা ১৬ কোটি ৮২ হাজার নিবন্ধিত মোবাইল সিমের মধ্যে ৭ কোটি ৪৭ লাখ সিম গ্রামীণফোনের। আর রবির ৪ কোটি ৭৬ লাখ সিম রয়েছে গ্রা্হকের হাতে। এই হিসাবে মোট গ্রাহকের ৪৬.৪৯ শতাংশ গ্রামীণফোন এবং ২৯.৬৫ শতাংশ রবির সেবা নিয়ে থাকেন।

দেশের ৯ কোটি ৪৪ লাখ ইন্টারনেট গ্রাহকের মধ্যে ৮ কোটি ৮৬ লাখই মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যা মোট গ্রাহকের ৯৩.৮৭ শতাশংশ।

বিটিআরসি ‘এনওসি’ দেওয়া বন্ধ রাখায় গ্রামীণফোন ও রবি বর্তমান সেবা চালিয়ে নিতে কোনো সমস্যায় পড়বে না। তবে তারা নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ বা বিটিএস স্থাপন করতে পারবে না, যন্ত্রাংশ আমদানির অনুমতি পাবে না, নতুন কোনো প্যাকেজ তারা বাজারে ছাড়তে পারবে না, বর্তমান প্যাকেজে কোনো পরিবর্তনও আনতে পারবে না।

এ ধরনের পদক্ষেপে গ্রাহক নতুন করে ভোগান্তিতে পড়বে কিনা- সেই প্রশ্ন গত ১৭ জুলাই বিটিআরসি চেয়ারম্যান জহুরুল হকের কাছে রেখেছিলেন সাংবাদিকরা। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “বৃহৎ কল্যাণে সামান্য ক্ষয়ক্ষতি (গ্রহকদের) মেনে নিতে হবে।”

গ্রামীণফোনের সংবাদ সম্মেলনে মাইকেল ফোলি বলেন, “একটি সামগ্রিক ব্যবস্থার অংশ হিসাবে এ ধরনের সিদ্ধান্তে টেলিযোগাযোগের অবকাঠামোগত সহযোগী, ডিজিটালসেবার উদ্যোক্তা এবং আইসিটি ফ্রিল্যান্সাররাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।”

বিটিআরসির ওই অডিটকে ‘অসঙ্গতিপূর্ণ’ হিসেবে বর্ণনা করে এর উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

গ্রামীণফোনের সিইও বলেন, ওই অডিটে তাদের উত্থাপিত সব যুক্তিই উপেক্ষিত হয়েছে এবং বিষয়গুলো এখনও অমীমাংসীত রয়ে গেছে।

“এটি কোনভাবেই একটি নিরপেক্ষ অডিটরের নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না, বরং এইরূপ আচরণ পুরো অডিট প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ ধরনের অযৌক্তিক কার্যকলাপ আমাদের আইনানুগ অধিকার রক্ষার্থে গঠনমূলক সালিশী প্রক্রিয়া অবলম্বনের দাবিকেই সমর্থন করে।”

গ্রামীণফোনের ভারপ্রাপ্ত চিফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার ও হেড অব রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স হোসেন সাদাত অডিটের নীতিগত ও পদ্ধতিগত কিছু ‘ত্রুটি’র কথা সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ২০০২ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে যে স্পেক্ট্রাম ব্যবহারের মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে তা বিটিআরসির ডিমান্ড নোটের ভিত্তিতেই করা হয়েছে। তবে অডিটের ফলাফলে বলা হয়, ডিমান্ড নোট নিরূপণ পদ্ধতিতে বিটিআরসি নিজেই ভুল করেছে।

“এক্ষেত্রে এই ভুলের জন্য বিটিআরসিকে দায়ী করার বদলে বিটিআরসি কর্তৃক নিযুক্ত অডিট প্রতিষ্ঠান দাবি করে যে গ্রামীণফোন শুধুমাত্র এই ভুলের মাশুলই দেবে না, এর ওপর চক্রবৃদ্ধি হারে সুদও প্রদান করবে। এছাড়া ভ্যাট সংক্রান্ত বিষয়গুলো, যা আদালতে বিচারাধীন, অস্বাভাবিকভাবে সেগুলোও এই বিতর্কিত ও ত্রুটিপূর্ণ অডিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”

গ্রামীণফোনোর এসব অভিযোগের বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসির আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া বৃহস্পতিবার পাওয়া যায়নি।

তবে কমিশনের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের অবস্থান গত ১৭ জুলাইয়ের সংবাদ সম্মেলনেই স্পষ্ট করেছেন আমাদের চেয়ারম্যান।”

বিটিআরসি প্রধান জহুরুল হক সেদিন বলেছিলেন, “আইন অনুযায়ী টাকা তোলার চেষ্টা করা হবে। আমাদের আইনে সালিশের বিধান নাই, তারা আবার কোর্টে গেলে দেরি হয়ে যাবে। বিটিআরসির আইন অনুযায়ী টাকা দিতে হবে। এজন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি কারণ এটি রাষ্ট্রের টাকা।”