গ্রামীণফোন-রবির কাছে পাওনা ১২ হাজার কোটি টাকা: বিটিআরসি

নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গ্রামীণফোন ও রবির কাছে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি পাওনার কথা জানিয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 August 2018, 04:03 PM
Updated : 8 August 2018, 04:04 PM

৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা চেয়ে মোবাইল ফোন অপারেটর রবিকে ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছে বিটিআরসি। ১১ হাজার ৫৩০ কোটি ১৫ লাখ টাকা পাওনা চেয়ে গ্রামীণফোনকেও চিঠি দিচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিটিআরসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ৩১ জুলাই রবিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ভ্যাট ও ট্যাক্স বাবদ পাওনা টাকা আদায়ে রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি পাঠানো হয়েছে।”

রবির কাছে পাওনা টাকার মধ্যে বিভিন্নখাতে বিটিআরসির নিট পাওনা ৬৭৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং ভ্যাট ও ট্যাক্স বাবদ রাজস্ব বোর্ডের পাওনা রয়েছে ১৮৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।

চিঠি পাঠানোর ১০ কার্যদিবসের মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে বলেছে বিটিআরসি।  

২০১৬ সালের মার্চে রবির ইনফরমেশন সিস্টেম নিরীক্ষায় স্থানীয় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান মসিহ মুহিত হক অ্যান্ড কোম্পানি এবং ভারতীয় সহযোগী নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান পি কে এফ শ্রীধর অ্যান্ড সান্থনাম এলএলপি সঙ্গে চুক্তি করে বিটিআরসি।

বাংলাদেশে রবির কার্যক্রম শুরুর পর এই প্রথম বিটিআরসি পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেওয়ার পর সম্প্রতি অডিট কোম্পানি বিটিআরসিতে নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেয়।

বিটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জহুরুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অডিটি সিস্টেম অনুযায়ী অডিট ফার্ম অডিট করেছে। রবিকে নোটিস দিয়েছে, রবি আসছে এবং ক্রস চেইক হয়েছে। কত পাব, কত পাব না, কেন পাব ডিবেট হয়েছে, হওয়ার পর ফাইনাল ফিগারটা জানানো হয়েছে।

“অডিট রুলস অনুযায়ী এ টাকা চাওয়া হয়েছে। ১০ কর্মদিবসের মধ্যে টাকা চাওয়া হয়েছে। টাকা না দিলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে।”

বিষয়টি নিয়ে রবি ই-মেইলে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছে, “রবি এই ত্রুটিপূর্ণ  নিরীক্ষা প্রতিবেদন এবং এর সাথে সম্পর্কিত সকল পাওনা দাবিকে জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। সম্পূর্ণ যুক্তিহীন এই দাবির আইনগত কোনো ভিত্তি নেই।”

রবি বলছে, “সংশ্লিষ্ট টেলিযোগাযোগ আইন অনুসারে, নিরীক্ষার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী অপারেটর কার্যক্রম পরিচালনা করছে কি-না এবং তারা সঠিকভাবে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী প্রদান করছে কি-না, এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার কথা। অথচ তথাকথিত এই নিরীক্ষা প্রতিবেদন আমাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনা যাচাইয়ের দিকে মনযোগ না দিয়ে রবি’র বিরুদ্ধে আর্থিক দাবি প্রতিষ্ঠায় বেশি মনোযোগী ছিল।

“নিরীক্ষণের সময়, প্রথা অনুসারে নিরীক্ষক কোম্পানি আমাদের মতামত না নেওয়ায় আমরা বিস্মিত হয়েছি। এ থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, নিরীক্ষকের যাচাই প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ। আর তাই, এই নিরীক্ষার মান নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক প্রশ্ন। আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই যে, এ প্রতিবেদনে আমাদের কার্যক্রমের সঠিক ও নিরপেক্ষ চিত্র ফুটে উঠেনি।”

এই নিরীক্ষার আলোকে তৈরি দাবিনামার একটি বড় অংশ নিয়ে আদালতে বিরোধ চলছে উল্লেখ করে রবি বলেছে, এক্ষেত্রে নিরীক্ষকরা বিভিন্ন সূত্র থেকে তাদের পর্যবেক্ষণকে যাচাই করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন।

“এই নিরীক্ষা প্রতিবেদন এটাও প্রমাণ করে যে, নিরীক্ষক কোম্পানির টেলিকম ইকো-সিস্টেম এবং এ শিল্পের বিকাশের ইতিহাস সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে আমাদের আবেদন, তারা যেন বিশ্বের নামকরা সবচেয়ে বড় যে চারটি নিরীক্ষক কোম্পানি রয়েছে, তাদের মধ্য থেকে কাউকে দিয়ে নিরীক্ষাটি পুনরায় পরিচালনা করেন।”

নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গ্রাহক সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অপারেটর গ্রামীণফোনের কাছে বিটিআরসির পাওনা রয়েছে ১১ হাজার ৫৩০ কোটি ১৫ লাখ টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিটিআরসির ওই কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কমিশন সভার বিবরণী অনুসারে গ্রামীণফোনের কাছে বিটিআরসির পাওনা ৭ হাজার ৪৪৪ কোটি ২১ লাখ টাকা। বাকি ৪ হাজার ৮৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ভ্যাট ও ট্যাক্স বাবদ পাওনা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআরের।”

বিটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জহুরুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্রামীণফোনের অনেক বড় ব্যাপার, জিপির একবার অডিট হয়েছিল তিন হাজার ৩৪ কোটি টাকা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, হাই কোর্টে মামলা করার পর ফ্রেশ অডিট করতে বলায় সে নির্দেশে ফ্রেশ অডিট করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “নতুন অডিটে অডিট ফার্ম একটা ফিগার বের করেছে, কত পাব না পাব। সমস্যা হচ্ছে এটি অনেক দিন হয়ে গেছে, এ জন্য ইন্টারেস্ট হবে, জিপি এ বিষয়ে এসেছে এবং এ নিয়ে ডিবেট হয়েছে। ডিবেট হওয়ার পর যা ফিগার হয়, তা আমাদের বলেছে। এ ফিগার চাওয়া ছাড়া চাওয়া ছাড়া আমাদের আর অলটারনেটিভ নেই। চিঠি প্রায় হয়ে গেছে হয়ত আগামী সপ্তাহে তা যাবে।” 

গ্রামীণফোনের ব্যবসা শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। এরপর থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ইনফরমেশন সিস্টেম অডিটে, উঠে আসে মোবাইল কোম্পানিটির দায়-দেনার হিসাব।

২০১১ সালে প্রথম অডিটে গ্রামীণফোনের দেনা ছিল প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। তখন তারা আপত্তি তুলে জানায়, অডিট আন্তর্জাতিক মানের হয়নি। ফলে তাদের দাবি অনুযায়ী, দ্বিতীয় দফা অডিটে বিদেশি পার্টনার ফার্ম নিয়োগের ব্যবস্থা করে বিটিআরসি।

পরে দেশি তোহা খান জামান অ্যান্ড কোম্পানি লিড অডিটর এবং সহযোগী অডিটর হয় ভারতের সিএনকে অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস, এলএলপি, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট।

এই অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী গ্রামীণফোনের কাছে এখন সরকারের পাওনা ১১ হাজার ৫৩০ কোটি ১৫ লাখ টাকা।

বিষয়টি নিয়ে এক ই-মেইল বার্তায় গ্রামীণফোন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছে, “গ্রামীণফোন নীতিগতভাবে কোনো প্রকার গুজব বা ধারণা প্রসূত বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে।

“বিটিআরসি নিয়োজিত একটি অডিটর এর মাধ্যমে সিস্টেম অডিটের বিষয়টি  দীর্ঘদিন ধরে অনিস্পন্ন অবস্থায় আছে এবং আমরা আশা করি এ বিষয়ে কোনো প্রকার সিদ্ধান্তে আসার আগে স্বাভাবিক নিয়মে আমাদের সাথে আলোচনা করা হবে। ভবিষ্যতে আলোচনা হলেই এ নিয়ে বিস্তারিত জানাতে পারব।”