জিপি-রবির সঙ্গে সমঝোতার আভাস অর্থমন্ত্রীর

নিরীক্ষা আপত্তির টাকা নিয়ে দেশের দুই শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবির সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির বিরোধ আলোচনার মধ্যে মীমাংসার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Sept 2019, 12:31 PM
Updated : 19 Sept 2019, 07:11 AM

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ওই আলোচনায় দুই পক্ষই যেন ‘উইন উইন সিচুয়েশনে’ থাকে, তা নিশ্চিত করা হবে। সপ্তাহ তিনেকের মধ্যেই আলোচনার ফল পাওয়া যাবে।

টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারকে সঙ্গে নিয়ে বুধবার সচিবালয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার মাইকেল ফোলির সঙ্গে বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রীর এমন বক্তব্য আসে।

তিনি বলেন, নিরীক্ষা আপত্তি নিয়ে কিছুটা ভুল বুঝাবুঝি রয়েছে। দুই পক্ষই যে নোটিস বা আইনি প্রক্রিয়ায় গেছে- তা প্রত্যাহার করা হবে।

বিটিআরসির দাবি, গ্রামীণফোনের কাছে নিরীক্ষা আপত্তির দাবির ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং রবির কাছে ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে তাদের।

প্রথম ধাপে ব্যান্ডউইথ কমিয়ে দিয়ে এবং দ্বিতীয় ধাপে গত ২২ জুলাই বিভিন্ন ধরনের সেবার অনুমোদন ও অনাপত্তিপত্র দেওয়া বন্ধ রেখেও কাজ না হওয়ায় গত ৫ সেপ্টেম্বর দুই অপারেটরকে ‘কারণ দর্শাও’ নোটিস পাঠায় বিটিআরসি।

টাকা না দেওয়ায় গ্রামীণফোন ও রবির টু জি ও থ্রি জি সেবার লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে না- তা জানতে এক মাস সময় দেওয়া হয় দুই অপারেটরকে।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নোটিসের জবাব না দিলে বা পাওনা টাকা পরিশোধ না করলে পরবর্তী পদক্ষেপ বিষয়ে সোয়া ১২ কোটি গ্রাহকের এই দুই অপারেটরে প্রশাসক নিয়োগের মত পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে বলে গত ৫ সেপ্টেম্বর জানান বিটিআরসি চেয়ারম্যান জহুরুল হক।

অবশ্য তার আগেই গত ২৫ অগাস্ট রবি এবং ২৬ অগাস্ট গ্রামীণফোন ঢাকার দেওয়ানি আদালতে দুটি মামলা দায়ের করে। নিরীক্ষা আপত্তির ‘পাওনা’ টাকা আদায়ে বিটিআরসির দাবিকে ‘অযৌক্তিক ও ত্রুটিপূর্ণ’ হিসেবে বর্ণনা করে মীমাংসার দাবি জানানো হয় সেখানে। 

এই টানাপড়েনের মধ্যে বুধবার দুপুরে গ্রামীণফোনের সিইওর সঙ্গে বৈঠকে বসেন অর্থমন্ত্রী ও টেলি যোগাযোগ মন্ত্রী। ওই বৈঠকের পর বেলা সোয়া ২টায় হঠাৎ করেই অর্থমন্ত্রণালয় জানায়, আড়াইটায় সংবাদ সম্মেলন হবে।

একই বিষয়ে বেলা ৩টায় বিটিআরসিতে সংবাদ সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও তা বাতিল করে অর্থমন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান জহুরুল হক ও কর্মকর্তারা।

অর্থমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “কয়েকদিন ধরে আলোচনা করছিলাম যে সমাধানে আসা উচিত। সমাধানটি হবে উইন উইন সিচুয়েশনে থেকে। আমরাও হারব না, তারাও হারবে না। আমরা আমাদের যেটুকু ন্যায্য দাবি হবে, সেটা আমরা আদায় করার চেষ্টা করব। তারাও আমাদেরটা মেনে নেবেন বিশ্বাস করি।

“আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, অন্য সব পথ বাদ দিয়ে আমরা আলোচনার টেবিলে বসব, আমরা সমঝোতায় আসব। মাননীয় মন্ত্রী (টেলিকম) এখানে আছেন, তিনিও তার যেটুকু পাওনা… এই প্রক্রিয়ায় সমাধান খুঁজে বের করব। এটাই বেস্ট এভিনিউ হবে ফর পিসফুল সিচুয়েশন। তারা ব্যবসা করবে, আমাদের পাওনা বুঝিয়ে দেবে, আমরাও তাদের সাহায্য করব, এটাই আমাদের উদ্দেশ্য।”

জিপি-রবি সালিশে মীমাংসা চাইলেও বিটিআরসি ‘হার্ড লাইনে’ কেন গিয়েছিল- এই প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেন, “কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি তো ছিল, ভুল বোঝাবুঝি এখনো আছে। ভুল বোঝাবুঝির সমাধানে আজকে বসেছি, আমরা মনে করি যে অন্য কোনো পথ অবলম্বন করলে অনেক সময় লাগবে। কে লাভবান হবে কে লুজার হবে আমরা জানি না। ইভেনচুয়ালি আমরা মনে করি, আমাদের লস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, কারণ আমরা রেভিনিউ হারাবো এবং আমাদের এগিয়ে যাওয়ার যে স্বপ্ন, এ খাতটি নিয়ে, অনেকটাই বিঘ্নিত হবে। তবে আমরা অন্য কোনো রাস্তায় যাব না।”

তাহলে পাওনার ক্ষেত্রে সরকার ছাড় দিচ্ছে কিনা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, “এ মুহূর্তে বলা ঠিক হবে না, আমরা একটি সমাধানের দিকে যাচ্ছি যা দুই পক্ষের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে।”

কবে নাগাদ সমাধান হতে পারে জানতে চাইলে মুস্তফা কামাল বলেন, “বেশি দিন লাগবে না। দুই থেকে তিন সপ্তাহের বেশি লাগবে না।”

বিটিআরসির নোটিস ফিরিয়ে নিচ্ছে কি না বা মোবাইল অপারেটররা মামলা প্রত্যাহার করছে কিনা- এই প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেন, “ইউ ইউল ফরগো অ্যান্ড ফরগেট অভরিথিং।… মামলা তারা প্রত্যাহার করবে, মামলা প্রত্যাহার না করলে আলোচনাই করতে পারব না।”

আলোচনা কোন পথ ধরে হবে তা বিশদ না করে তিনি বলেন, “জিপির সিইও বলেছেন, আমাদের মাঝে যে বিষয়গুলো ছিল সেগুলো আর সামনে নিয়ে যাব না।… নো ফারদার হ্যাসেল অর নো ফারদার আর্গুমেন্ট অন দিস পার্টিকুলার ইস্যু।”

সমঝোতার উদ্যেগের জন্য অর্থমন্ত্রী ও এনবিআর চেয়ারম্যানকে ধন্যবাদ জানিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, “আজকে বাংলাদেশে যে টেলিকমিউনিকেশনের বিপ্লব, তার পেছনে তাদের (গ্রামীণফোন) ভূমিকা অবশ্যই বেশি আছে। ১৯৯৭ সাল থেকে ২২ বছর ধরে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে, রাজস্ব বোর্ডের পাওনা আছে, বিটিআরসির পাওনা আছে, সুদও পাওনা হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন কথাবার্তা বলেছি, তারপরও সারটেইন স্টেজে গিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাচ্ছিলাম।

“আজকে অর্থমন্ত্রী যা বললেন, সেটাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা চাই না যে ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ কোনোভাবে বিঘ্নিত হোক, একই সাথে আমাদের এ বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় অর্থ ও জাতীয় রাজস্ব উপেক্ষা করার উপায় থাকে না।”

মোস্তাফা জব্বার বলেন, “আমাদের জন্য সুখবর হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী নিজে উগ্যেগ নিয়ে দায়িত্ব নিয়ে আজকে যে অবস্থার মধ্যে নিয়ে আসছেন, আমরাও মনে করি যে আমাদের যেন উইন উইন সিচুয়েশনটা থাকে। আমরা কোনো পক্ষ হারতে চাইনা, কোনো পক্ষকে হারাতেও চাই না। সেদিক থেকে আমি প্রত্যাশা করব, একটি স্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি হবে ব্যবসার জন্য।”

এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, রবি আর জিপি নিয়মিত ভ্যাট, ট্যাক্স দিয়ে আসছে, প্রতি বছর ৫ হাজার কোটি টাকা পাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এখন যে চার হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিরোধ, তা বেরিয়ে এসেছে অডিট থেকে।

“এটা নিয়ে কিছু কিছু জায়গায় দ্বিমত করেছে তারা, কোর্ট কাচারি মামলা মোকদ্দমা পর্যায়ে গেছে। বিটিআরসির যে পাওনা আছে, সেটা নিয়ে বিরোধ হয়েছে, সেটা সুদসহ ৮ হাজার কোটি টাকায় পৌছেছে। দুই মন্ত্রী উদ্যেগ নিয়েছেন এ বিষয়ে।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, তারা আদালতে না গিয়ে অন্য প্রক্রিয়ায় চেষ্টা করছেন, তাতে ‘অনেক টাকাই’ আদায় হয়ে যাবে বলে আশা করছেন।

“ছাড় দেওয়ার যে বিষয়টা আছে সেটা টাকা পাওনা রেখে ছাড় না। এটা হচ্ছে তারা এক্সপ্লেইন করবে একভাবে, আমরা এক্সপ্লেইন করব অন্যভাবে। একটা স্টেবল জায়গায় নিয়ে আসব। এরকম না যে চার হাজার কোটি টাকা পাওনার এক হাজার কোটি টাকা ছেড়ে দিলাম।

“একইভাবে বিটিআরসির যে পাওনাটা আছে, বিটিআরসির চেয়ারম্যান চাচ্ছিলেন যে টাকা আগে কিছু জমা দিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে। আমরা এখন যে জায়গায় এসেছি, একদিন আগে বা পরে টাকা দেওয়া কোনো বিষয় না, বিষয়টা সুশাসন দরকার। মাননীয় মন্ত্রীর সাথে আলোচনায় তারা (জিপি) প্রথমে সালিশের মাধ্যমে সমাধান চেয়েছিল। কিন্তু বিটিআরসির আইনে তার সুযোগ নেই। তাই আমরা বলেছি আলোচনার মাধ্যমে হবে, মন্ত্রী তাদেরকে বলেছেন যত তাড়াতাড়ি পারেন টেলিনরের পারমিশন নেন।”

কেবল গ্রামীণফোনের সঙ্গে আলোচনা হবে, নাকি রবির ক্ষেত্রেও একই উদ্যোগ নেওয়া হবে জানতে চাইলে বিটিআরসি চেয়ারম্যান জহুরুল হক সংবাদ সম্মেলন শেষে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিষয়টি পুরোটাই অর্থমন্ত্রীর অধীনে, আমার মনে হয় দুই অপারেটরই এর আওতায় আসবে।”

আর গ্রামীণফোনের সিইও মাইকেল ফোলি বলেন, “আমাদের বক্তব্য খুব ছোট। গত ২২ বছর ধরে গ্রামীণ ফোন বাংলাদেশের উন্নয়নে অংশীদার। সেজন্য আমরা খুবই গর্বিত।… আমরা অডিট আপত্তি নিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ পথে একটি ন্যায্য সমাধানে পৌঁছানোর বিষয়ে কাজ করতে একমত হতে পেরেছি, সেজন্য আমি খুশি।”