জামিন নাকচ, সাংবাদিক শামস কারাগারে

পুলিশের তরফ থেকে রিমান্ডের কোনো আবেদন করা হয়নি।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 March 2023, 09:09 AM
Updated : 30 March 2023, 09:09 AM

রমনা থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছে আদালত। 

আসামির জামিন আবেদনের শুনানি করে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেন।

শামসের পক্ষে জামিন আবেদনের শুনানি করেন আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী ও প্রশান্ত কর্মকার। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউশন পুলিশের কর্মকর্তা নিজামুদ্দিন ফকির।

স্বাধীনতা দিবসে এক সংবাদ প্রতিবেদনে ‘মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর, জাতির জন্য মানহানিকর’ তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ ও প্রচারের অভিযোগে বুধবার রাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ওই মামলা করেন আইনজীবী মশিউর মালেক।

সেখানে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে ‘হুকুমের আসামি’ এবং নাম উল্লেখ না করে একজন ‘সহযোগী ক্যামেরাম্যানকে’ আসামি করা হয়েছে।

পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই প্রতিবেদন ‘লাইক, শেয়ার, কমেন্টকারী আরও অজ্ঞাতদের’ আসামি করেছেন মামলার বাদী।  

ওই প্রতিবেদনে ‘মিথ্যা ও মানহানিকর’ তথ্য প্রচারের অভিযোগে এর আগে তেজগাঁও থানায় আরেকটি মামলা করেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের নেতা মো. গোলাম কিবরিয়া। সেই মামলায় কেবল শামসকেই আসামি করা হয়।

তেজগাঁও থানার সেই মামলার খবর প্রকাশ্যে আসার আগেই বুধবার ভোর রাতে শামসকে তার সাভারের বাসা থেকে ‘সিআইডি পরিচয়ে’ তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

সিআইডি তাকে আটকের বিষয়টি স্বীকার না করলেও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় একজন সাংবাদিক, শামসের বাড়িওয়ালা এবং পাশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, যারা শামসকে ধরে নিয়ে গেছেন, তারা সিআইডি পুলিশ হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বুধবার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, যেহেতু মামলা হয়েছে, পুলিশ আটক করতেও পারে। এরপর বৃহস্পতিবার সকালে শামসকে আদালতে নেওয়া হয়।

শুনানিতে যা হল

জামিন আবেদনের শুনানির শুরুতে আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার বলেন, আসামির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা ‘ভিত্তিহীন’।

“এ মামলার এজাহারে বর্ণিত ঘটনা, অর্থাৎ প্রতিবেদনটি করা হয়েছে দিনমজুর জাকির হোসেন এবং সবুজ নামের প্রথম শ্রেণির একজন ছাত্রের বক্তব্য দিয়ে। এটিতে ভুল বোঝাবোঝির সৃষ্টি হয়েছে। এখানে  দেশের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়নি।

“ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ছবির সঙ্গে দিনমজুর জাকির হোসেনের বক্তব্য ছিল, তা প্রথম আলোর কাছে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হওয়ায় প্রথম আলো স্ব উদ্যোগে তা প্রত্যাহার করে নেয়। দুঃখ প্রকাশ করে, ক্ষমা চায়। পরে সংশোধনী আকারে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। কোনো স্বাধীনতাবিরোধীর মিথ্যা তথ্য দিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে রিপোর্ট করা হয়নি।”

আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, শুনানির সময় ইউটিউব, ফোইসবুক ও একাত্তর টেলিভিশনের তিনটি লিংক প্রামাণ্য হিসাবে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, তবে সেগুলো আদালতের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। তাই আসামি কী অপরাধ করেছেন– তা ‘নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না’।

এরপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এজাহারের ধারাগুলো বিশ্লেষণ করে এ আইনজীবী বলেন, “রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের কথা বলা হয়েছে । বাদী কি কোনো রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অথবা রাষ্ট্রের কোনো কর্মচারী? প্রাইমারি রেসপনসিবিলিটি কার? এ ধরনের অভিযোগ তো স্টেটের শোলডারে পড়ে। এ খবরে একজন ব্যক্তি ক্ষুব্ধ হয় কি করে? তিনি কীভাবে ব্যক্তিগত ভাবে ক্ষুব্ধ হলেন? আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটনানোর বিষয়ে প্রতিকার চাওয়া বা অভিযোগ দেওয়ার অধিকার কীভাবে বাদীর হল?

“যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে ইচ্ছাকৃত বা জ্ঞাতসারে এমন কোনো তথ্য উপাত্ত প্রেরণ করেন, যা আক্রমণাত্মক, ভীতিপ্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলে কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য প্রেরণ, প্রকাশ প্রচার করেন, তাহলে এ অপরাধ হয়। মামলার বাদীকে কীভাবে হেয় করা হল?”

এরপর আইনজীবী সমাজী এজাহারের পুরো অংশ আদালতে পড়ে শোনান। তিনি বলেন, “প্রসিকিউশন কেইস ওয়েল ফাউন্ডেড নয়। সেহেতু ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৮ ধারায় আসামি  জামিন পাওয়ার অধিকারী।”

মাত্র এক মিনিটে এর বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষে বক্তব্য দেন আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কমকর্তা এস আই নিজাম উদ্দিন ফকির।

শুনানির সময় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সাংবাদিক শামসকে যুক্তি শুনতে দেখা যায়। তার মধ্যে তেমন কোন ভাবান্তর দেখা যায়নি।

প্রায় ২৫ মিনিট শুনানি নিয়ে তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন।

কেন গ্রেপ্তার

শামস প্রথম আলোর সাভারে কর্মরত নিজস্ব প্রতিবেদক। তিনি থাকতেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া আমবাগান এলাকায় একটি ভাড়া বাসায়। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পাস করেন তিনি।

তার ভাই ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান বেকারিতে অভিযান চালাতে গিয়ে প্রাণ হারানো পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলামও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।

প্রথম আলোয় গত ২৬ মার্চ প্রকাশিত যে প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা চলছে, তার প্রতিবেদক ছিলেন শামস। ওই প্রতিবেদনে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ উপাদান থাকার কথা বলছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা।

একজন শ্রমজীবী মানুষকে উদ্ধৃত করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।”

ওই মন্তব্য ধরে শিরোনাম করা হলেও ছবি দেওয়া হয় আরেক শিশুর, যার কথা প্রতিবেদনের ভেতরে ছিল। ওই ছবি ও শিরোনাম দিয়ে সোশাল মিডিয়ায় একটি কার্ড পোস্ট করা হয়, যা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলে একাত্তর টেলিভিশনে একটি প্রতিবেদনও প্রচার করা হয়।

পরে প্রথম আলো প্রতিবেদনটি থেকে ছবি সরিয়ে শিরোনাম বদলে দেয়। পাশাপাশি তাদের সোশাল মিডিয়ায় দেওয়া পোস্টও প্রত্যাহার করা হয়। 

প্রতিবেদন প্রকাশের তিন দিন পর বুধবার সকালে খবর আসে, শামসকে তার সাভারের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ‘সিআইডি’ পরিচয় দিয়ে।

সেই বাড়ির বাড়িওয়ালা, প্রত্যক্ষদর্শী একজন স্থানীয় সাংবাদিক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললেও পুলিশ কর্মকর্তারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন।

দুপুরের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, শামসের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। কেউ বিচার চাইলে পুলিশ ব্যবস্থা নিতেই পারে।

তখন জানা যায়, মঙ্গলবার গভীর রাতে একজন যুবলীগ নেতা শামসের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আর বুধবার গভীর রাতে আরেকটি মামলা হওয়ার খবর জানা যায় বৃহস্পতিবার সকালে।

সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে নেওয়া হলে, জামিন আবেদন খারিজ করে কারাগারে পাঠানো হল এই সাংবাদিককে।