ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
Published : 10 Aug 2024, 09:39 PM
দেশের পঞ্চবিংশতিতম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন হাই কোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ; যাকে নিয়োগের দাবি জানিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
শনিবার রাতে রাষ্ট্রপতির আদেশে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে।
এতে বলা হয়, শপথ গ্রহণের তারিখ থেকে তার এ নিয়োগ কার্যকর হবে।
ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে এদিন বিকালে পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাত সাড়ে ৯টার দিকে নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ঘোষণা এল।
উচ্চ বিচারালয়ের বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দিনভর বিক্ষোভের মধ্যে এসব পরিবর্তন হল।
প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের পর রাতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আরও পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। দুপুরে তারা পদত্যাগ করবেন বলে জানিয়েছিলেন।
পরে রাতে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি কাশেফা হোসেন পদত্যাগ করেন বলে প্রজ্ঞাপনে জানায় আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
এতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন।
প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সাত বিচারপতিদের মধ্যে শুধু বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের পদত্যাগের খবর আসেনি। তাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি করা হচ্ছে বলেও খবর আসে। তখন শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তা বাতিলের দাবি জানায়।
একই সঙ্গে সকাল ৯টার মধ্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুইবারের উপদেষ্টা প্রয়াত আইনজীবী ইশতিয়াক আহমেদের ছেলে সৈয়দ রেফাত আহমেদকে প্রধান বিচারপতি করার আল্টমেটাম দেওয়া হয়।
এরই মধ্যে রাতে আইন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, বিচারপতি আশফাকুলকে ভারপ্রাপ্ত বিচারপতি করার খবরটি ‘বিভ্রান্তিকর’। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এমন কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি।
এর ঘণ্টা খানেক পর অক্সফোর্ড থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী সৈয়দ রিফাত আহমেদকে দেশের পঞ্চবিংশতম বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
শপথের দিন থেকে তার নিয়োগ কার্যকর হবে। নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তাকে শপথ পড়াবেন।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু তিনি (সৈয়দ রেফাত আহমেদ) সরাসরি হাই কোর্ট ডিভিশন থেকে প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন, সেক্ষেত্রে একবারই শপথ নিলে হবে। তিনি আপিলেট ডিভিশন ও প্রধান বিচারপতি হিসেবে একইসঙ্গে শপথ নেবেন।”
হাই কোর্টের বিচারপতিদের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সৈয়দ রেফাত ২০০৩ সালের ২৭ এপ্রিল হাই কোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হন। দুই বছর পর ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল হাই কোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।
তার বাবাও একজন খ্যাতনামা আইনজীবী; প্রয়াত সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম অতিরিক্ত অ্যার্টনি জেনারেল, যিনি পরে অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বও পালন করেন।
সৈয়দ রেফাতের মা জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক ছিলেন।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ওয়াদাম কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী সৈয়দ রেফাত আইনজীবী হিসেবেও কাজ করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টাফ্টস ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোমেসিতে মাস্টার্স ও পিএইচডিও করেছেন।
তিনি ১৯৮৪ সালে ঢাকা জেলা আদালতে এবং ১৯৮৬ সালে হাই কোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে নিবন্ধিত হন।
আদালতে নাটকীয় এক দিন
শনিবার সকাল থেকে দেশের উচ্চ আদালতকে ঘিরে দিনভর নাটকীয় ঘটনার সংবাদ আসতে থাকে।
প্রধান বিচারপতি সকালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়ে ফুলকোর্ট সভা আহ্বান করলেও আন্দোলনকারীরা ঘেরাওয়ের ডাক দেওয়ার পর তা স্থগিত করা হয়।
পরে সরকার পতনের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে আন্দোলনকারীরা আপিল বিভাগের সব বিচারকের পদত্যাগের দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও করে।
তাদের দাবি মানা না হলে প্রধান বিচারপতির বাসভবন ঘেরাওয়েরও হুঁশিয়ারি দেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঘিরে গড়ে ওঠা এ প্ল্যাটফর্মের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
শিক্ষার্থীদের জমায়েতের পর এক সময় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকের দায়িত্ব পালন করা বিচারপতি ওবায়দুল হাসান পদত্যাগ করেছেন বলে ফেইসবুকে এক ভিডিও বার্তায় খবর দেন অন্তর্বতীকালীন সরকারের আইন ও বিচার উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
তিনি বলেন, “আমাদের প্রধান বিচারপতি কিছুক্ষণ আগে পদত্যাগ করেছেন। উনার পদত্যাগপত্র ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ে এসে পৌঁছেছে।
“এটা উপযুক্ত প্রসেসিংয়ের জন্য আমরা কালবিলম্ব না করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেব। এবং আমি আশা করব যে এটা খুব দ্রুত, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।”
২০২৪ সেপ্টেম্বরে দেশের চতুর্বিংশতিতম প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে আসা ওবায়দুল হাসানের ২০২৬ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিচার অঙ্গনের নেতৃত্বে থাকার কথা ছিল।
বেলা দেড়টার দিকে প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা গেলে ২টার দিকে আন্দোলনকারীরা হাই কোর্ট এলাকা ছেড়ে চলে যান।
ছাত্র-জনতার তুমুল গণ আন্দোলনের মধ্যে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের যে দাবি উঠেছে, তার ধাক্কায় মেয়াদপূর্তির দেড় বছর আগেই প্রধান বিচারপতিকে সরে যেতে হল।
ঘটনাবহুল এ দিনের পর রাতে আপিল বিভাগের আরও পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন।
আরও পড়ুন:
পদ ছাড়তে হল প্রধান বিচারপতিকেও
আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতির পদত্যাগ
ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির তথ্য 'বিভ্রান্তিকর', সৈয়দ রেফাতকে চান
করণীয় কী, সেটা প্রধান বিচারপতিই বুঝবেন: আইন উপদেষ্টা
দাবির মুখে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত প্রধান বিচারপতির
আদালত ঘেরাওয়ের ডাকে ফুলকোর্ট সভা স্থগিত
প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও
ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি পদে আশফাকুলকে 'প্রত্যাখ্যান' আন্দোলনকা