শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের যে দাবি উঠেছে, তার ধাক্কায় মেয়াদপূর্তির দেড় বছর আগেই প্রধান বিচারপতিকে সরে যেতে হল।
Published : 10 Aug 2024, 03:41 PM
ক্ষমতার পালাবদলে বিচারালয়ের শীর্ষ পদ থেকে সরে যাওয়ার দাবি প্রবল হওয়ার পর পদত্যাগে বাধ্য হলেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
শনিবার বিকালে ফেইসবুকে এক ভিডিও বার্তায় এ খবর দিয়ে অন্তর্বতীকালীন সরকারের আইন ও বিচার উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, “আমাদের প্রধান বিচারপতি কিছুক্ষণ আগে পদত্যাগ করেছেন। উনার পদত্যাগপত্র ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ে এসে পৌঁছেছে।
“এটা উপযুক্ত প্রসেসিংয়ের জন্য আমরা কালবিলম্ব না করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেব। এবং আমি আশা করব যে এটা খুব দ্রুত, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।”
এক সময় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকের দায়িত্ব পালন করা বিচারপতি ওবায়দুল হাসান দেশের চতুর্বিংশতিতম প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে আসেন গত বছরের সেপ্টেম্বরে। ২০২৬ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত তার বিচার অঙ্গনের নেতৃত্বে থাকার কথা ছিল।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের যে দাবি উঠেছে, তার ধাক্কায় মেয়াদপূর্তির দেড় বছর আগেই প্রধান বিচারপতিকে সরে যেতে হল।
শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে আন্দোলনকারীরা শনিবার আপিল বিভাগের সব বিচারকের পদত্যাগের দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট ঘোরাও করে।
তাদের দাবি মানা না হলে প্রধান বিচারপতির বাসভবন ঘেরাওয়েরও হুঁশিয়ারি দেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
এনেক্স ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা স্লোগান তোলেন– 'এক দুই তিন চার, বিচারপতি গদি ছাড়', 'হাসিনার দালালেরা হুঁশিয়ারি সাবধান', 'অ্যাকশন অ্যাকশন বিচারপতির বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন', 'ঘেরাও ঘেরাও ঘেরাও হবে, বিচারপতির ভবন ঘেরাও হবে’।
প্রধান বিচারপতি সকালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়ে ফুলকোর্ট সভা আহ্বান করলেও আন্দোলনকারীরা ঘেরাওয়ের ডাক দেওয়ার পর তা স্থগিত করা হয়।
ফুলকোর্ট সভা আহ্বানের পর পরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক, বর্তমানে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ফেইসবুক পোস্টে লেখেন, “ফ্যাসিবাদের মদদপুষ্ট ও নানান অপকর্মে জড়িত সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সরকারের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা না করে ফুলকোর্ট মিটিং ডেকেছেন।
“পরাজিত শক্তির যে কোনো প্রকার ষড়যন্ত্র বরদাশত করা হবে না। আইনজীবীরা এরইমধ্যে এর প্রতিবাদে জড়ো হয়েছেন। আমরা আগেই প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলাম। ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের উসকানি দিলে এর ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হবে।
“অনবিলম্বে বিনা শর্তে প্রধান বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করুন এবং ফুল কোর্ট মিটিং বন্ধ করুন।”
এর পরপরই প্রধান বিচারপতির ডাকা ফুলকোর্ট সভা স্থগিত করার খবর পাওয়া যায়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম জানান, পদত্যাগের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। আর বিকালে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের খবর দেন আইন উপদেষ্টা।
তবে কেবল প্রধান বিচারপতির পদত্যাগপত্রই মন্ত্রণালয় পেয়েছে জানিয়ে উপদেষ্টা ভিডিও বার্তায় বলেন, “অন্যদের ব্যাপারে কোনো আপডেট নাই। আপনারা সবাই শান্ত থাকবেন। দেশের সম্পদ নষ্ট করবেন না।”
এরপর কী
পরে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে পরবর্তী প্রক্রিয়া নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইন উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “পরবর্তী (প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ) প্রক্রিয়াটা হচ্ছে আইন উপদেষ্টা হিসেবে আমার স্বাক্ষরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অফিসে যাবে। উনি এখন রংপুরে আছেন বা সম্ভবত বিমানে আছেন, তিনি নেমে আসার পর তার সম্মতি সাপেক্ষে এটা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। রাষ্ট্রপতি এটা গ্রহণ করলে কার্যকর হবে।
“আমরা আশা করছি এটা আজকের মধ্যেই হবে। এর পরপর নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে চাচ্ছি না।”
নতুন প্রধান বিচারপতি কে হচ্ছেন জানতে চাইলে আসিফ নজরুল বলেন, “সেটা আমরা বলব না, তবে একটা জিনিস বলব, প্রধান উপদেষ্টার মতামত গ্রহণ করব। কনসার্ন যারা আছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলব। আমার মন্ত্রণালয় থেকে যদি এ বিষয়ে কোনো ভূমিকা রাখার থাকে, চেষ্টা করব সবচেয়ে যোগ্য, সৎ এবং নিরপেক্ষ একজন মানুষকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার।”
আন্দোলনকারী ছাত্ররা আপিল বিভাগের অন্য বিচারকদের পদত্যাগেরও দাবি করছে। এ বিষয়ে আসিফ নজরুল বলেন, “আপিল বিভাগের আরও যারা আছেন, তাদের পদত্যাগের দাবির কথা আমি শুনেছি। শুনেছি অন্যরাও পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে এখনো পদত্যাগপত্র আইন মন্ত্রণালয়ে আসেনি।”
বদলে যাওয়া পরিস্থিততে গত বুধবার পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনার সময় নিয়োগ পাওয়া অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান, যিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক এবং দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকের দায়িত্বে ছিলেন ওবায়দুল হাসান
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ওবায়দুল হাসান দেশের চতুর্বিংশতিতম প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে আসেন গত বছরের সেপ্টেম্বরে।
রাষ্ট্রপতির আদেশে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ১২ সেপ্টেম্বর নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বিচারাঙ্গনের সর্বোচ্চ পদে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর স্থলাভিষিক্ত হন।
সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী, ৬৭ বছর বয়স, অর্থাৎ ২০২৬ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত তার প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকের দায়িত্ব পালন করে আসা বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ইসি নিয়োগের সর্বশেষ সার্চ কমিটির প্রধান ছিলেন।
১৯৫৯ সালের ১১ জানুয়ারি নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ থানার ছয়াশী (হাটনাইয়া) গ্রামে ওবায়দুল হাসানের জন্ম। তার বাবা আখলাকুল হোসাইন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। তার মায়ের নাম বেগম হোসনে আরা হোসাইন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার পর আইনে লেখপড়া করেন ওবায়দুল হাসান। এলএলবি শেষ করে ১৯৮৬ সালে তিনি আইনজীবী হিসেবে জেলা বারের তালিকাভুক্ত হন।
পরে ১৯৮৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের এবং ২০০৫ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ওবায়দুল হাসান।
সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ডেপুটি এটর্নি জেনারেল হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনের পর ২০০৯ সালের ৩০ জুন অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে যোগ দেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। নিয়ম অনুযায়ী, দুই বছর পর তার নিয়োগ স্থায়ী হয়।
হাই কোর্টে দায়িত্ব পালন কালেই ২০১২ সালের ২৩ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারক হিসেবে যোগ দেন দেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই সময়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে ১১টি যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় আসে।
২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারক হিসেবে নিয়োগ বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
তার ভাই সাজ্জাদুল হাসান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের নেত্রকোণা-৪ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ছিলেন তিনি।
পুরনো খবর
করণীয় কী, সেটা প্রধান বিচারপতিই বুঝবেন: আইন উপদেষ্টা
দাবির মুখে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত প্রধান বিচারপতির