নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন হবে কবে

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে পাঁচ মাস আগে থেকেই সরব হয়ে উঠছে রাজনৈতিক অঙ্গন, আবার আলোচনায় আসছে আইন করার দাবি।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Sept 2021, 05:58 AM
Updated : 17 Sept 2021, 05:58 AM

আগামী ফেব্রুয়ারিতে নতুন যে নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেবে, ২০২৩ সালের শেষে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ভার তাদের ওপরই থাকবে।  

সংবিধান অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির হাতে। গেল এক দশকে সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ২০১২ সালে এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২০১৭ সালে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে সর্বশেষ দুই নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিয়েছিলেন।

সাংবিধানিক এ সংস্থার সদস্যদের নিয়োগে আইন করার কথা থাকলেও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে তা হয়নি। এ নিয়োগ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধী দলগুলোর সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে সরকারকে। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এ বিষয়ে মতভেদ আছে। 

কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন ৫ সদস্যের বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি। তার আগেই নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের কাজটি সারতে হবে।

সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং এ বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধান সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেবেন।

কিন্তু সংবিধানের আলোকে ওই আইন না হওয়ায় প্রতিবারই নির্বাচন কমিশন গঠনে জটিলতা দেখা দেয়। সেই জটিলতা এড়াতে গত দুইবার সার্চ কমিটির ব্যবস্থা হলেও বিতর্ক থামেনি।

কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন; যাদের হাতে হয়েছে একাদশ সংসদ নির্বাচন।

গত দুইবারের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নতুন বছরের আগেই মধ্য ডিসেম্বরে সংলাপ শুরুর উদ্যোগ নেন রাষ্ট্রপতি। মধ্য জানুয়ারিতে সংলাপ শেষ হয়। সার্চ কমিটি  গঠিত হয়ে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে; নাম প্রস্তাব, বাছাই শেষে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সিইসি ও ইসির নাম প্রকাশ করা হয়। এভাবেই কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ ও কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব পেয়েছিল।

অতীতে সর্বোচ্চ ৭ জনের কমিশন গঠনের নজির থাকলেও সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৫ সদস্যের ইসি গঠনের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।  

সার্চ কমিটির মাধ্যমে বর্তমান ইসিতে একজন নারী কমিশনারও নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি; যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম

বর্তমান কমিশন গঠনের আগে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। সেখানে দলগুলো পাঁচটি করে নাম প্রস্তাব করেছিল। সেই নামগুলো বিবেচনায় নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি মোট ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করে। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ পাঁচ সদস্যের বর্তমান কমিশন গঠন করেন।

প্রধান বিরোধী দলের ভাষ্য কী

জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও নির্বাচন কমিশন গঠনে দেশে একটি আইন না থাকা ‘অত্যন্ত দুঃখজনক’।

তার ভাষায়, সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে ‘সমালোচনার’ সৃষ্টি হয়। আবার দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কমিশনার নিয়োগ হলে মানুষের ভোটাধিকার লংঘিত হয়।

বিরোধী দীলয় উপনেতা জি এম কাদের বলেন, “তাই সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল ও এ বিষয়ে সিভিল সোসাইটির বিশেষজ্ঞদের সাথে অলোচনা সাপেক্ষে গ্রহণযোগ্য একটি আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।”

২০১৭ সালের আগে ইসি গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

ক্ষমতাসীনরা কী বলছে?

আওয়ামী লীগ নবম সংসদ থেকে টানা ক্ষমতায় রয়েছে। তাদের মেয়াদেই গেল দুটো ইসি গঠন করা হয়। ক্ষমতাসীন দলটি বরাবরই ইসি নিয়োগে আইন করার পক্ষে মত দিয়ে এসেছে, কিন্তু আইন আর হয়নি।

ফলে এবারও সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন করা হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আইনমন্ত্রীর বক্তব্যই তাদের দলের প্রতিনিধিত্ব করছে।

এবারও সার্চ কমিটি হতে পারে ইংগিত দিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেই তো নিয়ম আছে এখন পর্যন্ত; সেভাবেই হবে। আইন প্রণয়নের চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে আইন হবে কিনা আমি জানি না।”

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে রাষ্ট্রপতির সংলাপ হবে কিনা, হলে কীভাবে, কবে নাগাদ হবে- এ নিয়ে আগাম কিছু বলতে রাজি নন আইনমন্ত্রী।

তার ভাষায়, “সংলাপের উদ্যোগ নেবে কিনা, তা মহামান্যেরে অফিস বলতে পারবে।”

এ সংসদে আইন হলেও মানবে না বিএনপি

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ইসি গঠনের আইন প্রণয়নের বিরোধিতা করে আসছে বিএনপি।

নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের উপর জোর দিয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “আপনারা আইন করবেন পার্লামেন্টে, যেখানে আর কেউ নেই, কথা বলার সুযোগ নেই।

“আপনারা একরতফা আইন পাস করে নিয়ে যাবেন আপনাদের সুবিধার জন্য। সেই আইনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে সেটাও এদেশের মানুষ মেনে নেবে না।”

পাঁচ বছর আগেও একই কথা বলেছিলেন বিএনপি মহাসচিব। এখন আইন প্রণয়নের বদলে সার্চ কমিটির পক্ষেই সায় দিচ্ছে দলটি।

ফখরুলের ভাষায়, বর্তমান জাতীয় সংসদ ‘অবৈধ’; তারা নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়ন করতে ‘পারে না’। সে কারণে তারা ‘নিরপেক্ষ’ সার্চ কমিটি চায়।

গত ৩১ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের নতুন ভবন উদ্বোধন হলেও তার সামনে স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্যটির নাম এখনও দেওয়া হয়নি। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক

আর কত অপেক্ষা

২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ইসি গঠনের জন্য আইনের একটি খসড়া তৈরি করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইনটি হয়নি।

সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে সেই কমিশনের সদস্য মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন হয়েছে। আবারও হবে হয়ত।... আমরা তো উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আর কত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে যে কোনোভাবেই হোক আইন বানাতে হবে।“

তার ভাষায়, ক্ষমতায় থাকলে বা না থাকলে ইসি গঠনের আইন নিয়ে রাজতৈনিক দলগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থান থাকতে পারে। আইন প্রণয়নে কেউ রাজি থাকবে, কেউ রাজি থাকবে না। তারপরও সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি আইন বানাতে হবে, যার অধীনে নিয়োগ বিধি থাকতে হবে।

সাবেক এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, “নিয়োগ বিধি না থাকার কারণে আমরা যে খুব ভালো ফল পাচ্ছি- আমার মনে হয় না। সমালোচনা যে হচ্ছে সেটাও ভালো। সমস্যাটা চিহ্নিত হচ্ছে, সমাধানও আসবে।“

এ বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “সরকারকেই নিতে হবে ভূমিকা। আমাদের এখানে ল কমিশন রয়েছে, তারাও নিতে পারেন। এত বড় সমস্যা, এটা নিয়ে ল কমিশনের অবশ্যই চিন্তা করা উচিত। ল কমিশন সাজেশন দেবে কীভাবে হতে পারে, কীভাবে হবে, না হবে।“

সরকার ‘চাইলে’ সহায়তা দেবে আইন কমিশন

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হক বলছেন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগের আইনি বিষয়ে আলোকপাত করতে পারবেন আইনমন্ত্রী। তবে সার্চ কমিটি গঠনের কোনো বাধ্যবাধকতা কোথাও নেই। সার্চ কমিটি হতেও পারে, নাও হতে পারে।

সাবেক এ প্রধান বিচারপতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইনমন্ত্রী, আইন মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয় যদি আমাদের কাছে (ইসি নিয়োগ আইনের) কোনো সুপারিশ চায়, আমরা ডেফিনিটলি চেষ্টা করতে পারি। আমাদের কাছে তো কোনো সুপারিশ আসেনি। এলে তো অবশ্যই দেখব।”

পুরনো খবর