বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের একজন সাবেক চেয়ারম্যান বলছেন, “পৃথিবীর কোথাও এতো ছোট্ট জায়গায় এত বিশ্ববিদ্যালয় নেই।”
Published : 26 Apr 2024, 01:25 AM
তথ্য-প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ থেকে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলেন হাসিবুল আলম প্লাবন। স্নাতক শেষ বর্ষে এসে এই শিক্ষার্থীর অনুধাবন, যে দক্ষতা অর্জন করা দরকার, বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সুযোগ পাচ্ছেন না তিনি।
এই শিক্ষার্থী বলেন, “আমাদের শিক্ষকদের অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অধ্যাপক নাই। ডিজিটাল ক্ষেত্রগুলোতে শিক্ষকরাই অনেক পিছিয়ে আছেন।”
গত কয়েক বছরে বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির মত বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় পৌনে দুইশতে।
এত এত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে যেমন দক্ষ শিক্ষক নিশ্চিত করা যায়নি, তেমনি যথাযথ অবকাঠামোও গড়ে ওঠেনি। বহুমুখী সংকটে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত না হওয়ায় শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছে ক্ষোভ আর হতাশা।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, গতানুগতিক ধারায় বিশ্ববিদ্যালয় করতে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে প্রয়োজনীয় কাজগুলো নজরের বাইরে থেকে যাচ্ছে। ‘শিক্ষিত বেকার’ তৈরি করা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তেমন কোনো দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারছে না।
‘গণহারে’ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সমালোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পৃথিবীর কোথাও এতো ছোট্ট জায়গায় এত বিশ্ববিদ্যালয় নেই।”
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরীও উচ্চশিক্ষার মান নিম্নমুখী হওয়ার পেছনে ‘অনিয়ন্ত্রিতভাবে’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানোকে দায়ী করছেন।
ইউজিসি অবশ্য আশাবাদী, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আগামী ২০ বছরে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতের সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে বলেই কমিশনের কর্মকর্তাদের বিশ্বাস।
বিশ্ববিদ্যালয় আছে, ‘মান নেই’
ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫৫টি সরকারি ও ১১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও পরিচালনা নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশে সামনের সারিতে আছে যে কটি শিক্ষায়তন, তার একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একজন শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, ‘মান্ধাতা আমলের’ নোট থেকে তাদের পড়ানো হয়, সমসাময়িক বিষয়ের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য থাকে না।
“যে আশা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম, সেটি পূরণ হয়নি। এখানে ২০ বছর আগে যে নোট তৈরি করা হয়েছে, সেটা দেখেই পড়ানো হচ্ছে। স্বজনপ্রীতি অনেক বেশি। সবার প্রতি সমান নজর দেয়া হয় না, পক্ষপাত করা হয়।”
দেশের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, একটি কোর্সে ৪০-৫০টি ক্লাস নেওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষকরা ১০-১২টি ক্লাস নেন।
“তারা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ক্লাস নেন। যেখানে মূল যেই চাকরি, সেখানে তারা সময় দিতে পারেন না। গত ১৫-২০ বছরে শিক্ষক নিয়োগে এত বেশি অনিয়ম হয়েছে, লেখাপড়ার মান কমে গেছে।”
এই শিক্ষার্থী বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় কয়েক দশক পরে কোন পর্যায়ে যাবে, তার একটি দীর্ঘমেয়াদী অ্যাকাডেমিক পরিকল্পনা থাকা উচিত।
“কিন্তু কোনো পরিকল্পনা নেই। সব চলছে অ্যানালগ পদ্ধতিতে। এমনকি সাধারণ একটা পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে চার জায়গায় দৌঁড়াতে হয়।”
ঢাকার আরেক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংকট আরও গভীর। দেড় যুগেও পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্পাস হয়নি। ছাত্রীরা একটি হল পেলেও ছাত্রদের কোন আবাসন সুবিধা নেই। আবাসন সুবিধার চেয়েও বড় অন্তরায় হয়ে উঠেছে প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের অভাব।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগে প্রায় ১০ বছরে মাত্র একটি ব্যাচ স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে। বাকি ব্যাচগুলোতে সেশনজট লেগেই আছে। আটটি ব্যাচের জন্য রয়েছে মাত্র চারটি ক্লাসরুম। কোন ল্যাব, সেমিনার রুম নেই।
৬ বছরেও স্নাতক শেষ করতে না পারা এক শিক্ষার্থী হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “আমরা অনুশীলনের কোনো সুযোগ পাই না। মাত্র দুইটা ক্যামেরা, একটা এডিটিং কম্পিউটার আছে। কম্পিউটারও ব্যবহারের সুযোগ পাই না। স্যাররা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। শুটিংয়ের সময় ক্যামেরা ভাড়া করে আনতে হয়।
“কয়েকজন শিক্ষক গুগল দেখে পড়ান। কেউ কেউ ক্লাসে এসে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের গল্প করতে থাকেন। টিভি টকশোতে যেতে পারেন, কিন্তু ক্লাস নেওয়ার সময় পান না; ক্লাস হয় খুব কম।”
বিশ্ববিদ্যালয়ে গুণগত শিক্ষা যে নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যেও আক্ষেপ আছে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান রাহাত বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যে লজিস্টিকস দেওয়া দরকার, সেটা হচ্ছে না। আমাদের খুঁড়িয়ে চলতে হয়।”
শিক্ষক নিয়োগের মানদণ্ড হিসেবে শুধু ফলাফলকে বিবেচনায় রাখায় শিক্ষার মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারহা তানজীম তিতিল।
“একজন ভালো ছাত্র, কিন্তু সে ভালো শিক্ষক কিনা– সেটি আমরা দেখি না। শিক্ষক নিয়োগ করা হয় চাকরি দেওয়ার জন্য। ৮০ শতাংশ শিক্ষক ও সমাজ এই পেশাকে চাকরি হিসেবে দেখেন– কিন্তু এটি প্যাশন হওয়া উচিত। আমরা শিক্ষককে মর্যাদা দিই না, বেতন দেই না। এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট এবং পলিসির জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে।”
এই দুই শিক্ষকই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকটের বিষয়টি সামনে এনেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থীই আবাসন সুবিধা পান না।
মানসম্পন্ন শিক্ষা ও সময়োপযোগী পাঠদান ব্যবস্থা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং অর্থও বরাদ্দ নেই। ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় ১টাকাও খরচ করেনি। ১ লাখের কম খরচ করেছে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে বাজেট সংকট বড় কারণ।
“মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রথমেই দেখতে হবে আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কী সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছি। একজন শিক্ষককে তৈরি করে নিতে হয়। তাকে গবেষণার সুযোগ, প্রশিক্ষণ দিতে হয়। সেই পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে না।
“বেশিরভাগ ব্যয় হয়ে যায় বেতনভাতা, পেনশন ফান্ড ও পরিবহনে। শিক্ষকদের জন্য লাইব্রেরি সুবিধা দেওয়া, আন্তর্জাতিক জার্নালে লিখতে উদ্বুদ্ধ করা, এগুলো করতে হবে।”
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি, রসায়নের মত বিষয়েও পর্যাপ্ত ল্যাব সুবিধা নেই বলে জানান সাদেকা হালিম।
বিশ্ববিদ্যালয়ে জরুরি সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে না পারায় বৈশ্বিক গুণমান বিচারে দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জায়গা হচ্ছে তলানিতে।
কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের র্যাংকিংয়ে এশিয়ার সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই।
টাইমস হায়ার এডুকেশনের সবশেষ র্যাংকিংয়ে বিশ্বের সেরা ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এই ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভারতের ২৪টি এবং পাকিস্তানের ৮টি বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা পেয়েছে।
এসব নিয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যেও অসন্তোষ রয়েছে। সম্প্রতি ৩৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করেছে ইউজিসি। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খোদ শিক্ষামন্ত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠদান নিয়ে সমালোচনা করে আসছেন।
এর মধ্যেও নূন্যতম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করেই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করা হচ্ছে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির এলাকায় ২০২০ সালে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। এখনো পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পায়নি, গত বছর ভাড়া বাসায় ৯০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়।
২০২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও নিজস্ব ক্যাম্পাস পায়নি। ১৮০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম চলছে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে।
সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভাড়া বাসায় কার্যক্রম চালাচ্ছে। প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পরও ভাড়া বাসায় চলছে ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম।
এমন বাস্তবতার মধ্যেই গত বছর ১৬টি নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কার্যক্রম এগিয়েছে।
দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও গত দেড় দশকে শিক্ষার জন্য দেশ ছাড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ। ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পড়ার জন্য বিদেশে গেছেন ৫২ হাজার ৭৯৯ শিক্ষার্থী। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, এমনকি প্রতিবেশী ভারতের প্রতিও শিক্ষার্থীদের আগ্রহ রয়েছে।
আসন থাকছে ফাঁকা
২০২৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় সোয়া ১০ লাখের কিছু কম শিক্ষার্থী। এর বিপরীতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসন ছিল সোয়া ১৩ লাখের বেশি।
সবশেষ ভর্তি পরীক্ষায় দেখা যায়, কয়েকটি মেধা তালিকা দিয়েও গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুই হাজারের বেশি আসন ফাঁকা ছিল।
অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিও শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে এসেছে। শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকায় এসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী পাচ্ছে না।
ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটিতে ৩ হাজার আসন থাকলেও ২০২২ সালে ভর্তি হয় মাত্র ২৫৭ জন; সবমিলিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৫৬৪ জন। ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি গবেষণার পেছনে ব্যয় করে মাত্র ২০ হাজার টাকা।
একই বছর দি মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটিতে ১ হাজার ৫শ আসনের বিপরীতে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে ১৩৫ জন।
বেসরকারি আশা ইউনিভার্সিটি ২ হাজার আসনের বিপরীতে ২০২২ সালে শিক্ষার্থী পেয়েছে ৪০৫ জন; সবমিলিয়ে তাদের শিক্ষার্থী ৭০৭ জন। ২০২২ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার জন্য এক টাকাও খরচ করেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন বাড়লেও সময়োপযোগী শিক্ষা গ্রহণের ধারণা হালে পানি পায়নি।
ইউজিসির তথ্য বলছে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কলা ও মানবিকে ৪০ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সামাজিক বিজ্ঞানে ২৫ দশমিক ৫২ শতাংশ, বাণিজ্যে ১৮ দশমিক ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ছে।
বিপরীতে প্রকৌশল ও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থী রয়েছে ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। বিজ্ঞানে ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং কৃষিতে ২ দশমিক ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ছে।
পাঁচ দশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, “রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় করতে গিয়ে পরিকল্পনাহীনভাবে উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটানো হচ্ছে। কোথায় বিশ্ববিদ্যালয় দরকার, কোথায় কারিগরি প্রতিষ্ঠান দরকার- সেগুলো নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা নেই।”
এর ফলে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক তরুণদের ঘিরে যে সম্ভাবনা, তা কাজে লাগানোর মত পরিবেশ তৈরিতে শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যর্থ হচ্ছে বলে তার ধারণা।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, দেশে ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ বা ২৫ লাখ ৮২ হাজার মানুষ বেকার, যাদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষিতদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
সরকারি এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় ও সমপর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সনদধারীদের মধ্যে বেকারের হার ১২ শতাংশ। জরিপে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে প্রায় আট লাখ বেকারের তথ্য থাকলেও বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা বেকারের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
এর পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ার সম্পর্ক দেখিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মান্নান বলেন, “একটি বিশ্ববিদ্যালয় না করে দশটি কারিগরি প্রতিষ্ঠান করলে তা অনেক বেশি কাজে আসত। এত এমবিএ, বিবিএ পাস করে, লাখ লাখ ছেলে বেকার।”
এই শিক্ষাবিদ মনে করেন, বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষায় সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে ‘যোগ্য শিক্ষকের মারাত্মক অপ্রতুলতা’।
ইউজিসির সবশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অন্তত ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর বিপরীতে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী শিক্ষক নেই। এই প্রতিবেদনে ১১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের তথ্য রাখা হয়নি। ফলে ধারণা করা যায়, প্রায় অর্ধেক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক সংকট রয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭২টিতে অধ্যাপক রয়েছেন ১০ জনের কম। ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর আনুপাতিক হারে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। উপাচার্য নেই ৪০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এমিরিটাস অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরীর প্রশ্ন, “এখন এত ভিসি, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার, প্রোভিসি, শিক্ষক কোথা থেকে আসবে? এটি অনেক বড় সংকট। এগুলো পরিকল্পিতভাবে না করে যে কেউ অনুমতি চাইল আর তাদের খুশি করার জন্য অনুমতি দিয়ে দিলেই তো হবে না।”
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, সংখ্যা, গুণ এবং প্রয়োজন– এগুলোর সমন্বয় করে পাবলিক ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সংখ্যা বাড়াতে হবে।
অধ্যাপক এ কে আজাদ বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া ভালো। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিতভাবে এই সংখ্যা বেড়ে গেলে গুণমান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। যখন কম সংখ্যায় থাকে, তখন সেটার কোয়ালিটি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এটা থেকে হঠাৎ করে সংখ্যা বাড়তে থাকলে ‘কোয়ালিটি মেইনটেইন’ করা কষ্টসাধ্য।”
কি করা উচিত?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তারিক আহসানের ভাষ্য, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিখন ব্যবস্থা যেভাবে চলছে, পৃথিবীর বাস্তবতা থেকে তা অনেকটা পিছিয়ে।
“বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ হচ্ছে জ্ঞান সৃষ্টি করা, কিন্তু সেটি না হয়ে যদি কোর্সগুলো বেশি মাত্রায় সার্টিফিকেট নির্ভর হয়ে যায়, অ্যাপ্লায়েড ও ক্রিয়েটিভ দিকগুলো যদি ডেভেলপড না হয়– তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেই কোর্সগুলোর কোনো প্রয়োজনীয়তা নাই।”
এই শিক্ষাবিদ বলেন, “সামনের পৃথিবী যেদিকে ধাবিত হচ্ছে সে বিষয়গুলোতে জোর দিয়ে কোর্স ডিজাইন করতে হবে। কোর্সগুলোর ডিজাইনে পরিবর্তন আনা জরুরি।”
এর সঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনায় আন্তর্জাতিক মানের নীতিমালা করার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
অধ্যাপক তারিক আহসান বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ন্ত্রণের দিকে যেমন খেয়াল রাখতে হবে, আমরা কোন ধরনের প্রোগ্রাম ডিজাইন করছি এবং সেগুলোকে কীভাবে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও জ্ঞান বিকাশে সহায়তা করছি, এই জায়গাটিতে নজর দেওয়া জরুরি।”
অধ্যাপক মান্নান বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে বেশি জরুরি ছিল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সময়ের সঙ্গে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালানো।
“বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামগুলো আপডেটেড না। বিশেষ করে বিজ্ঞানের কারিকুলাম ক্রমাগত বদলাচ্ছে। কিন্তু আমরা সেগুলোতে নজর না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা সার্টিফিকেটধারী বেকার তৈরি করছি।”
কারিগরি, প্রকৌশল ও কৃষি শিক্ষার মত বিষয়ে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় না এই মুহূর্তে বাংলাদেশে জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয় দরকার আছে। দরকার কারিগরি শিক্ষার; ভোকেশনাল ট্রেনিং, স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফোকাস দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করা। সেগুলো না করে আমরা বিদেশী দক্ষতা, কারিগর ও ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে আসছি। তাহলে আমরা দেশে কী পড়াচ্ছি?”
‘সরকারি আমলারাও এখন উপাচার্য হয়ে যাচ্ছে’ মন্তব্য করে অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, “শিক্ষাটাকে শিক্ষাবিদদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। বাংলাদেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে– অপরিকল্পিতভাবে উচ্চশিক্ষার প্রসার ও যার কাজ শিক্ষার না, তাকে সে দায়িত্ব দেওয়া।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এ কে আজাদ চৌধুরী বলছেন, প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাখ লাখ শিক্ষার্থী বের হলেও তাদের চাকরি দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
“এর পেছনে সরকারের যুক্তি থাকতে পারে যে, তারা উচ্চ শিক্ষার প্রসার করতে চান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাজেট দিতে হবে। দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেট বাড়াতেই হবে। সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।”
যা বলছে ইউজিসি
এই বাস্তবতার মধ্যে ইউজিসির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীরের দাবি, মানসম্পন্ন শিক্ষার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যার কোনো বিরোধ নেই।
“বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিশ্ববিদ্যালয় আস্তে আস্তে গড়ে উঠবে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোয়ালিটি অর্জন করতে হয়তো আরও ১৫ বা ২০ বছর লাগবে। সেটা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করে। সে তার সক্ষমতা অনুযায়ী আস্তে আস্তে বিভাগ খুলবে, শিক্ষক জোগাড় করবে, অবকাঠামো তৈরি করবে। ল্যাবরেটরি তৈরি করবে। সেভাবে এগিয়ে যাবে।”
প্রতি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে অধ্যাপক আলমগীর বলেন, “এখন থেকে যদি পরিকল্পনা না করে, তাহলে ওই বিভাগে বা জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করতে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে।
“বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষা দেয় না, একটি জনপদ গড়ে তোলে। মানুষ যে রাজধানী বা বড় বড় শহরমুখী হয়, সেই প্রবণতাটাও বিশ্ববিদ্যালয় রোধ করে। বরং শহর থেকে আরও লোক ওই ছোট শহরে যাবে। অনেকগুলো বিষয় মাথায় রেখেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা।”
এসব বিষয়ে প্রশ্ন করলে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। কেননা সংখ্যা না বাড়লে আবার মানও বাড়বে না। বাজেটের একটি চ্যালেঞ্জ আছে। বাজেট বাড়ানোর ব্যাপারেও আমরা কাজ করছি।”
নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিষয়ে তিনি বলেন, “সরকার অনেকগুলো নতুন কলেজ আত্মীকরণ করেছে, সরকারিকরণ করেছে। সেখানে স্নাতক পর্যায়ে পড়ানো শুরু হয়েছে। তাদের অ্যাকাডেমিক মনিটরিং করার জন্য প্রধানমন্ত্রী জেলার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে।
“নতুন বিশ্ববিদ্যালয় যদি সেগুলো দিয়ে শুরু করে আর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট লেভেলে স্থাপনাগুলোর দিকে যায়, সেক্ষেত্রে ভর্তির সমস্যা থাকে না। কারণ প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির সাথে সাথেই তো শিক্ষার্থী আসবে না। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট লেভেলে স্থাপনাগুলোতে গেলে সমস্যা নিরসন হবে।”