ইসির পালাবদলের পথরেখা

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের তোড়জোড়ের মধ‌্যে নানা নাম যেমন বাতাসে ঘুরছে, তেমনি বিভিন্ন আলোচনায় ফিরে ফিরে আসছে পুরনোদের কথাও।      

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Feb 2017, 02:56 AM
Updated : 2 Feb 2017, 02:56 AM

স্বাধীনতার পর সাড়ে চার দশকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত‌্যাশায় নানা চড়াই-উতরাই পার করেছে বাংলাদেশ।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বে এ পর্যন্ত ১১ জনকে দেখেছে এ দেশের মানুষ, যাদের মধ‌্যে সাতজন ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক বা সাবেক বিচারক; চারজন ছিলেন সাবেক আমলা। আর তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ছিলেন ২৩ জন।

অতীতে বিচারপতির নেতৃত্বে বিভিন্ন কমিশনে আমলারা থাকলেও আমলা নেতৃত্বাধীন কোনো কমিশনে বিচারপতিরা ছিলেন না।

বিচারাঙ্গণ থেকে এসে সিইসির ভূমিকা পালন করার পর আইনমন্ত্রী ও উপ রাষ্ট্রপতি হওয়ার নজির যেমন রয়েছে, তেমনি জটিল পরিস্থিতির মধ‌্যে মেয়াদ শেষ না করেই বিদায় নিতে হয়েছে কাউকে কাউকে।

সাবেক ১১ প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের মধ‌্যে ছয়জন স্বাধীনতা পরবর্তী দুই যুগ টানা দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে ছিলেন বিচারপতিরা। এরপর ইসিতে শুরু হয় সাবেক আমলাদের নেতৃত্ব।

মাঝখানে ২০০৫ সালে এক বছর সাত মাস একজন বিচারপতি ছাড়া গত প্রায় ২০ বছর সাবেক আমলারাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

সিইসির দায়িত্বে বিচারপতিদের মধ‌্যে মো. ইদ্রিস ও এটিএম মসউদ এবং সাবেক আমলাদের মধ‌্যে এমএ সাঈদ ও এটিএম শামসুল হুদা পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছেন। বর্তমান সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদও এ তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন।

সামরিক শাসনমালে বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম সিইসি হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন সাড়ে সাত বছর। আবার তিনি সাংবিধানিকভাবে স্বাভাবিক মেয়াদ শেষের আগেই আইন মন্ত্রী হয়েছিলেন, পরে ছিলেন উপ রাষ্ট্রপতি।

এইচএম এরশাদের সময়ে বিচারপতি মসউদের অধীনে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচন হয়।

দেশের সপ্তম সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজ ২০০৫ সালের ২৩ মে থেকে ২০০৭ সালের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন। আন্দোলনের মধ‌্যে মেয়াদ শেষের আগেই তার কমিশনকে বিদায় নিতে হয়েছিল।

আবার মোহাম্মদ আবু হেনা সমালোচিত হন ১৯৯৯ সালে টাঙ্গাইল উপ নির্বাচনের কারণে।

বছর খানেকের জন‌্য সিইসির দায়িত্ব পালন করেন আরেক বিচারপতি এ কে এম সাদেক। তার সময়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোট হয়।

বিচারপতি আব্দুর রউফের সময় হয় পঞ্চম সংসদ নির্বাচন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সময়ে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরার ওই নির্বাচনে বিচারপতি রউফ যেমন প্রশংসা পেয়েছিলেন, তেমনি ১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ উপ নির্বাচনের কারণে তাকে হতে হয়েছিল সমালোচিত।

জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সাড়ে সাত বছর সিইসি ছিলেন বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম। আর বিচারপতি সুলতান হোসেন খান এ দায়িত্বে ছিলেন মাত্র ১০ মাস। ওই সময় এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।

সংবিধানে যা আছে

ইসি গঠন: সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চার জন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনেো আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেবেন।

মেয়াদ ও পদত‌্যাগ: সংবিধান অনুযায়ী এ কমিশনের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। কোনো নির্বাচন কমিশনার রাষ্ট্রপতিকে পত্র দিয়ে পদত্যাগ করতে পারবেন।

ইসির দায়িত্ব: সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার-তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত থাকবে। নির্ধারিত দায়িত্বগুলোর অতিরিক্ত যেরূপ দায়িত্ব এই সংবিধান বা অন্য কোন আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে, নির্বাচন কমিশন সেইরূপ দায়িত্ব পালন করবেন।

বিচারপতি মো. ইদ্রিস

প্রথম সিইসি, ৭ জুলাই ১৯৭২ থেকে ৭ জুলাই ১৯৭৭

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেন বিচারপতি মো. ইদ্রিস। সে সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।

১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতার পর প্রথম সংসদ নির্বাচন বিচারপতি ইদ্রিসের হাতেই হয়। ওই নির্বাচনে ২৯৩ আসন জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। জাসদ ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগ একটি করে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পাঁচটি আসন পায়।

দুই সদস‌্যের ওই কমিশনে সিইসি ইদ্রিসের সঙ্গী ছিলেন নূর মোহাম্মদ খান।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংবিধান সংশোধনের মাধ‌্যমে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির অধীনে একদলীয় শাসন ব‌্যবস্থা চালু হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সামরিক অভ‌্যুত্থানের মাধ‌্যমে তা রহিত হয়।

বিচারপতি একেএম নুরুল ইসলাম

বিচারপতি একেএম নুরুল ইসলাম

দ্বিতীয় সিইসি, ৮ জুলাই ১৯৭৭ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫

বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম ১৯৭৭ সালে যখন সিইসির দায়িত্ব পান, তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।

নুরুল ইসলাম সিইসির দায়িত্বে ছিলেন সাত বছর। সে সময় সামরিক শাসন থাকায় তার সাংবিধানিক মেয়াদ শুরু হয় আরও পরে।   

ওই মেয়াদের পাঁচ বছর পূর্ণ না করেই একেএম নুরুল ইসলাম প্রথমে এরশাদ সরকারের আইনমন্ত্রী ও পরে উপ রাষ্ট্রপতি হন।

১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন হয় সিইসি নুরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে। সেই নির্বাচনে বিএনপি ২০৭ আসন পায়। আবদুল মালেক উকিলের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৩৯ আসন পেয়ে ছিল বিরোধী দলে। আর মিজান চৌধুরীর আওয়ামী লীগও ‍দুটি আসন পায়।

দুই সদস‌্যের ওই কমিশনে নুরুল ইসলামের সঙ্গী ছিলেন আব্দুল মুমিত চৌধুরী।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জিয়াউর রহমান নিহত হন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার ১৫ নভেম্বর ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। সে নির্বাচনও হয় নুরুল ইসলাম কমিশনের আয়োজনে।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ আবার সামরিক আইন জারি হয়। রাষ্ট্রপতি সাত্তার সরে যেতে বাধ‌্য হন, ক্ষমতায় আসেন সামরিক আইন প্রশাসক সেনাপ্রধান লে জে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তিনি ঘোষণা দেন, ১৯৮৪ সালের ২৫ নভেম্বর জাতীয় নির্বাচন হবে।

কিন্তু প্রধান দলগুলোর বর্জনের কারণে সেই নির্বাচন আর করতে হয়নি নুরুল ইসলামের ইসিকে।

বিচারপতি চৌধুরী এটিএম মসউদ

বিচারপতি চৌধুরী এটিএম মসউদ

তৃতীয় সিইসি, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০

রাষ্ট্রপতি এরশাদের সময়ে সিইসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া বিচারপতি চৌধুরী এটিএম মসউদের অধীনেই ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়।

শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আট দলীয় জোট ওই নির্বাচনে গেলেও খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোট বর্জন করে। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩ ও আওয়ামী লীগ ৭৬ আসন পায়। কিন্তু দেড় বছরের মাথায় রাষ্ট্রপতি এরশাদ ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সংসদ ভেঙে দেন।

১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ হয় চতুর্থ সংসদ নির্বাচন। হাসিনা-খালেদা নেতৃত্বাধীন প্রধান দুই জোট ওই ভোট বর্জন করে। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫১টি এবং সম্মিলিত বিরোধী জোট (কপ) ১৯টি আসন পায়।

বিচারপতি মসউদ ইসির দায়িত্বে প্রথমে বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকে সঙ্গী হিসেবে পেলেও চতুর্থ সংসদ নির্বাচন তাকে একাই করতে হয়।

বিচারপতি সুলতান হোসেন খান

চতুর্থ সিইসি, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯০

আগের ইসির কমিশনার বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকেই ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিইসি নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি এরশাদ।

কিন্তু ততদিনে ভোটের বদলে রাজনীতির মাঠে আলোচনার প্রধান বিষয় এরশাদবিরোধী আন্দোলন।

টানা হরতাল-বিক্ষোভের মধ‌্যে ১৯৯০ সালের ১৪ অক্টোবর ঢাকাসহ দেশের অনেক এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ২৭ নভেম্বর সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।

৩ ডিসেম্বর এরশাদ পদত‌্যাগের জন‌্য এই শর্ত দেন যে, একই তারিখে একইভাবে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন করতে হবে। মনোনয়ন দাখিলের ১৫ দিন আগে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়বেন।

কিন্তু প্রধান জোটগুলো এরশাদের প্রস্তাব প্রত‌্যাখ‌্যান করে এবং তাদের আন্দোলন গণ অভ‌্যুত্থানের রূপ নেয়। ৪ ডিসেম্বর সরে যাওয়ার ঘোষণা দিতে বাধ‌্য হন এরশাদ।

পরদিন প্রধান দলগুলোর মধ‌্যে রাজনৈতিক মতৈক‌্য হয়- প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ হবেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন এবং নির্বাচন দেবেন।

সে অনুযায়ী, এরশাদ ৬ ডিসেম্বর সাহাবুদ্দীনকে নতুন উপ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ পড়িয়ে নিজে পদত‌্যাগ করেন। উপ রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ হন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব নিয়ে ইসি পুনর্গঠন করেন।

দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ওই নির্বাচন আয়োজনের জন‌্য সাহাবুদ্দীন এরপর বিচারপতি নঈম উদ্দিন আহমেদ ও বিচারপতি আমিনুর রহমান খানকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেন।

১০ মাসে কোনো জাতীয় নির্বাচন না করেই ২৪ ডিসেম্বর সরে যেতে বাধ‌্য হন এরশাদের নিয়োগ পাওয়া সিইসি বিচারপতি সুলতান হোসেন খান।

২০০৮ সালে সিইসি আব্দুর রউফ, পাশে সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান

বিচারপতি মো. আব্দুর রউফ

পঞ্চম সিইসি, ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯০ থেকে ১৮ এপ্রিল ১৯৯৫

পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের আগে সেই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ই প্রথমবারের মত তিন সদস‌্যের ইসি পায় বাংলাদেশ।

বিচারপতি সুলতান হোসেন খান সরে যাওয়ার পরদিন সিইসি হিসেবে যোগ দেন বিচারপতি মো. আব্দুর রউফ।

নির্বাচন কমিশনার আমিনুর রহমান খান কয়েক দিনের মাথায় পদত্যাগ করলে তার জায়গায় আসেন বিচারপতি সৈয়দ মিছবাহ উদ্দিন হোসেন। তার সঙ্গী হন আগের কমিশনার বিচারপতি নঈম উদ্দিন আহমেদ।

ওই কমিশনের অধীনে পঞ্চম সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। সেই নির্বাচনে বিএনপি ১৪০ এবং আওয়ামী লীগ ৮৮ আসন পায়।

অন্তর্বর্তী সরকারের ওই সময়ে রউফ কমিশন নির্বাচনী আইনে ব্যাপক সংস্কার আনে, জারি করা হয় নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ।

বহু কাঙ্ক্ষিত সেই নির্বাচন করে প্রশংসিত হলেও ১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে মাগুরা উপ নির্বাচন নিয়ে বিতর্কিত হন সিইসি রউফ।

মেয়াদ শেষ হওয়ার আট মাস আগেই সিইসির পদ ছেড়ে বিচারপতি মো. আব্দুর রউফ ফিরে যান আবার আদালতে।

বিচারপতি একেএম সাদেক

বিচারপতি একেএম সাদেক

ষষ্ঠ সিইসি, ২৭ এপ্রিল ১৯৯৫ থেকে ৬ এপ্রিল ১৯৯৬

বিএনপির সেই সরকারের শেষ সময়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে ছিলেন আব্দুর রহমান বিশ্বাস। ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে তিনি সিইসি হিসেবে নিয়োগ দেন বিচারপতি একেএম সাদেককে।

বছর খানেকের জন্য দায়িত্ব পালন করা বিচারপতি সাদেক সঙ্গী পান আরেক বিচারপতি মো. আব্দুল জলিলকে। তাদের অধীনেই ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বহু বিতর্কিত ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো ওই ভোট বর্জন করে। বিএনপি পায় ২৭৮ আসন; নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আবারও সরকার গঠন করে তারা।

স্বল্পমেয়াদী ওই সরকারের সময়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়ার জন্য সংসদের একটি মাত্র অধিবেশন বসে।

১৯৯৬ এর ২৪ মার্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল সংসদে ওঠে; ২৫ মার্চ রাতভর অধিবেশন চলার পর ২৬ মার্চ ভোরে সংবিধানে যোগ হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।

একজন প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ১০ উপদেষ্টার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওই ব‌্যবস্থাতেই ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে ভোট হয়।

সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়কের পথ তৈরির পর ৩০ মার্চ সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়।

৬ এপ্রিল সময় নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে সরে যেতে হয় বিচারপতি সাদেকের কমিশনকে।

স্বল্প সময় দায়িত্ব পালন করা সাদেকের ইসিই দেশে প্রথমবারের মত নির্বাচনী আচরণ বিধি চালু করে দিয়ে যায়। 

মোহাম্মদ আবু হেনা

মোহাম্মদ আবু হেনা

সপ্তম সিইসি, ৯ এপ্রিল ১৯৯৬ থেকে ৮ মে ২০০০

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই সময়ে ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে সিইসি হিসেবে বেছে নেওয়া হয় সাবেক আমলা মোহাম্মদ আবু হেনাকে। তার সঙ্গী হন আবিদুর রহমান ও মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী।

এই কমিশনের অধীনেই ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম সংসদ নির্বাচন হয়। তাতে আওয়ামী লীগ ১৪৬, বিএনপি ১১৬ আসন পায়।

২০০০ সালে এ কমিশনে সঙ্গে যুক্ত হন তৃতীয় নির্বাচন কমিশনার শফিউর রহমান। প্রথমবারের মত ইসি চার সদস‌্য পায়।

বিচারপতি হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ভোট আয়োজন করে প্রশংসা পেলেও আবু হেনার কমিশন দলীয় সরকারের অধীনে ১৯৯৯ সালে টাঙ্গাইল (সখিপুর-বাসাইল) উপ নির্বাচনে ব‌্যাপক কারচুপির জন‌্য সমালোচিত হয়। 

এরপর মেয়াদ পূর্তির এক বছর আগে সেই উপ নির্বাচনের ফলাফলের গেজেট না করেই সরে যান সিইসি আবু হেনা।

এম এ সাইদ

এম এ সাইদ

অষ্টম সিইসি, ২৩ মে ২০০০ থেকে ২২ মে ২০০৫

রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের মেয়াদপূর্তির পর তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার ওই দায়িত্বে আনে একানব্বইয়ের নির্বচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে থাকা সাহাবুদ্দীন আহমেদকে।

আবু হেনা সরে যাওয়ার পর রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন ২০০০ সালের মে মাসে নতুন সিইসি হিসেবে সাবেক আমলা এম এ সাঈদকে নিয়োগ দেন।

বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সাঈদ কমিশনের অধীনেই ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচন হয়। তাতে বিএনপি ১৯৩ এবং আওয়ামী লীগ ৬২ আসন পায়।

ওই কমিশনে এম এ সাঈদের সঙ্গী ছিলেন এম এম মুনসেফ আলী ও এ কে এম মোহাম্মদ আলী। দুই সরকারের সময়ে চাপের মধ‌্যে থাকতে হলেও পুরো মেয়াদ দায়িত্ব পালন করেই এ কমিশন বিদায় নেয়।

বিএনপির ওই সরকারের সময়ই প্রথমবারের মতো ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা স ম জাকারিয়াকে ইসি সচিব নিয়োগ করা হয়।

বিচারপতি এমএ আজিজ (মাঝে)

বিচারপতি এমএ আজিজ

নবম সিইসি, ২৩ মে ২০০৫ থেকে ২১ জানুয়ারি ২০০৭

রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মেয়াদপূর্তির পর বিএনপি সরকারের সময় রাষ্ট্রপ্রধানের পদে আসেন বদরুদ্দোজা চৌধুরী। সরকারের সঙ্গে টানাপড়েনে জড়িয়ে সাত মাসের মাথায় তাকে রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়তে হয়। ওই পদে আসেন অধ‌্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ।

তিনিই ২০০৫ সালে সিইসি হিসেবে বিচারপতি এম এ আজিজকে নিয়োগ দেন। কিন্তু আগের দুই নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে কাজ গুছাতে বিরোধে জড়ান তিনি।

২০০৬ সালের জানুয়ারিতে আজিজের কমিশনে যোগ হন স ম জাকারিয়া ও বিচারপতি মাহফুজুর রহমান। আগের কমিশনার এম এম মুনসেফ আলী ও এ কে এম মোহাম্মদ আলী তখনও দায়িত্বে। প্রথমবারের মত কমিশনের আকার হয় পাঁচ সদস‌্যের।

মুনসেফ ও মোহাম্মদ আলীর বিদায়ের পর ওই বছর সেপ্টেম্বরে মুহাম্মদ হাসান মনসুর এবং নভেম্বরে মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী ও সাইফুল আলম কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান। ইসি হয় ছয় সদস‌্যের।  

ওই কমিশনের সময় তিন শতাধিক নির্বাচন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয় ইসি, যা নিয়ে আওয়ামী লীগ সমালোচনায় মুখর হয়।

২০০৬ সালের শেষ দিকে নবম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করে। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নিজে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিলে সঙ্কট নতুন মাত্রা পায়।  

সেই সঙ্কটের সময়ই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আবারও মোড়বদল ঘটে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি। সেনা হস্তক্ষেপে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তত্ত্বাধায়কের দায়িত্ব ছাড়েন। প্রধান উপদেষ্টা হন ফখরুদ্দীন আহমদ।

নবম সংসদ নির্বাচনের জন‌্য ঘোষিত তফসিল বাতিল হয়ে গেলে ২১ জানুয়ারি সিইসি আজিজ এবং ৩১ জানুয়ারি বাকি পাঁচ কমিশনার পদত্যাগ করেন।

এটিএম শামসুল হুদা

এটিএম শামসুল হুদা

দশম সিইসি, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২

ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সাবেক আমলা এটিএম শামসুল হুদাকে সিইসির দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিশনার হিসেবে তার সঙ্গী হন মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও এম সাখাওয়াত হোসেন।

ভোটের আগে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন হয় ওই কমিশনের সময়েই। সংলাপ করে নির্বাচনী আইন সংস্কার করা হয়। চালু হয় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের নিয়ম ও ইভিএম।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচন করে শামসুল হুদার কমিশন। ৮৭ শতাংশের বেশি ভোটারের উপস্থিতিতে সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০, বিএনপি ৩০ ও জাতীয় পার্টি ২৭ আসন পায়।

বিএনপি বরাবরই ওই ইসির সমালোচনায় মুখর ছিল। ‘মাইনাস টু’ তত্ত্বের আলোচনার মধ‌্যে খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপির সংস্থারপন্থি হিসেবে পরিচিত অংশকে সংলাপে ডাকায় এ কমিশনের বিতর্কও হয়েছিল সে সময়।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিলোপ ঘটে। সংবিধানে যোগ হয় ৫ সদস্যের ইসির গঠনের নিয়ম।

কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ

কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ

একাদশ সিইসি, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ থেকে

সংবিধানে বলা থাকলেও ইসি গঠনের আইন প্রণিত না হওয়ায় শামসুল হুদার কমিশনের বিদায়ের সময় ইসি পুনর্গঠনের জন‌্য নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করেন তখনকার রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান।

২০১২ সালের ওই সার্চ কমিটি ইসি নিয়োগের ইতিহাসে নতুন মাত্রা আনে। তাদের বাছাই করা ব‌্যক্তিদের মধ‌্যে থেকে সাবেক আমলা কাজী রকিবউদ্দীন আহমদকে করা হয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার। আর নির্বাচন কমিশনার হন মোহাম্মদ আবদুল মোবারক, আবু হাফিজ, জাবেদ আলী ও মো. শাহনেওয়াজ।

তত্ত্বাবধায়ক ব‌্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হয় দলীয় সরকারের অধীনে। কাজী রকিবের কমিশনের আয়োজনে ওই নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।

এই পরিস্থিতিতে ভোটের আগেই ১৫৩ আসনে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। সারা দেশে ব‌্যাপক সহিংসতার মধ‌্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩৪টি এবং জাতীয় পার্টি ৩৪টি আসন পায়।

আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর কাজী রকিবের কমিশনের অধীনে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ব‌্যাপক অনিয়ম ও সহিংসতা ঘটে। এসব কারণেও সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হতে হয়েছে পূর্ণ মেয়াদ দায়িত্ব পালনের পথে থাকা এ কমিশনকে।

কারা আসছে দ্বাদশ ইসিতে?

একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাষ্ট্রপতি মো. আবুল হামিদ গতবারের মতই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছেন। গঠন করেছেন সার্চ কমিটি।

ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নতুন যে ইসি নিয়োগ পাবে, তাদের যাত্রা শুরু হবে নির্বাচন কমিশনের নতুন কার্যালয় ‘নির্বাচন ভবন’ থেকে।