নতুন ইসির অভিষেকের অপেক্ষা

রাজনীতির অঙ্গনে আস্থা-অনাস্থার আলোচনার মধ‌্যে আগামী পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব নিচ্ছেন কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন, যাদের তত্ত্বাবধানে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন হবে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Feb 2017, 06:06 AM
Updated : 15 Feb 2017, 06:06 AM

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়া প্রথম কোনো সাবেক আমলার নেতৃত্বে এবার ইসি গঠন করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম ইসি পেয়েছে একজন নারী কমিশনার।

কে এম নূরুল হুদা হচ্ছেন দেশের দ্বাদশ সিইসি, যিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে। তার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে থাকছের সাবেক সচিব রফিকুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ কবিতা খানম ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী।

নতুন চার নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে এ যাবতকালে মোট ২৭ জন কমিশনারকে পাবে নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্বে থাকা সাংবিধানিক সংস্থাটি।

সার্চ কমিটির দেওয়া ১০টি নামের সুপারিশ থেকে গত সপ্তাহে এই পাঁচজনকেই নতুন ইসির জন‌্য নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ওই রাতেই প্রজ্ঞাপন জারি করে।

বুধবার বিকাল ৩টায় সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে নতুন ইসির পাঁচ সদস্যকে আলাদাভাবে শপথ পড়াবেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।

শপথের আনুষ্ঠিকতা শেষে আগারগাঁওয়ে ‘নির্বাচন ভবনে’ সাংবিধানিক এ দায়িত্বে যোগ দেবেন কমিশনের সদস‌্যরা। কমিশনের উন্মুক্ত লনে বিকাল ৫টায় তাদের সংবাদ ব্রিফিংয়েও আসার কথা রয়েছে।

নতুন এই ভবনে যাত্রা শুরু করবে নতুন নির্বাচন কমিশন

কার কেমন প্রতিক্রিয়া

কে এম নূরুল হুদার নতুন কমিশনের প্রতি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তাদের জোট শরিকরা ‘আস্থা’ রাখলেও বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ‘হতাশা’ প্রকাশ করেছে। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি স্বাগত জানিয়েছে নতুন কমিশনকে। আর সিপিবি বলেছে, তারা নতুন কমিশনের কাজ দেখার অপেক্ষায় রয়েছে।

# আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের:

“মহামান্য রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী যে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন এতে আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে। এই কমিশনের অধীনে বিএনপি ভোটে আসবে বলে আমরা আশাবাদী।”

#বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর:

“আমরা মনে করি, একজন বিতর্কিত সাবেক সরকারি কর্মকর্তার নেতৃত্বে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে না।”

#জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার:

“নতুন সিইসি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। অতীতেও তিনি সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।”

#সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম:

“ব্যক্তিগত বিবেচনা ও পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে কোনো সংস্থা গঠিত হলে তার কাজকর্ম সম্পর্কে আগাম মূল্যায়ন করা দুষ্কর। ভবিষ্যতে কেমনভাবে তারা দায়িত্ব পালন করে, তা দেখেই সিপিবি তার মূল্যায়ন জানাবে।”

অতীতের ১১

 

সিইসি

মেয়াদ

কমিশনার যারা ছিলেন

যা ঘটেছিল

প্রথম

বিচারপতি মো. ইদ্রিস

 

৭ জুলাই ১৯৭২ থেকে ৭ জুলাই ১৯৭৭

 

নূর মোহাম্মদ খান

 

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম সংসদ নির্বাচন

দ্বিতীয়

বিচারপতি একেএম নুরুল ইসলাম

৮ জুলাই ১৯৭৭ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫

আব্দুল মুমিত চৌধুরী

 

১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন

তৃতীয়

বিচারপতি চৌধুরী এটিএম মসউদ

 

১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০

বিচারপতি সুলতান হোসেন খান (আংশিক)

১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ সংসদ নির্বাচন

চতুর্থ

বিচারপতি সুলতান হোসেন খান

১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯০

বিচারপতি নঈম উদ্দিন আহমেদ ও বিচারপতি আমিনুর রহমান খান

১০ মাসে কোনো জাতীয় নির্বাচন না করেই সরে যেতে বাধ‌্য হন এরশাদের নিয়োগ পাওয়া সিইসি সুলতান হোসেন খান

পঞ্চম 

বিচারপতি মো. আব্দুর রউফ

২৫ ডিসেম্বর ১৯৯০ থেকে ১৮ এপ্রিল ১৯৯৫

বিচারপতি নঈম উদ্দিন আহমেদ, আমিনুর রহমান খান (আংশিক) ও বিচারপতি সৈয়দ মিছবাহ উদ্দিন হোসেন (আংশিক)

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংসদ নির্বাচন হয়। বিএনপির শাসনামলে ১৯৯৪ সালে মাগুরায় বিতর্কিত উপ নির্বাচন

ষষ্ঠ

 

বিচারপতি একেএম সাদেক

২৭ এপ্রিল ১৯৯৫ থেকে ৬ এপ্রিল ১৯৯৬

বিচারপতি মো. আব্দুল জলিল

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বহু বিতর্কিত ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন

সপ্তম

 

 

মোহাম্মদ আবু হেনা

৯ এপ্রিল ১৯৯৬ থেকে ৮ মে ২০০০

আবিদুর রহমান, মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী, শফিউর রহমান

১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম সংসদ নির্বাচন। ১৯৯৯ সালে টাঙ্গাইলের বিতর্কিত উপ নির্বাচন

অষ্টম

 

 

এম এ সাইদ

২৩ মে ২০০০ থেকে ২২ মে ২০০৫

 

এম এম মুনসেফ আলী ও এ কে এম মোহাম্মদ আলী

২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচন

নবম

বিচারপতি এমএ আজিজ

২৩ মে ২০০৫ থেকে ২১ জানুয়ারি ২০০৭

 

এম এম মুনসেফ আলী (আংশিক), এ কে এম মোহাম্মদ আলী (আংশিক), স ম জাকারিয়া (আংশিক), বিচারপতি মাহফুজুর রহমান (আংশিক), মুহাম্মদ হাসান মনসুর (আংশিক), মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী (আংশিক), সাইফুল আলম (আংশিক)

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি আসে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তফসিল বাতিল হয়ে গেলে নবম সংসদ নির্বাচন না করেই বিদায় নেয় আজিজ কমিশন

দশম 

 

 

এটিএম শামসুল হুদা

৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২

মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও এম সাখাওয়াত হোসেন।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচন

একাদশ

 

 

কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ

৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মোহাম্মদ আবদুল মোবারক, আবু হাফিজ, জাবেদ আলী ও মো. শাহনেওয়াজ

 

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন

কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের ইসি

 

বদলের ইতিহাস

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বে এ পর্যন্ত ১১ জনকে দেখেছে এ দেশের মানুষ, যাদের মধ‌্যে সাতজন ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক বা সাবেক বিচারক; চারজন ছিলেন সাবেক আমলা। আর তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ছিলেন ২৩ জন।

অতীতে বিচারপতির নেতৃত্বে বিভিন্ন কমিশনে আমলারা থাকলেও আমলা নেতৃত্বাধীন কোনো কমিশনে বিচারপতিরা ছিলেন না।

বিচারাঙ্গণ থেকে এসে সিইসির ভূমিকা পালন করার পর আইনমন্ত্রী ও উপ রাষ্ট্রপতি হওয়ার নজির যেমন রয়েছে, তেমনি জটিল পরিস্থিতির মধ‌্যে মেয়াদ শেষ না করেই বিদায় নিতে হয়েছে কাউকে কাউকে।

সাবেক ১১ প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের মধ‌্যে ছয়জন স্বাধীনতা পরবর্তী দুই যুগ টানা দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে ছিলেন বিচারপতিরা। এরপর ইসিতে শুরু হয় সাবেক আমলাদের নেতৃত্ব।

মাঝখানে ২০০৫ সালে এক বছর সাত মাস একজন বিচারপতি ছাড়া গত প্রায় ২০ বছর সাবেক আমলারাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

সিইসির দায়িত্বে বিচারপতিদের মধ‌্যে মো. ইদ্রিস ও এটিএম মসউদ এবং সাবেক আমলাদের মধ‌্যে এমএ সাঈদ, এটিএম শামসুল হুদা ও সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছেন।

সামরিক শাসনমালে বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম সিইসি হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন সাড়ে সাত বছর। আবার তিনি সাংবিধানিকভাবে স্বাভাবিক মেয়াদ শেষের আগেই আইন মন্ত্রী হয়েছিলেন, পরে হয়েছিলেন উপ রাষ্ট্রপতি।

এইচএম এরশাদের সময়ে বিচারপতি মসউদের অধীনে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচন হয়।

দেশের সপ্তম সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজ ২০০৫ সালের ২৩ মে থেকে ২০০৭ সালের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন। আন্দোলনের মধ‌্যে মেয়াদ শেষের আগেই তার কমিশনকে বিদায় নিতে হয়েছিল।

আবার মোহাম্মদ আবু হেনা সমালোচিত হন ১৯৯৯ সালে টাঙ্গাইল উপ নির্বাচনের কারণে।

বছর খানেকের জন‌্য সিইসির দায়িত্ব পালন করেন আরেক বিচারপতি এ কে এম সাদেক। তার সময়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোট হয়।

বিচারপতি আব্দুর রউফের সময় হয় পঞ্চম সংসদ নির্বাচন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সময়ে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরার ওই নির্বাচনে বিচারপতি রউফ যেমন প্রশংসা পেয়েছিলেন, তেমনি ১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ উপ নির্বাচনের কারণে তাকে হতে হয়েছিল সমালোচিত।