বাংলাদেশে সরকার, সংসদ, বিচারালয়সহ নানা ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের ধারাবাহিকতায় এবার নির্বাচন কমিশনেও চার দশকের পুরনো অদৃশ্য কাচের দেয়ালটি ভাঙবে বলে প্রত্যাশা এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
Published : 30 Oct 2016, 10:41 AM
নতুন ইসি গঠনে ফের ‘সার্চ কমিটি’
এক-তৃতীয়াংশ নারী নেই কোনো দলের কমিটিতে
ইসি নিয়োগে আইন না থাকাই সমস্যা: টিআইবি
সবিশেষকমিশনার নিয়োগে আইন চাইবে ইসি
নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত এ সাংবিধানিক সংস্থাটিতে এ পর্যন্ত ১১ জন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এসেছেন, তাদের সঙ্গী হয়েছেন ২৩ জন নির্বাচন কমিশনার। তাদের মধ্যে কোনো নারীকে বাংলাদেশ পায়নি।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বর্তমান কমিশনের মেয়াদপূর্তির পর নতুন যে কমিশন দায়িত্ব নেবে, সেখানে অন্তত একজন নারী থাকা উচিৎ বলে মত দিয়েছেন দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাও।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও বিএনপি নেতারা বলছেন, নারী ক্ষমতায়নের চলমান প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনেও নারী সদস্য নিয়োগ দেওয়া উচিৎ। তবে সবার আগে ‘যোগ্য লোকদের নিয়ে নিরপেক্ষ’ কমিশন গঠনের ওপর জোর দিচ্ছেন তারা।
পুনর্গঠিত এই কমিশনের অধীনেই ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারির মধ্যে হবে একাদশ সংসদ নির্বাচন।
রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটিতে এক তৃতীয়াংশ নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তির বাধ্যবাধকতা রাখার পর নির্বাচন কমিশনেও একজন নারী কমিশনার রাখার প্রস্তাব করেছিল ২০০৭-২০১২ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা এ টি এম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসি। সেই লক্ষ্যে আইন করতে একটি খসড়াও তারা বিদায়ের আগে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শামসুল হুদা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিয়োগ পদ্ধতি, আইন-বিধি তো গত ৪৫ বছরে হল না। তবু আমরা যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করে এ সংক্রান্ত একটা খসড়া রেখেছিলাম, যাতে একজন নারী নির্বাচন কমিশনার রেখে ইসি নিয়োগ করা যায়।
“এখন সর্বোচ্চ পাঁচ সদস্যের কমিশন হয়। এর মধ্যে অন্তত একজন নারী কমিশনার তো থাকা উচিত,” বলেন তিনি।
নির্বাচন কমিশনে সদস্য সংখ্যা কত হবে তা আগে নির্ধারিত ছিল না। ২০০৬ সালের শেষ সময়ে বহুল আলোচিত এম এ আজিজ কমিশন ছিল সর্বোচ্চ ছয় সদস্যের।
নির্বাচন কমিশনকে ‘শক্তিশালী করতে’ ২০১১ সালের ২৯ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও ‘অনধিক’ চার নির্বাচন কমিশনার নিয়ে সর্বোচ্চ পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠনের বিধান করা হয়। কিন্তু অন্তত একজন নারী কমিশনার রাখার বিধি করার প্রস্তাব সেখানে উপেক্ষিতই থাকে।
২০১২ সালে নতুন ইসি গঠনের আগে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেন, গঠন করা হয় সার্চ কমিটি।
সে সময় সার্চ কমিটির আহ্বানে আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল নতুন কমিশনের জন্য তাদের পছন্দের ব্যক্তির নামের তালিকা দিলেও বিএনপি দেয়নি।
কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে যে সুপারিশ জমা দেয়, তাতে সিইসি ও চার কমিশনার নিয়ে পাঁচটি পদের জন্য ১০টি নাম আসে। তার মধ্যে থেকেই পাঁচজনকে বেছে নেন রাষ্ট্রপতি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সিইসি ও চার নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করলে পরদিন প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নিয়ে তারা যোগ দেন ইসিতে।
সাবেক সিইসি এটিএম শামসুল হুদা জানান, বর্তমান ইসি গঠনের সময়ও নির্বাচন কমিশনার হিসেবে একজন নারীর নাম এসেছিল।
“শেষ পর্যন্ত কেন নিয়োগ হল না তা বলতে পারব না। আশা করি, আগামীতে যোগ্য একজন আসবে।”
এবারও সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি নিয়োগের আভাস দিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ইতোমধ্যে বলেছেন, ২০১২ সালে যেভাবে বর্তমান ইসি গঠন করা হয়েছিল, এবারও সেভাবেই হবে।”
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইসি নিয়োগ একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে হতে হবে। সার্চ কমিটির মাধ্যমেও হতে পারে। সেক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়ায় যোগ্য কোনো নারী নিয়োগ পেলে তো ভালো। আমরা রাজনৈতিক দলের কমিটিতেও নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়াচ্ছি।”
ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা বলেন, ইতোমধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে নারী বিচারক এসেছেন; অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নারীরা পালন করছেন। তবে সংবিধানে নারী নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
“একটি শক্তিশালী ইসি গঠন করাই মুখ্য। গঠন প্রক্রিয়ায় যোগ্যদের নিয়ে তা করতে হবে এবং এর মধ্যে যোগ্যতার ভিত্তিতে অন্তত একজন নারী থাকলে ভালো হয়।”
বিএনপিও চায়, তবে...
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ইসি পুনর্গঠন নিয়ে শিগগিরই তাদের চেয়ারপারসন দলীয় অবস্থান তুলে ধরবেন।
“তবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন হতে হবে। এদের মধ্যে অন্তত একজন নারী নির্বাচন কমিশনার থাকা উচিত।”
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সমালোচনায় ফখরুল বলেন, “এদের অধীনে কেমন নির্বাচন হয়েছে তা জনগণ দেখেছে। আগামী ইসি নিয়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে দলীয় ফোরামে আলোচনা করা হবে। তারপরই এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব তুলে ধরা হবে।”
জাপার দাবি ‘প্রভাবমুক্ত’ ইসি
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, নির্বাচন কমিশনে কারা নিয়োগ পেল- তার চেয়ে বড় বিষয় তারা ‘প্রভাবমুক্তভাবে নির্বাচন’ করতে পারবে কিনা।
“বর্তমান সরকারের আমলে ইসির নির্বাচন আয়োজন, তাদের দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন রয়েছে। আগামীতে আরেকটি ইসি আসবে; তাদের নিরপেক্ষভাবে এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবের বাইরে থেকে নির্বাচন করতে পারাটাই আসল।”
সিপিবি চায় ‘নিরপেক্ষ’ ইসি
আগামী নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ লোকদের দিয়ে গঠন করাই ‘আসল’ বলে মনে করছেন সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
তিনি বলেন, “নিরপেক্ষ ইসি প্রধান বিষয়। নারী সদস্য রাখার বিষয়টি মুখ্য নয়।”
শিরীন শারমিন চৌধুরীর স্পিকার হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে কর্তৃত্বের তিনটি পদই এখন নারীদের হাতে।
সংসদ নেতার দায়িত্বে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। সংসদ উপনেতাও একজন নারী, তিনি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।
আর সংসদের বাইরে থাকা বড় দল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনার টানা দুই দফার সরকারে গত সাত বছরে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন নারীরা। তাদের মধ্যে আছেন- মতিয়া চৌধুরী, দীপু মনি, সাহারা খাতুন, তারানা হালিম, মেহের আফরোজ চুমকী ও ইসমাত আরা সাদেক।
২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রথম নারী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান নাজমুন আরা সুলতানা। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব পদেও নারীরা রয়েছেন।