আরো কর্তৃত্ব চেয়ে ইসির প্রস্তাব

নির্বাচনকালীন চারটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ‘কর্তৃত্ব’ দেওয়াসহ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে ৩২টি সংশোধন আনতে সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে বিদায়ী নির্বাচন কমিশন। মঈনুল হক চৌধুরীর প্রতিবেদন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Feb 2012, 09:49 AM
Updated : 3 Feb 2012, 09:49 AM
মঈনুল হক চৌধুরী
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ০৩ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- নির্বাচনকালীন গুরুত্বপূর্ণ চার মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ‘কর্তৃত্ব’ নির্বাচন কমিশনকে দেওয়াসহ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে ৩২টি সংশোধন চেয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে বিদায়ী নির্বাচন কমিশন।
জাতীয় নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের আইনি সুযোগ রাখার প্রস্তাবও করা হয়েছে। এর সঙ্গে প্রস্তাবিত প্রধান নির্বাচন কশিনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন এবং ঢাকার সংসদীয় আসন ‘সীমাবদ্ধ’ রেখে সীমানা নির্ধারণ আইন ও বিধি প্রণয়নের প্রস্তাবও দিয়েছে বর্তমান ইসি।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব বৃহস্পতিবার ইসি অনুমোদন করেছে। বিদায়ী নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে উঠে আসা এসব প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে।
তবে রাজনৈতিক মতৈক্য না থাকায় নির্বাচনী প্রচারণা ব্যয় সংক্রান্ত ‘জনতহবিল আইন’র খসড়া পাঠানো হয়নি। আরো পর্যালোচনা করে আগামী ইসি তা বিবেচনা করতে পারবে বলে বর্তমান ইসি মনে করছে।
ইসির উপসচিব সুভাষ চন্দ্র সরকার জানান, নির্বাচনী আইন সংস্কারের এই প্রস্তাব ইসির অনুমোদন নিয়ে বর্তমান ইসির শেষ কার্যদিবসের বিকালে পাঠানো হয়েছে। তা সোমবার আইন মন্ত্রণালয়ে পৌঁছবে।
আলোচনা ছাড়া চার মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত নয়
নির্বাচন চলাকালে সরকারের চারটি মন্ত্রণালয় নির্বাচনকে যাতে প্রভাবিত করতে না পারে সেজন্য ৪৪-ই ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, সংসদ ভেঙে যাওয়ার দিন থেকে পরবর্তী সরকার গঠন পর্যন্ত সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে পরামর্শ না করে নির্বাচন সম্পর্কিত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।
বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা এই প্রস্তাবের বিষয়ে বৃহস্পতিবার বলেন, “[দলীয় সরকারের অধীনে] নির্বাচন সুষ্ঠু করা অসম্ভব নয়, সব কিছু কিছু সম্ভব। তবে এসব শর্ত না মানলে তা কঠিন হবে।”
পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীর সময় এই ধরনের একটি প্রস্তাব ইসির থাকলেও ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ বিলুপ্তির কারণে তা আমলে নেয়নি সংশ্লিষ্ট কমিটি। এবার নতুন করে সরকারের কাছে প্রস্তাব দিলো ইসি।
জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম
বর্তমান নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকারের সিটি কর্পোরেশনে ইভিএম ব্যবহার করায় ২০১০ সালেই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আগে স্থানীয় সরকার (সিটি) কর্পোরেশন বিধিমালায় ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে। এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আংশিক ও পুরোভাবে ইভিএম ব্যবহার হচ্ছে।
জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহারের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেয় ইসি। সংলাপে অধিকাংশ দলই জাতীয় নির্বাচনে পর্যায়ক্রমে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দেয়। তবে বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা কিছু দল বরাবরই বিরোধিতা করে আসছে।
নির্বাচন কমিশনার বলছেন, জাতীয় নির্বাচনে ব্যালট পেপার ও ইভিএম ব্যবহার দুটো ‘অপশনই’ থাকছে। এজন্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (২৬ ধারায়) সংশোধন আনতে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে কোনো কোনো সংসদীয় আসনে প্রচলিত ব্যালট পেপারে ভোটের পাশাপাশি অন্যত্র ইভিএমে ভোট নিতে বাধা থাকবে না।
“আগামীতে কতটুকু আসনে ইভিএম ব্যবহার হবে তা পরবর্তী ইসি সিদ্ধান্ত নেবে। এ জন্যে সব ধরনের প্রস্তুতি রেখে যাবো আমরা,” বলেছিলেন বিদায়ী কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন।
আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে করা উচিত বলে বিদায়ের শেষ দিনে মত দিয়েছেন শামসুল হুদাও।
বুধবার জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জানান, আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহারে ইসিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবে তার সরকার।
মিথ্যা তথ্য ও বিদ্রোহী প্রার্থী রোধ
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১-ই ধারা সংশোধনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার পর যদি প্রমাণিত হয়, তিনি হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন, সেক্ষেত্রে ওই সাংসদের সদস্যপদ বাতিল হবে।
বিদ্যমান আইনে বলা আছে, হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হবে। তবে নির্বাচিত হওয়ার পর এ অভিযোগ প্রমাণিত হলে কী হবে, সে সম্পর্কে আইনে কিছু বলা নেই।
নবম সংসদে কয়েকজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেওয়ার প্রমাণ পেয়ে ইসি কিছু করতে না পারার আইনি সীমাবদ্ধতা দূর করতে এই প্রস্তাব করা হয়েছে বলে ইসি কর্মকর্তারা জানান।
নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর দৌরাÍ্য কমাতে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাহারের আগেই দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করার বিধানের প্রস্তাব করেছে ইসি। এক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত অন্যদের দলীয় [সংশ্লিষ্ট] মনোনয়ন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
আরো কয়েকটি প্রস্তাব
ধারা ১৬ সংশোধনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে কোনো দল থেকে একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হলে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগে দল থেকে যে কোনো একজনকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দিতে হবে। এক্ষেত্রে দল থেকে প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন পাওয়া বাকি প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিল বলে গণ্য হবে।
গত নির্বাচনে এই বিধান না থাকায় অনেক আসনে রাজনৈতিক দলগুলোর বিদ্রোহী প্রার্থীকে স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়ানোর সুযোগ নিয়েছে।
১৩ ধারায় জামানতের টাকা ১০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা, ৪৪-বি ধারায় প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় ১৫ লাখ থেকে ২৫ লাখ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া নির্বাচন কমিশন সভার আয়োজন না করলে কোনো প্রার্থী তার আসনে একটির বেশি জনসভা করতে পারবেন না, নির্বাচন কমিশনের একাধিক পর্যবেক্ষক দল প্রার্থীর নির্বাচন ব্যয় পর্যবেক্ষণ; নির্বাচন চলাকালে প্রার্থীকে প্রত্যেক সপ্তাহের শেষে নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব কমিশনে জমা দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল শর্ত পালন না করলে নিবন্ধন বাতিল, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষপাতিত্বে তাৎক্ষণিক শাস্তি, প্রার্থীরা প্রভাব খাটালে জরিমানা ও শাস্তির বিধান, প্রার্থী হতে অযোগ্যতায় আরো শর্ত যোগসহ কিছু করণিক সংশোধনী নিয়ে ৩২টি সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে আরপিওতে।
ইসি গঠন ও সীমানা নির্ধারণ
সিইসি ও ইসি নিয়োগে সার্চ কমিটির মাধ্যমে সম্ভাব্যদের তালিকা তৈরি করা, কার্যউপদেষ্টায় তালিকা পাঠানো ও তাদের অযোগ্যতা নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ণের খসড়া প্রস্তাব দিয়েছে ইসি।
এছাড়া ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সংসদীয় আসন নির্ধারণ করে দিয়ে সীমানা নির্ধারণ আইন ও বিধি প্রণয়ণের প্রস্তাবও করেছে ইসি।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, সরকারের এসব আইন প্রণয়নে ‘সদিচ্ছা’ থাকলে আইন মন্ত্রণালয় তা মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য পাঠাবে। মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেলে সংসদে তা আইন প্রয়ণের জন্য পাঠানো হবে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এমএইচসি/এমআই/২১৪৫ ঘ.