ইসির নিয়োগে প্যানেল তৈরিতে সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য প্যানেল মনোনয়নে সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব রেখে একটি খসড়া অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করেছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন। সার্চ কমিটিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, সরকারি কর্ম-কমিশন চেয়ারম্যান ও মহা হিসাব নিরীক্ষকসহ বিদায়ী সিইসিকে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করে এতে এক জন নারীকে রাখার প্রস্তাবও করা হয়েছে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2008, 03:46 AM
Updated : 7 June 2008, 03:46 AM

যোগ্য, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের পথ সুগম করতে এ খসড়া অধ্যাদেশ প্রস্তাব করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন।

সংবিধানের সঙ্গে সমন্বয় রেখে 'দি ইলেকশন কমিশনারস (মেথড অফ রিক্রুটমেন্ট) অর্ডিনেন্স-২০০৮' নামে এ খসড়া তৈরি করা হয়েছে। চলতি মাসে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ সরকারের কাছে উপস্থাপন করবে ইসি।

ছহুল হোসাইন শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটটকমকে বলেন, "আগামীতে যোগ্য ও সঠিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন নিশ্চিত করতেই এ অধ্যাদেশ প্রস্তাব করা হচ্ছে। সরকারের কাছে ইসির সুপারিশ থাকলে সংবিধানের আলোকে আইন প্রণয়নে সুবিধা হবে।"

গত সপ্তাহে চূড়ান্ত হওয়া এ খসড়ার বিষয়ে চলতি জুন মাসের মাঝামাঝিতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ইসির সাক্ষাতের কথা রয়েছে বলে জানান তিনি।

সার্চ কমিটির বিষয়ে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনারের পদ শূন্য হওয়ার কমপক্ষে এক মাস আগে সিইসিকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের সার্চ কমিটি গঠিত হবে। কমিটির অন্য সদস্য হবেন- দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, সরকারি কর্ম-কমিশনের চেয়ারম্যান ও মহা হিসাব নিরীক্ষক (সিএজি)। এছাড়া আকস্মিকভাবে কেউ পদত্যাগ করলে বা সরানো হলে সঙ্গে সঙ্গে সার্চ কমিটি গঠন হবে। 'সিইসি'র পদ শূন্য থাকলে সার্চ কমিটির আহ্বায়ক হবেন কমিটির অন্য এক জন। যে কোনও শূন্য পদের জন্য তিন জনের 'প্যানেল' তৈরি করবে এ কমিটি। যা অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে।

নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক আইন সচিব ছহুল হোসাইন বলেন, "নির্বাচন কমিশনার হওয়ার জন্য কিছু যোগ্যতা থাকা উচিত। বিচারপতি নিয়োগে কিছু যোগ্যতা রয়েছে, অথচ সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে তা নেই। কিন্তু বিচারপতিদের অপসারণে যে প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশনারদের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া বিদ্যমান। এ জন্য আমরা ভাবছি, এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় 'সার্চ কমিটি' থাকলে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তিই নিয়োগ পাবেন।"

"অতীতে যে যোগ্য ব্যক্তি নিয়োগ পাননি, বিষয়টি তা নয়; তবে বর্তমান প্রক্রিয়ায় সরকারের পছন্দ ও বিশেষ সুবিধা নেওয়ার সুযোগ থেকে যায়", মন্তব্য করেন তিনি।

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে সংবিধানের 'আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে' শব্দাবলির ওপর জোর দিয়ে এ বিধির খসড়া তৈরি করা হয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়ায় সিইসি ও অন্য নির্বাচন কমিশনারের যোগ্যতা-অযোগ্যতা বাছাই করে প্রার্থীদের 'প্যানেল' মনোয়ননে একটি 'সার্চ কমিটি' গঠিত হবে এবং সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটির ঐক্যমতের ভিত্তিতে তা চূড়ান্ত করা হবে। এর আগে নির্বাচন কমিশন সার্চ কমিটির এ সুপারিশ সংসদ সচিবালয়ের বিবেচনার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে। প্রস্তাবিত বিধিতে এক জন নারীসহ তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।

সংবিধানের ১১৮(১) এ বলা হয়েছে, 'প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া এবং রাষ্ট্রপতি সময়ে সময়ে যে রূপ নির্দেশ করিবেন, সেইরূপ সংখ্যক অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন।'

নিয়োগের মনোনয়নের বিষয়ে কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠকের পর সিইসি এটিএম শামসুল হুদা গত ১ নভেম্বর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, "নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক পদে নিয়োগের বিষয়ে আইনের কথা থাকলেও গত ৩৬ বছরে তা হয়নি। কারণ, এটা করলে যাকে খুশি তাকে নিয়োগ দেওয়ার পথ আটকে যাবে। আমরা প্রস্তাব করব- তিন জন নিয়ে নির্বাচন কমিশন হবে। এর মধ্যে এক জন হবেন নারী।"

নির্বাচন কমিশনের আইন কর্মকর্তারা জানান, সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে সংবিধানে বা দেশের প্রচলিত আইনে কোনও যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়নি। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ এখতিয়ার প্রয়োগে রাষ্ট্রপতি স্বাধীন নন। ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে এ নিয়োগ দিতে হয়। যোগ্যতার শর্তাবলি না থাকায় যে কোনও ব্যক্তিকে এ পদে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে খসড়া অধ্যাদেশে অযোগ্যতার যে প্রস্তাব করা হয়েছে; তা হচ্ছে- ৬৫ বছরের বেশি বয়স, কোনও পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ পাওয়া, আয়ের সঙ্গে জীবনযাপন ব্যয়ের অসঙ্গতি, গণমাধ্যমে ও জনগণের কাছে বিতর্কিত, কোনও রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় পর্যায়ে সম্পৃক্ততা, আধা-রাজনৈতিক বা পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, নৈতিক স্খলন বা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত, সরকারি চাকরি থেকে বহিষ্কৃত বা বাধ্যতামূলক অবসর, ঋণখেলাপি ও বিলখেলাপি।

খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি এ অধ্যাদেশ জারি করবেন। সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ পাবেন। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন তিন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হবে, যার এক জন সদস্য থাকবেন নারী। প্রথম কার্যদিবস থেকে ৫ বছরের জন্য নিযুক্ত নির্বাচন কমিশনাররা সরকারের কোনও লাভজনক পদে থাকতে পারবেন না। তাদের নিরপেক্ষতা, সততা, দক্ষতা হবে প্রশ্নাতীত। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের মতো কোনও ভিত্তি ছাড়া তাদের সরানো যাবে না। তবে তারা স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দিতে পারবেন।

বাংলাদেশ সৃষ্টির পর মাত্র দুই বার দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিইসি ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের সময় আলোচনার মধ্য দিয়ে নিয়োগের বিষয়টি উপেক্ষিত ছিল।

এ পর্যন্ত বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে ১০ জন সিইসি ও ১৯ নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ পেয়েছেন। বিগত কমিশনে কয়েক দফায় নিয়োগ পেয়ে এক সঙ্গে সাত জন দায়িত্ব পালন করেন, ২০০৭ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তাদের সবাই একযোগে পদত্যাগ করেন। এর পরপরই এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বে মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও এম সাখাওয়াত হোসেনকে নিয়ে বর্তমান কমিশন গঠিত হয়।