নতুন ইসির সামনে ‘বন্ধুর পথ’     

প্রায় দুই মাস ব্যাপক আলোচনার মধ্যে দিয়ে সার্চ কমিটি করে নতুন যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হল, তাদের সামনে থাকছে জনপ্রত্যাশা পূরণের বিপুল চাপ।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2017, 05:44 AM
Updated : 7 Feb 2017, 08:54 AM

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সাবেক সচিব কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নতুন এই কমিশনকে সেই প্রত‌্যাশা পূরণ করতে হলে বেশ কিছু চ‌্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

এর মধ‌্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি চ‌্যালেঞ্জ হল কমিশন ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা ফেরানো এবং ২০১৯ সালের শুরুতে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব কাটিয়ে সহিংসতামুক্ত সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের চ‌্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা বিকেন্দ্রীকরণ, স্মার্টকার্ড বিতরণ ও ইভিএম ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সাফল‌্য পেতে হবে এই কমিশনকে। 

নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংগঠনগুলোর মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পরিচালক আব্দুল আলীম বলেন, কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের বিদায়ী কমিশনের মেয়াদের শুরুতে ২০১৩ সালের চার সিটি এবং শেষে এসে ২০১৬ সালের নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন ছাড়া সব ভোটই ‘কম গ্রহণযোগ্যতা’ পেয়েছে। আর এর ফলে নির্বাচন প্রক্রিয়ার উপর দেশের মানুষের আস্থা ‘কমে গেছে’।

“এ অবস্থায় ইসি ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপরে মানুষের আস্থা অর্জন করাই হবে নতুন কমিশনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। আস্থা ফেরাতে দল, নাগরিক ফোরাম, গণমাধ্যম, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাসহ অংশীজনের সঙ্গে তাদের বসতে হবে। সেই সঙ্গে স্বচ্ছ ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচন করতে পারলে ভোটারদের আস্থাও ফিরবে।”

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সোমবার সার্চ কমিটির সুপারিশ থেকে পাঁচজনকে নতুন ইসির জন‌্য মনোনীত করেন। এই কমিশনে সিইসি নূরুল হুদার সঙ্গে কমিশনার হিসেবে থাকছেন সাবেক সচিব রফিকুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ কবিতা খানম ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী।

নির্বাচন কমিশনের নতুন ভবন

নতুন ইসির জন‌্য ‘যোগ্যদের’ বেছে নিতে সার্চ কমিটি যে প্রক্রিয়ার মধ‌্যে দিয়ে গেছে, তাকে সাধুবাদ দেন আব্দুল আলীম। আর কেবল দলীয় অবস্থান থেকে ইসির বিরোধিতায় রাজনৈতিক বক্তব্য না দিয়ে নতুন ইসিকে সময় দিতে দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন একই সরকার ক্ষমতায় থাকলে দল, প্রার্থী, মাঠ প্রশাসন, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয়ভাবে প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ দৃশ্যমান হয়ে ওঠার নজির অতীতে বহুবার দেখা গেছে। এসব প্রভাব নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে কমিশনকে।

২০০৭-২০১২ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া এটিএম শামসুল হুদার ইসি দুই বছর ও পাঁচ বছর মেয়াদী কর্মকৌশল করে দিয়ে গিয়েছিল। সেখানে নির্বাচনী কার্যক্রমে সংস্কার ও সেবা বিকেন্দ্রীকরণের একটি রূপরেখা তুলে ধরা হলেও কাজী রকিবের ইসি তার ধারবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি বলে মরে করেন আব্দুল আলীম।

“ইভিএম পদ্ধতি পুনরায় চালু, জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা ও স্মার্টকার্ড বিতরণ সুচারুভাবে করা এবং নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে কর্মপরিকল্পনা রাখতে হবে নতুন ইসিকে। অনেকটা বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে তাদের।”

তিনি বলেন, সুন্দর একটি নির্বাচন কমিশন পেয়েও ‘কাজের কাজটি’ সঠিকভাবে করতে না পারলে নতুনদেরও সমালোচনায় পড়তে হবে।

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বিদায়ী কমিশনকে ‘অনেকটা যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার’ সঙ্গে তুলনা করতে চান, কেননা চ্যালেঞ্জিং একটি নির্বাচন (দশম সংসদ) তাদের করতে হয়েছে এবং শত বাধা বিঘ্নের মধ্যেও কাজী রকিবের কমিশন ভোট করতে পেরেছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নাজমুল আহসান বলেন, “নতুন ইসির জন্যে সবার অংশগ্রহণে একাদশ সংসদ নির্বাচন করাটাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। সবার আস্থা অর্জন করে ও কোনো ধরনের প্রাণহানি যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করাটাই হবে অগ্রাধিকারমূলক কাজ।”

আর আস্থার জন‌্য ভোটারসহ অংশীজনদের সঙ্গে বসে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার ও প্রায়োগিক বিষয়গুলো ইসিকে তুলে ধরতে হবে বলে মত দেন এ পর্যবেক্ষক।

অধ্যাপক নাজমুল আহসান বলেন, “নতুন কমিশন আসবে, তাদের নিয়ে সমালোচনা ও বিরোধিতা হবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু ইসিকে কাজের কাজটি করতে হবে। শাসক দল ও বিরোধী দলকে আস্থায় নিতে হবে, সবার সঙ্গে খোলা মনে কথা বলতে হবে। না হলে জনপ্রত্যাশা পূরণ হবে না।”

সার্চ কমিটি এবার নির্বাচন কমিশনার পদের জন‌্য যে আটজনের নাম প্রস্তাব করেছিল, তাদের মধ‌্যে নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহও ছিলেন; তবে চূড়ান্ত তালিকায় তিনি আসেননি।  

নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নতুন সিইসি কে এম নুরুল হুদা

আশা করি তারা বুঝবেন’

সিইসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পরদিন মঙ্গলবার সকালে উত্তরায় নিজের বাসায় সাংবাদিকদের সামনে এলেও আগামী দিনের চ‌্যালেঞ্জ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে এখনই প্রস্তুত নন বলে জানান নূরুল হুদা।

তিনি বলেছেন, দীর্ঘদিন সিভিল সার্ভিসে থাকার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ‘নিরপেক্ষভাবে’ তিনি দায়িত্ব পালন করতে চান।

সরকারি চাকরিতে থাকার সময় অনিয়মের সঙ্গে ‘আপস করেননি’ এবং ইসির দায়িত্বেও তা ‘করবেন না’ বলে প্রতিশ্রুতি দেন নতুন সিইসি। 

তবে সবার সহযোগিতা না পেলে এ দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করা সম্ভব হবে না বলেও মনে করেন বিএনপি আমলে দীর্ঘদিন ওএসডি থাকা এই সাবেক সচিব। 

বিএনপি ও সমমনাদের বর্জন আর ব‌্যাপক সহিংসতার মধ‌্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতার পর সব দলকে নিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন করার জন‌্য কী পদক্ষেপ নেবেন- এমন প্রশ্ন রাখা হয়েছিল শপথের অপেক্ষায় থাকা নতুন সিইসির সামনে। 

উত্তরে তিনি বলেছেন, “আমাদের নিরপেক্ষতা থাকবে, আন্তরিকতা থাকবে, সুষ্ঠু নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি থাকবে। আমরা তাদের সেটা বোঝাব। আমরা আশা করি, তারা সেটা বুঝবেন এবং আমাদের সহযোগিতা করবেন।”

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে চার কমিশনারকে নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার

পাঁচ বছর পার

আলোচনা-সমালোচনা ও বৈরি পরিবেশের মধ্যে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের বেশ কিছু নির্বাচন আয়োজনের পর পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করেই বিদায় নিচ্ছে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন।

২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নিয়েই কাজী রকিব বলেছিলেন, কাজেই নিপেক্ষতার প্রমাণ করতে চান তিনি।

নানা বিতর্কের মধ্যে মেয়াদের বেশিরভাগ সময় পর করার পর একেবারে শেষ দিকে এসে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন করে প্রশংসা কুড়ায় এ কমিশন। বিদায় বেলা তাদের মূল্যায়নের ভার জনগণের ওপরই ছেড়ে দেন কাজী রকিব।

নারায়ণগঞ্জের ভোটের পর সিইসি বলেছিলেন, “আস্থার বিষয়টা জনগণই স্থির করবে। এটা ভবিষ্যতের ব্যাপার। আমরা যতটুকু সম্ভব সুষ্ঠু, সুন্দর, ভালো, গ্রহণযোগ্য (নির্বাচন) করার চেষ্টা করছি।”

বিএনপি ও শরিকদের বর্জন, নৈরাজ্যের মধ‌্যে দশম সংসদ নির্বাচন করতে হয়েছে এ কমিশনকে। ওই ভোটকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা হয়, কেবল ভোটের দিনই অন্তত ২১ জন নিহত হন।

শুরুতে চার সিটি করপোরেশন ও শেষে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন ছাড়া এ কমিশনের অধীনে হওয়া উপজেলা, পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনে গোলযোগ-সহিংসতার পাশাপাশি ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে সে সময় অসহায়ত্বও প্রকাশ করে ইসি।

নিজেদের মেয়াদে ইভিএম বন্ধের পর পুনরায় তা চালু করতে না পারা, নিজেদের ক্ষমতা (আরপিও ৯১ ই ধারা বাতিল) কমানোর অভিপ্রায়, ইসিতে জ্যেষ্ঠতা নিয়ে বিরোধ ও মাঠ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে কাজী রকিবের ইসিকে।

মেয়াদের শুরুতে সংলাপ করলেও পরে আর সে ধরনের কোনো উদ্যোগ না নেওয়ার কারণেও এ কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়েছে।

বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অনেক দলই এ কমিশনের সমালোচনায় মুখর ছিল পুরোটা সময়। বিএনপি শুরু থেকেই কাজী রকিবের কমিশনকে ‘সরকারের আজ্ঞাবহ’ বলে এসেছে। এরপর জাতীয় পার্টিও বিদায়ী ইসিকে ‘মেরুদণ্ডহীন’ আখ‌্যা দিয়েছে।

সবশেষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যখন এই কমিশনকে ‘নির্দয় ইসি’ বলেছে, তখন তাকে নিজেদের ‘নিরপেক্ষতার’ প্রমাণ হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন কাজী রকিব।

তিনি বলেছিলেন, “সবার কিছু যখন অসুবিধা হচ্ছে, বুঝতেই হবে সবার প্রতি আমরা অ্যাকশন নিচ্ছি। আমাদের নিউট্রাল অবস্থা আরও স্পষ্ট হচ্ছে”।

নির্বাচনী অনিয়ম নিয়ে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার সমালোচনার মধ্যে একটি ইউপি ভোটকে কেন্দ্র করে পুরো নির্বাচন কমিশনকে আদালতে গিয়ে ক্ষমাও চাইতে হয়েছে।

২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাজী রকিব কমিশন নিয়োগ পান। সিইসি ও তিন কমিশনারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৮ ফেব্রুয়ারি এবং আরেকজন নির্বাচন কমিশনারের মেয়াদ পূর্ণ হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি।

নতুন কমিশনের সদস‌্যদের বরণের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে জানিয়ে ইসি সচিব মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, “নতুন কমিশনের অধীনে গাইবান্ধা-১ আসনের উপ নির্বাচন হবে। এরই মধ্য দিয়ে সবার কাছে নিজেদের প্রথম যাত্রা শুরু করতে পারবেন নতুন ইসি, তাতেই আস্থা অর্জনের প্রথম সুযোগ তৈরি হবে। এ লক্ষ্যে সব ধরনের সহায়তা করছি আমরা।”

স্বাধীনতার পর ইসির নিজস্ব ভবন ‘নির্বাচন ভবনেই’ যাত্রা শুরু হবে নতুন কমিশনের।

ফিরে দেখা

কাজেই নিরপেক্ষতা প্রমাণ করব: নতুন সিইসি