প্রীতি উরাং: মিরতিংগা থেকে যেভাবে মৃত্যুর কোলে

দুই বছরে মেয়েটির পরিবার টাকা পেয়েছে ১৫ হাজার। এই হিসাবে মাসে পড়ে ৬২৫ টাকা।

মাছুম কামালমৌলভীবাজার থেকে ফিরেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 March 2024, 07:25 PM
Updated : 5 March 2024, 07:25 PM

প্রীতি উরাং ভালো নাচতে পারত। কিন্তু জীবন বিকশিত হতে দিল না দারিদ্র্য। আর তার মৃত্যু প্রশ্নের মুখে ফেলে দিল ‘বড় মানুষের’ বিবেচনাবোধকে, কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতাকে।

মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে কমলগঞ্জ উপজেলার মিরতিংগা চা বাগানের ভেতর এক ছোট টিলার উপর প্রীতিদের বাড়ি। তার মৃত্যুর প্রায় এক মাস পরও সেখানে শূন্যতা, হাহাকার ও শোকের ছায়া।

একটিমাত্র কক্ষের মেঝেতেই পরিবারের সবার থাকার ব্যবস্থা। প্রীতির বাবা লোকেশ উরাং আর মা নমিতা উরাং অস্থায়ী চা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। স্থায়ী চা শ্রমিকরা রেশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড পেলেও সেসব সুবিধা তাদের নেই।

তাদের আরো একটি ছেলে ও মেয়ে আছে। তিন সন্তানের খাওয়া পরা নিশ্চিত করার কঠিন বাস্তবতায় প্রীতিকে ঢাকায় এক ‘বড়’ সাংবাদিকের বাসায় কাজে পাঠানোর প্রস্তাব এলে দ্বিতীয়বার ভাবেননি লোকেশ-নমিতা।

তারা চেয়েছিলেন, মেয়ে কাজ করে অর্থনৈতিকভাবে খুব লাভবান না হলেও অন্তত বড় হলে বিয়েটা যেন অর্থাভাবে না আটকে যায়। কিন্তু প্রীতি সব কিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছে। তার সঙ্গে কী হয়েছে, কেন সে নয় তলা ভবন থেকে ঝুলে পড়েছিল, সেসব প্রশ্নের জবাব আপাতত পুলিশের তদন্ত আর আদালতের বিবেচনার বিষয়।

এই ঘটনায় প্রীতির বাবা একটি মামলা করেছেন, সেই মামলায় অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। তাতে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকার আসামি, তারা এখন কারাগারে বন্দি।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুর শাজাহান রোডের সৈয়দ আশফাকের বাসার নিচ তলা থেকে প্রীতির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছিলেন, মেয়েটি কিছুক্ষণ বারান্দা ধরে ঝুলছিল। এক পর্যায়ে পড়ে মারা যায়।

একই বাড়ি থেকে গত বছরের অগাস্টে সাত কি আট বছরের একটি মেয়ে একইভাবে পড়ে যায়। সে বেঁচে গেলেও সারা জীবনের জন্য ক্ষতি হয়ে গেছে।

ওই ঘটনায় দুই লাখ টাকায় মীমাংসা করেছে সৈয়দ আশফাকের পরিবার। তবে মেয়েটির যে শারীরিক জটিলতা, তাতে ওই টাকায় কতটা চিকিৎসা হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

প্রীতি সেই বাসায় ছিল বছর দুয়েক। তার নিয়োগের সময় মৌখিক কী চুক্তি হয়েছিল, তা বলতে পারছেন না বাবা মা। যিনি মধ্যস্থতা করেছিলেন, তিনি ডেইলি স্টার পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধি মিন্টু দেশোয়ারা। তিনি এখন মুখ খুলছেন না।

যেভাবে ঢাকায় প্রীতি

অভাবের মাঝে হাসি আনন্দ দুঃখ কষ্ট মিলিয়ে কাটছিল মেয়েটির শৈশব। পড়াশোনাও চলছিল।

সে পড়ত মৌলভীবাজার চা জনগোষ্ঠী আদিবাসী ফোরাম উদ্যোগ শিক্ষা কেন্দ্রে।

ঢাকায় কীভাবে পাঠালেন- এই প্রশ্নে প্রীতির চাচা লগেন উরাং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মিন্টু সাংবাদিক (মিন্টু দেশোয়ারা) একটা মেয়ে চাইতেছিল। পরে ভাইরে বলছিল। আমরা জানতে আছিলাম না হ্যার (আশফাকুল হক) বাসায় দিবে। আমরা ভাবছি মিন্টুর বাসায় আছে।”

আরও পড়ুন:

Also Read: সিলেটে `গৃহকর্মী নির্যাতন', সরকারি কর্মকর্তার ব্যাংকার স্ত্রী জিজ্ঞাসাবাদে

Also Read: সেই ফেরদৌসীকে নিয়ে এখন দিশেহারা পরিবার, প্রয়োজন ভালো চিকিৎসা

Also Read: শিশু গৃহকর্মীকে ফুটন্ত পানি ঢেলে ‘নির্যাতন’, কুমিল্লায় সাবেক অধ্যক্ষের স্ত্রী আটক

Also Read: গৃহকর্মী নির্যাতন: গ্রেপ্তার দম্পতির রিমান্ড শুনানি ১৮ জুলাই

Also Read: গৃহকর্মীকে ‘হারপিক খাইয়ে’ নির্যাতন, গৃহকর্ত্রী গ্রেপ্তার

কীভাবে প্রীতির বাবা লোকেশ উরাং মিন্টু দেশোয়ারার খোঁজ পান?

লোকেশ বলেন, “আমার শালা ফুলসাই উরাং আমাকে মিন্টুর সন্ধান দিছিল। এরপর মিন্টু এসে বলল, ওই বাসায় আরও দুইটা বাচ্চা আছে, দেখাশোনা করব, আর থাকব।

“মিন্টু গার্জিয়ান হইয়া মেয়েটাক দিছিল। ২০২২ সালে। আরেকটা আমার জ্যাঠালির (বউয়ের বড় বোন) মেয়ে ছিল ওইখানে। তাই বিশ্বাস করিয়াই তাক দিলাম।”

কুলাউড়ার মুরইছড়া চা বাগানে থাকেন প্রীতির মাসি সুশীলা উরাং। সুশীলার মেয়ে, অর্থাৎ প্রীতির খালাত বোনও সৈয়দ আশফাকুলের বাসায় কাজ করত। দুই বোন একসঙ্গে থাকলে ভালো হবে, এ কথা ভেবে প্রীতিকে সেখানে পাঠাতে আপত্তি করেনি পরিবারটি।

প্রীতির মামা ফুলসাই উরাং বলেন, “মিন্টু আসিয়া বলেছে, ‘দেখ এ রকম যদি কেউ যাওয়ার থাকে দেও।’ পরে দিলাম। যেহেতু আরেকটা মেয়ে আছে, আমরা বুঝি নাই কোনো সমস্যা হবে।”

প্রীতি মারা যাওয়ার দুই সপ্তাহ আগে ছোট বোনের মৃত্যুর খবরে বাড়ি ফেরে খুশি। তখন পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত হয় আর পাঠানো হবে না বাসায়।

কেন এমন সিদ্ধান্ত, সে প্রশ্নের জবাব মিলল না বহু প্রশ্ন করেও।

বেতন কত, সুযোগ সুবিধা কী ছিল

প্রীতির বাবা লোকেশ উরাং ও মামা ফুলসাই উরাং বলছেন, গত দুই বছরে নানা সময় তারা ১৫ হাজার টাকার মত ‘চেয়ে নিয়েছেন’। এই তথ্য সঠিক হলে বছরে হয় সাড়ে সাত হাজার, আর মাসে ৬২৫ টাকা।

পরিবারের তথ্য বলছে, সৈয়দ আশফাকের বাসায় ৯ বছর কাজ করে খুশি উরাং ছুটি পেয়েছে কেবল দুইবার। টাকা কড়ি কেমন পেয়েছে এই প্রশ্নে তার মামা ফুলসাই উরাং বলেছেন, “গত বছর গরু কেনার জন্য ৪৫ হাজার টাকা দিছিল।”

এর আগে নানা সময় ‘টুকটাক’ টাকা পেয়েছে মেয়েটির পরিবার। কিন্তু মাসিক নির্দিষ্ট কোনো বেতন দেওয়া হয়নি তাকেও।

খুশি জানায়, তার বা প্রীতির বাবা মায়ের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ ছিল সীমিত।

প্রথম বছর প্রীতি কিছুটা যোগাযোগ করতে পারলেও গত এক বছর ‘যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি’ বলে তার বাবা লোকেশ উরাংয়ের ভাষ্য।

তিনি বলেন, “আমি একবার ফোন করলাম, তখন উনি (আশফাক) বলছে, ‘আমি একটু মিটিংয়ে আছি, বাসায় গেলে ফোন দিব।’

“পরের সপ্তায় আবার ফোন দিলাম। বলে, ‘আমি আজকে আরও দূরে আছি। বাসায় গেলে ফোন দিব।’

“তারপর আমি বললাম যে, দেখ গত সপ্তায় বললেন ফোন করিয়া, আজকেও ফোন করিয়া বলতেছেন বাসায় গেলে ফোন করব।... তারপরে থেকে আর ফোনে যোগাযোগ আমার সাথে হইত না। ফোন দিলে মানে ফোন কাটিয়া দিত।”

সৈয়দ আশফাকুলের বাসায় গৃহ শ্রমিকদের সঙ্গে আচরণ কেমন ছিল-এই প্রশ্নে খুশি উরাং ভালো-মন্দ মিলিয়ে দুটি অভিজ্ঞতার কথাই বলেছে।

সে বলে, “তারা যা রান্না করত, আমাদেরও তাই খেতে দিত। খাওয়ার কোনো কষ্ট ছিল না। থাকারও অসুবিধা ছিল না।”

কাজ কী করতা?-জবাব এল, “ঘর ঝাড়ু দেয়া, ধুয়ে-মুছে রাখার কাজ করতাম। মাঝে-মাঝে আমার কিছু-কিছু ছোটখাট ভুল হত, ওগুলার জন্য আমি মার খেতাম। হাত দিয়ে বা লাঠি থাকলে লাঠি দিয়ে মারত। প্রীতিকেও একবার-দুইবার মারধর করেছে।”

এক পরিবারে দুই জন কেন লাগত?- খুশি বলে, “থাকে না ছোটখাট কাজ, ওগুলা করার জন্য।”

শিশু গৃহকর্মী

এই দম্পতির বাসায় ৯ বছর খেটে আসা প্রীতির খালাত বোন খুশি উরাংয়ের বয়স হয়েছে সবে ১৭। অর্থাৎ যে যখন বাসাটিতে কাজে যোগ দেয়, তখন তার বয়স ছিল ৮। তাকেও সেই বাসায় পাঠান সেই মিন্টু।

গত বছরের অগাস্টে সেই বাসা থেকে পড়ে আহত হওয়া ফেরদৌসীরও বয়স ছিল ৮। প্রীতির বয়সের ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে দুটি বর্ণনা। মামলায় বলা আছে ১৫, তবে মৌলভীবাজারে সে যে স্কুলে পড়ত, সেখানকার এক শিক্ষকের তথ্য বলছে, তার বয়স ছিল ১৩। আরো দুই বছর আগে যখন সে কাজে যোগ দেয়, তখন বয়স ছিল ১১।

অর্থাৎ সৈয়দ আশফাকের পরিবার অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরকে নিয়োগ করে আসছে আগে থেকেই। যদিও গৃহকর্মী নিয়ে ২০০৯ সালে সরকার যে নীতিমালা করে, তাতে আইনগত অভিভাবকের সম্মতিতে ১২ বছর বয়সে কেবল হালকা কাজের জন্য নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা আছে।

কিন্তু সেই নীতিমালা আইনে পরিণত করেনি সরকার। আরো যা যা করার কথা ছিল করা হয়নি তাও। চালু হয়নি হেল্প লাইন নম্বরও।

আইনজীবী আবুল হাসান বলেন, ২০০৬ সালের ৪২ নম্বর শ্রম আইনের ৩৪ (১) ধারা অনুযায়ী কোনো পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে কোনো শিশুকে নিয়োগ করা যাবে না।

“এখন ৮ বছরের বা ১১ বছর বয়সের একটা শিশুকে কেন তারা বাসায় কাজের জন্য নিয়োগ করবেন সেটি একটি প্রশ্ন। তারা যদি শিশুটির অভিভাবকত্ব নিয়ে থাকেন, তাহলে তো তাকে লেখাপড়ার সুযোগও করে দিতেন। কিন্তু তারা শুধু কাজের জন্যই নিয়েছেন। ফলে, এখানে শ্রম আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হয়েছে।” 

প্রীতির মাকে ঢাকায় আনা হয় ‘মিথ্যা বলে’

প্রীতির মা নমিতা উরাং। শোকের ধাক্কা সামলে শুকিয়ে এসেছে চোখের জল। বলছিলেন, তার মেয়ের মৃত্যুর দিন মিন্টু অন্য কথা বলে তাকে নিয়ে ঢাকায় আসেন।

“আমি লাকড়ি আনার জন্য গেছি বাগানে। হ্যায় (লোকেশ) গ্যাছিল জমিনে। তখন মিন্টু আসিয়া আমারে টোকায়। দুপুর ১২টার দিকে। আমি তো বলি দুই বছর পর মিন্টু কেনে আসবে? মনে ডাক দিল আমার মেয়েটার কিছু হইয়েছে। কিন্তু, মিন্টু কয় নাই যে তোমার মেয়ে লাখান (মারা) হইছে। 

“প্রথমে মিথ্যা কথা বলিয়া মিন্টু বলেছে শ্রীমঙ্গলে যেতে হবে। পরে সেখান থেকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। রাত ১০টার দিকে ঢাকায় গিয়ে সোজা থানায় নিয়া যায়। এরপর পুলিশ জানায় আমার মেয়েটা মারা গ্যাইছে।”

বলতে বলতে বারবার বুক চাপড়াচ্ছিলেন নমিতা। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই লোকেশ এগিয়ে এসে তাকে ধরে ফেলেন।

মিন্টুর বক্তব্য কী? বহুবার ফোন করা হলেও তার সাড়া মেলেনি। পরে ফোনে এসএমএস পাঠালে জবাব দেন এক বাক্যে, “বিষয়টি বিচারাধীন। এর বেশি কিছু বলার নেই। ভালো থাকুন।”

মামলার এজাহার কে লিখেছে?

প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুর ঘটনায় যে মামলা হয়েছে ৩০৪ (ক) ধারায়, অর্থাৎ অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে, সেটি এজাহার থেকে প্রীতির মা-বাবাকে পড়ে শোনানো হয়। সব শুনে তারা বলেন, এসব লিখেছে পুলিশ। আর টিপসই নেওয়ার আগে তাদের পড়ে শোনানো হয়নি।

মামলার ধারা, শাস্তি- এসব নিয়ে তাদের আগেও কোনো ধারণা ছিল না, এখনও নেই।

প্রীতির বাবা লোকেশ উরাং বলেন, “রাত ১০টায় থানায় ঢুকি আমরা। পরদিন দুপুর সাড়ে ৩টায় থানা থাকি বাহির হই। পুরা সময় যাওয়ার পর থেকেই থানাতেই আছিলাম। থানা থেকেই জানানো হয় আমার মেয়ে মারা গেছে। ওই বাসায় বা ঘটনাস্থলে যাইনি।”

নমিতা উরাং বলেন, “আমাদের থানায় এক কোঠায় বন্দি করে রাখছে। আমাদের বের হতে দিছে না।”

অথচ এজাহারে বাদীর জবানীতে বলা হয়েছে, “৬/০২/২০২৪ রাত আনুমানিক ১১ ঘটিকায় মোহাম্মদপুর থানাধীন শাহজাহান রোডস্থ বাসা নং-২/৭ এর সামনে আসিয়া পুলিশ ও লোকজনের ভিড় দেখতে পাই।”

অথচ প্রীতির মা-বাবার বিবরণ অনুযায়ী তারা সোজা থানায় যান। থানাতেই সৈয়দ আশফাকুলের স্বজনরা তাদের সঙ্গে দেখা করেন।

এজাহারে লেখা, “আমি লেখাপড়া জানি না। আমাকে পড়িয়া শুনাইলে আমি শুদ্ধ স্বীকারে নিম্নে টিপ সহি প্রদান করিলাম।”

লোকেশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তো জানিই না। পুলিশেরা জিগাইল যে তোমরা কি মামলা করবায় না? মামলা করাই লাগবে। আমার তো স্বাক্ষর ওরা নিবই। কারণ, আমরা লাশ আনার গেছি। হ্যারা বুঝাইছে দস্তখত না নিলে তোমরা লাশ নিতে পারবা না।”

আরও পড়ুন:

Also Read: ৮ তলা থেকে পড়ে শিশু গৃহকর্মী আহত, গৃহকর্তা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা

Also Read: প্রীতির মৃত্যু: বিচার না পেলে ‘বৃহত্তর’ আন্দোলনের হুঁশিয়ারি

Also Read: আরেক গৃহকর্মী আহতের মামলায় অব্যাহতি সাংবাদিক আশফাক ও তার স্ত্রীর

মামা ফুলসাই উরাং বলেন, “আমরা সরাসরি থানাতেই গেলাম এবং ওখানেই ছিলাম পুরো সময়। দিদিকে ডাকল, দুলাভাইকে ডাকল। ফিঙ্গার নিল। আমরা কারও সাথে পরামর্শ করতে পারি নাই কিছু। বের হয়ে মর্গ থেকে লাশ নিয়ে চলে আসছি।”

আইনজীবী আবুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মামলা নেওয়ার আগে তাদের লাশ দেখানোর কথা। লাশের গায়ে আঘাতের চিহ্ন আছে কি না বা নির্যাতনের বাহ্যিক কোনো লক্ষণ আছে কিনা সেটি দেখানো হলে অন্য ধারায় হয়ত মামলাটি করতে পারতেন এই দম্পতি।

প্রীতির বাবা মায়ের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তা অস্বীকার করে মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহফুজুল হক ভূঞা বলেন, “ওদের সাথে যারা লোক ছিল, ওদের আত্মীয়-স্বজন, ওরা যেভাবে এজাহার দিয়েছে, সেভাবেই মামলা নেয়া হয়েছে। এখন ওরা কী বলল, না বলল সেটা তো... আমরা আইন অনুযায়ীই ব্যবস্থা নিয়েছি।

“মামলা তো ডিবিতে চলে গেছে। তদন্ত করবে আইও, তদন্ত করে ধারা চেঞ্জ হলে, তদন্তে আসলে আসবে। সমস্যা নাই তো।”

গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তেজগাঁও জোনের উপ-কমিশনার মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, “আমরা তদন্তে যেটা পাব, ওটাই দেব। নতুন কোনো ধারা তদন্তকে সমর্থন করলে সেটিও যুক্ত করা হবে।”

বয়স নিয়ে দুই ধরনের তথ্য

মৌলভীবাজারে যে স্কুলে পড়ত প্রীতি, সেখানকার শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তার আসমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০১৮ সালে প্রীতি আমাদের এখানে শিশু শ্রেণিতে পড়ত। তখন ওর বয়স ছিল ৭ বছর। খুব চঞ্চল ছিল মেয়েটা। ভালো নাচ জানত। প্রায়ই আমাদের বাসায় আসত। ওর মৃত্যুর খবর শোনার পর ভীষণ খারাপ লেগেছে। আমার ধারণা বাচ্চাটার ওপর কোনো নির্যাতন হয়েছিল।”

তার বক্তব্যে প্রীতির বয়স নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। ২০১৮ সালে যদি তার বয়স ৭ হয়, তাহলে মৃত্যুর সময় তার বয়স হওয়ার কথা ১৩। কিন্তু ১৫ বছর ধরেই মামলা নথিবদ্ধ করা হয়েছে।

প্রীতিদের বাড়িটি যে মিরতিংগা চা বাগানে, সেটি পড়েছে মনু-ধলুই ভ্যালিতে। এই ভ্যালির অধীনে বাগানের সংখ্যা ২৪টি। হালকি লাইনে থাকে ৬০টি পরিবার। বাগানের ভেতর এলাকাগুলো বিভাজন করা হয় লাইন ধরে। সেখানে উরাং ছাড়াও বাড়াইক নৃগোষ্ঠীর কিছু মানুষ আছে। লাইনগুলোতে আলাদা পঞ্চায়েত কমিটিও আছে।

সেখানে কোনো শিশুর বয়স সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রীতির কোনো জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু হয়নি।

সাধারণত চা বাগানে কোনো শিশুর জন্ম হলে সেই তথ্য স্থানীয় হাসপাতালে লিপিবদ্ধ থাকে। কিন্তু প্রীতির জন্ম তারিখ খুঁজে পাওয়া গেল না সেখানেও। তার পরিবারও এ বিষয়ে কিছু বলতে পারেনি। 

অনেক প্রশ্ন স্থানীয়দের

প্রীতির মৃত্যু নিয়ে তার স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে আছে অনেক প্রশ্ন। কারো ধারণা মেয়েটিকে নির্যাতন করা হয়েছে। কেউ বলছেন, এটি হত্যাকাণ্ডও হতে পারে। নইলে দুই বছর থাকার পর কেন এই ঘটনা ঘটবে।

মিরতিংগা চা শ্রমিক ইউনিয়নের অধীন মনু-ধলই ভ্যালি কার্যকরী পরিষদের সভাপতি ধনা বাউরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ঘটনা জেনেছি পরে, কমলগঞ্জ এবং মোহাম্মদপুর থানা থেকে ফোন দিছে যখন, তখন। এ বাগান থেকে সে (প্রীতি) যে গেছে ঢাকাতে, কেউ জানে না।

আরও পড়ুন:

Also Read: ‘উপর থেকে পড়ে’ গৃহকর্মীর মৃত্যু, স্ত্রীসহ সাংবাদিক থানায়

Also Read: আগেরটির বিচার হলে প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যু হত না: চা শ্রমিক নেতা

Also Read: গৃহকর্মীর মৃত্যু: সাংবাদিক আশফাক ও তার স্ত্রী ৪ দিনের রিমান্ডে

“প্রীতি উরাং স্কুলে পড়ত। স্কুল থেকে প্রলোভন দেখিয়ে তাকে যারা নিয়ে গেছে, তারা বিচক্ষণ মানুষ, সেটা যে শিশু শ্রমের আইনে পড়ে তারা জানে না?”

ধনা বাউরী স্থানীয় রহিমপুর ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য। তিনি বলেন, “প্রীতিকে নিয়ে যাওয়া থেকে সৎকার পর্যন্ত পুরো ঘটনাই ঘটেছে অগোচরে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার তো জানার কথা, আমাকেও না জানিয়ে ঘটনার দিন সকাল বেলা মিন্টু আসি ওদের নিয়ে গেছে।

“এরপর আমি শুনে তো ফোন করি, ফোন ধরে না ওরা। পরে নানা অজুহাত দেখিয়ে বাগানের পরিস্থিতি বুঝি রাত ১১টা নাকি ১২টার সময় লাশ এনে সৎকার করেছে। মানে, প্রতারণার শেষ নাই। এটা হত্যাকাণ্ড। এর আগেও ওই বাড়িতে এমন ঘটনা ঘটেছে। আমরা এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাই এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।”

স্থানীয় বাসিন্দা সাতলাল উরাং বলেন, “আমরা আগেও শুনেছি মুখে-মুখে, খুশির পিঠে মারধরের দাগ আছে।”

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের মাঠকর্মী শংকর তাঁতী বলেন, “আমরা মনে করি এটা হত্যাকাণ্ড। যদি প্রীতি লাফিয়ে পড়ে তাহলে বলতে হবে ওক (ওকে) নির্যাতন করে আত্মহত্যা করাইছে।”

প্রীতির প্রতিবেশী পূরণ উরাং বলেন, “ওই বিল্ডিংয়ে দুইটা (ফেরদৌসীর লাফিয়ে পড়া) ঘটনা ঘটেছে। তার মানে ওখানে কোনো একটা রহস্য আছে৷” 

আদিবাসী অধিকার সংগঠনগুলো ‘চুপ’ কেন

ওরাও নৃ গোষ্ঠীর সদস্য প্রীতির মৃত্যুর পর আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোকে সক্রিয় দেখা যায়নি।

মিরতিংগা চা-বাগানের বাসিন্দা প্রেমকুমার উরাং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, “গরিব বলেই প্রীতির ঘটনাটা গুরুত্ব পায় নাই। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মানববন্ধন জাতীয় কর্মসূচি হইছে ঢাকা ও মৌলভীবাজারে। অথচ আমাদের আদিবাসী নেতারা চাইলে সারাদেশে আন্দোলন করতে পারত।”

জানতে চাইলে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, “ঘটনাটি দুঃখজনক, বাংলাদেশে কোনো মেয়ের উপরই যেন নির্যাতন না করা হয়।”

তবে তারা নিষ্ক্রিয়- এই কথাও মানতে নারাজ। তিনি বলেন, “আমাদের ছেলেরা একটা মানববন্ধন করেছে। আরও কিছু করবে কি না আমি জানি না। তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।”

তবে প্রীতির মামলায় আইনি সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।

সংস্থাটির আইনজীবী সত্যজিৎ কুমার দাশ বলেন, “ব্লাস্টের হেড অফিসের নির্দেশনায় প্রীতির পরিবারকে আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য আমরা ওকালতনামায় তার মা-বাবার স্বাক্ষর নিয়েছি।” 

আরও পড়ুন:

Also Read: এভাবে কি গরিবের মেয়েকে ফালানো লাগে: প্রীতির মা

Also Read: প্রীতি উরাংদের জন্য না হয় একটু মায়াকান্না হোক

Also Read: গৃহকর্মী: শ্রমিকের মর্যাদা নেই, সরকারের দায়িত্ব শুধু কিতাবে