ওই বাসায় সিসি ক্যামেরা থাকলেও তার মেমোরি কার্ড না পাওয়াকে সন্দেহের চোখে দেখছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা।
Published : 13 Feb 2024, 04:57 PM
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ভবন থেকে পড়ে কিশোরী গৃহকর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।
পুলিশের রিমান্ড আবেদনের শুনানি করে ঢাকার মহানগর হাকিম সাইফুর রহমান মঙ্গলবার এ আদেশ দেন।
আশফাক ও তার স্ত্রীকে এদিন আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার এসআই নাজমুল হাসান।
আইনজীবী অশোক কুমার বিশ্বাস, চৈতন্য চন্দ্র হালদার, আশরাফ উল আলম আসামিদের পক্ষে রিমান্ডের বিরোধিতা করে জামিনের আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এর বিরোধিতা করা হয়। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।
আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখার এসআই হেলাল উদ্দিন জানান, শুনানির সময় আসামিরা নিজেদের পক্ষ নিয়ে বিচারকের প্রশ্নের উত্তর দেন।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টার দিকে শাহজাহান রোডের জেনিভা ক্যাম্প সংলগ্ন ভবনের নবম তলায় আশফাকুল হকের বাসা থেকে পড়ে মারা যায় প্রীতি উরাং নামের ১৫ বছর বয়সী ওই কিশোরী।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মিত্তিঙ্গা গ্রামের লোকেশ উরাংয়ের মেয়ে প্রীতি প্রায় দুই বছর ধরে ওই বাসায় গৃহ সহায়ক হিসেবে ছিলেন।
খবর পেয়ে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ মেয়েটির লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।
সে সময় স্থানীয়রা ওই বাড়ির ফটকে জড়ো হয়ে ‘মেয়েটিকে হত্যা করা হয়েছে’ অভিযোগ করে বিক্ষোভ শুরু করে। পরে পুলিশ আশফাক, তানিয়াসহ তাদের পরিবারের ছয়জনকে থানায় নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের দুইজনকে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
৭ ফেব্রুয়ারি সকালে মোহাম্মদপুর থানায় এসে মামলা দায়ের করেন লোকেশ উরাং। আশফাকুল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ৩০৪ (ক) ধারায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ করা হয়।
সেদিনই দুই আসামিকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চেয়েছিল পুলিশ। কিন্তু তা নাকচ করে দিয়ে দুই আসামিকে তিন দিনের মধ্যে কারা ফটকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন বিচারক। একইসঙ্গে আসামিদের জামিনের আবেদনও নাকচ করে দেন।
সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় সিসি ক্যামেরা থাকলেও তার মেমোরি কার্ড না পাওয়াকে সন্দেহের চোখে দেখছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, বাসার বাইরের ভিডিও পাওয়া গেলেও সেখানে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু মেলেনি।
তদন্ত কর্মকর্তা এসআই নাজমুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা চার দিনের রিমান্ড পেয়েছি। তাদের বাসায় যে সিসি ক্যামেরা আছে, সেটার মেমোরি কার্ড পাওয়া যাচ্ছে না। সেটা তদন্তের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
“এটা উদ্ধার করা গেলে তদন্তে অনেক অগ্রগতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যে দুইজনকে রিমান্ড পাওয়া গেছে, তাদের দিয়ে মেমোরি কার্ড উদ্ধারের চেষ্টা করা হবে।”
মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহফুজুল হক বলেন, তদন্তের স্বার্থে গ্রেপ্তার দুইজনকেই ‘নিবিড়ভাবে’ জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। এজন্য মঙ্গলবার আদালতের কাছে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।
গত বছরের ৬ অগাস্টে একই ধরনের ঘটনা ঘটে আশফাকুল হকের বাসার। সেবার নয় বছরের এক শিশু গৃহকর্মী লাফিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হয়। ওই ঘটনায় নির্যাতনের অভিযোগ এনে আশফাকুল হক, তার স্ত্রী তানিয়া হক ও শিল্পী নামের আরেক নারীকে আসামি করে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন শিশুটির মা। কিন্তু সেই মামলা থেকে তারা অব্যাহতি পেয়ে যান।
শুনানিতে যা হল
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, আসামিরা দুই কারাগারে (ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার ও কাশিমপুর কারাগার) থাকায় তাদের আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলেও একসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি। আসামিরা মামলার ঘটনা সম্পর্কে অনেক ‘রহস্যময়’ তথ্য দিয়েছেন এবং বিভিন্নভাবে ঘটনার মূল রহস্য ‘কৌশলে এড়িয়ে’ গেছেন।
আবেদনে এও বলা হয়, ঘটনাস্থলে একটি সিসি ক্যামেরা আছে, যার মধ্যে ভিডিও রেকর্ডের জন্য একটি মেমোরি কার্ডের স্লট থাকলেও সেখানে মেমোরি কার্ড পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা ‘কৌশলে বিভিন্ন যুক্তি’ দেখিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান জানিয়ে আবেদনে বলা হয়, “ধারণা করা হচ্ছে ওই ক্যামেরায় ঘটনার ভিডিও ধারণ হয়ে যাওয়ায় আসামিরা ঘটনার পরপরই সেখানে থেকে আলামত নষ্ট বা গোপন করার জন্য ওই মেমোরি কার্ড লুকিয়ে রাখতে পারেন।”
ওই মেমোরি কার্ডই মামলার রহস্য উদ্ঘাটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে মন্তব্য করে আবেদনে বলা হয়, “মামলাটির রহস্য নিয়ে জনমনে বিভিন্ন সন্দেহ বিরাজ করছে। এ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, যা গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে।
“প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যু দুর্ঘটনা নাকি হত্যা তা উদ্ঘাটন করতে আসামিদের নিয়ে মেমোরি কার্ড উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা যেমন দরকার, তেমনই দুজনকে মুখোমুখি করে ‘নিবিড়ভাবে’ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ রিমান্ডে পাওয়া একান্ত আবশ্যক।”
রিমান্ড শুনানিতে বিচারকের প্রশ্নের উত্তরে আশফাকপত্নী তানিয়া বলেন, প্রীতি ছিল ‘খুব আহ্লাদী’।
“আমার বাচ্চাদের হেল্প করার জন্য, আমার বাসায় ছোটো বুয়া হিসেবে কাজ করার আগ্রহ দেখালে আমরা তাকে প্রথমে আম্মার বাসায় দিই। পরে আমাদের এখানে।
“জানালার পাশের ওই জায়গাটি (যে জায়গা থেকে আগের শিশু গৃহকর্মী লাফিয়ে পড়ে) দেখার খুব কৌতূহল ছিল ওর (প্রীতির)। ওর খুব আগ্রহ ছিল বলে আমি বলেছিলাম, ‘ওখানে শয়তান আছে। জায়গাটা কুফা’।”
আশফাক বলেন, “আগের মেয়েটি কোত্থেকে পড়েছে দেখতে চাইত ও।”
আসামিদের অন্যতম আইনজীবী চৈতন্য চন্দ্র হালদার শুনানিতে বলেন, “ওকে আমাদের ডেইলি স্টারের মৌলভীবাজারে প্রতিনিধি মিন্টু এদের বাসায় দেয়। এই মেয়ের বাবাসহ লোকজন বলেছে, তারা মামলাই করবেন না। আমি আরো সাত-আটজন রিপোর্টারের সাথে থানায় উপস্থিত ছিলাম।”
তাদের অপর আইনজীবী অশোক কুমার বিশ্বাস এবং আশরাফ উল আলমও রিমান্ডের বিরোধিতায় এবং জামিন চেয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন।
বিচারক ওই বাসার সিসিটিভি ফুটেজ ও মেমোরি কার্ড নিয়ে এজলাসে উপস্থিত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার এস আই নাজমুল হাসান এবং আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেন।
প্রায় আধা ঘণ্টা শুনানি নিয়ে বিচারক দুই আসামির জামিন আবেদন নাকচ করে রিমান্ডে নিয়ে চার দিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন ।
পরিবারের ভাষ্য
এদিন প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যার অভিযোগ তুলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে সচেতন নাগরিক সমাজ নামের একটি সংগঠন।
আগের দিন সোমবার মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে এক বিক্ষোভ সমাবেশে প্রীতির মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন তার বাবা লোকেশ উরাং ও পরিবারের সদস্যরা।
সেখানে লোকেশ বলেন, ডেইলি স্টারের মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি মিন্টু দেশোয়ারার কথাবার্তার মাধ্যমে তার মেয়ে আশফাকুল হকের বাসায় কাজের জন্য যায়।
শুরু থেকেই মেয়ের তেমন খোঁজ-খবর পাওয়া যেত না অভিযোগ করে লোকেশ বলেন, প্রীতির মৃত্যুর দিন মিন্টু দেশোয়ারা তাদের শ্রীমঙ্গল যেতে বলেন। শ্রীমঙ্গল যাওয়ার পর মেয়ে মারাত্মক অসুস্থ বলে তাদের ঢাকায় নিয়ে যায়। ঢাকা যাওয়ার পর সরাসরি তাদের থানায় নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, “গিয়ে মেয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনি। পরে মেয়ের মৃতদেহ নিয়ে বাড়ি চলে আসি। মেয়ের মৃত্যুর বিচার চাই।”
এই কিশোরীর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আশফাকুল হকের বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি।
ডেইলি স্টার এক বিবৃতিতে বলেছে, “আমাদের জ্যেষ্ঠ সহকর্মী ও নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় এক কিশোরী গৃহ সহায়কের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় আমরা গভীরভাবে মর্মাহত। দুর্ভাগ্যজনক এ ঘটনার জন্য আমরা গভীর দুঃখ প্রকাশ করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। তদন্তে কী পাওয়া গেল, তা জানার অপেক্ষায় আছি আমরা।”
পুরনো খবর
প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাইলেন বাবা
গৃহকর্মীর মৃত্যু: সাংবাদিক আশফাক ও স্ত্রী কারাগারে
গৃহকর্মীর মৃত্যু: সাংবাদিক আশফাক ও স্ত্রীকে রিমান্ডে চায় পুলিশ