প্রীতি উরাংদের জন্য না হয় একটু মায়াকান্না হোক

‘পদ্মা নদীর মাঝি’র কুবেরের আক্ষেপ ছিল, ঈশ্বর থাকেন ভদ্রপল্লীতে। ফেরদৌসী এবং প্রীতি উরাংদের ক্ষেত্রেও আইন-আদালত কি ওই ভদ্রপল্লীতেই থাকেন?

দীপায়ন খীসাদীপায়ন খীসা
Published : 3 March 2024, 06:40 AM
Updated : 3 March 2024, 06:40 AM

প্রীতি উরাং। চা শ্রমিকের সন্তান। চা শ্রমিকের কিশোরী কন্যাটি ঢাকায় এসেছিল গৃহকর্মীর কাজ করতে, দেশের শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায়।

গৃহকর্মী শব্দটা শুনতে বেশ ভালোই শোনায়। আসল পরিচিতি হবে বাসাবাড়ির চাকর। ভদ্রলোকেরা হালনাগাদ গৃহপরিচারিকা, গৃহকর্মী, হেল্পিং হ্যান্ড ইত্যাদি পরিচিতি ব্যবহার করছেন তাদের ক্ষেত্রে। কিন্তু কর্মটা এবং সম্মানটা ওই আগের মতোই, ঘরের চাকর-বাকর কিংবা গৃহভৃত্য থেকে আলাদা কিছুতে উন্নীত হয়নি অধিকাংশ ক্ষেত্রে।

প্রীতি উরাং ঢাকায় আসবে, কার বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করবে, এইসব বিষয় পরিবারের লোকের বাইরে অন্যদের জানার কথা নয়। অবশ্য প্রীতির ক্ষেত্রে পরিবারও কতটা জানত এই নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই অপরিচয়ে বাঁধ সাধল প্রীতির মৃত্যু। ঢাকার মোহাম্মদপুরের যে বাসায় প্রীতি উরাং কাজ করত, সেটির অবস্থান একটি বহুতল ভবনের নয় তলায়। সেই নয় তলা থেকে প্রীতি পড়ে গিয়ে মরে যায়।

৬ ফেব্রুয়ারি এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। প্রীতি উরাংয়ের নিথর দেহ নিচে পড়ে থাকতে দেখে মোহাম্মদপুরের জেনিভা ক্যাম্প-সংলগ্ন এলাকাবাসী হত্যার অভিযোগ এনে বিক্ষোভ করতে থাকেন। মূলত এলাকাবাসীর বিক্ষোভের কারণেই পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। সৈয়দ আশফাক ও তানিয়া খন্দকার দম্পতিকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে থানায় একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের হয়, যতদূর জানি মামলাটি হয়েছে অবহেলাজনিত মৃত্যুর। আমি আইনজ্ঞ নই, তবু মনে হয়েছে, মামলার এজাহারেই একটি শুভঙ্করের ফাঁকি তৈরি করে রাখা হয়েছে। কে তৈরি করেছে ফাঁকিটা? পুলিশ নাকি সৈয়দ আশফাকের ক্ষমতা?

সেই মামলাতেই আশফাকুল ও তানিয়া কারাগারে আটক আছেন। মামলাটি হতে পারত হত্যা মামলা। নিদেনপক্ষে আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা। হত্যা না আত্মহত্যা সেটা অবশ্য তদন্তসাপেক্ষ। মামলার এজাহারে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেত। শিশু শ্রম বিষয়েও আরেকটি মামলা করা যেত, না হয় শিশু শ্রমিক নিয়োগ করে যে অপরাধ করেছেন সৈয়দ আশফাক ও তানিয়া খন্দকার, সেগুলোর উল্লেখ থাকতে পারত। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ধারাগুলোও প্রয়োগ করা উচিত ছিল এই মামলায়। কিন্তু মোহাম্মদপুর থানা সেই বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছে।

প্রীতি উরাং মারা যাওয়ার পর অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে চলে আসতে শুরু করে। মামলার এজাহার বেশ দুর্বল। এলাকাবাসী বলছেন প্রীতির দেহ উলঙ্গ ছিল। কিন্তু সেই বিষয়ে মামলার এজাহারে আদৌ কিছু লেখা হয়েছে কি? সংবাদমাধ্যম অবশ্য প্রীতির উলঙ্গ থাকার বিষয়টি ঠিক নয় বলে জানিয়েছে। ময়নাতদন্ত, সুরতহাল রিপোর্ট— এই ধরনের অনেক প্রক্রিয়া আছে। সেই ধাপগুলো কীভাবে নিষ্পন্ন হয়েছে। আর সবচেয়ে বড়সড় প্রশ্ন হচ্ছে বিচারটা আদৌ ঠিকঠাক হবে তো? এইরকম অনেক ভাবনা আমাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুর ১০ দিন পর ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম একটি বিবৃতি দেন, যা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। প্রকাশ পেয়েছে মাহফুজ আনামের নিজের পত্রিকাটিতেও, ‘প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যু: ডেইলি স্টার সম্পাদকের বক্তব্য’ শিরোনামে।

সেই বিবৃতিতে তিনি দাবি করেছেন, তার অসুস্থতাজনিত কারণে বক্তব্য দিতে বিলম্ব হয়েছে। ডেইলি স্টারের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক অসুস্থ হলে প্রাতিষ্ঠানিক ভাষ্য জানাবার মতো কেউ থাকবেন না, এটা ভাবতেও অবাক লাগে। তবু তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম ডেইলি স্টার সম্পাদক হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় জরুরিভিত্তিতে নয়া দিল্লিতে কার্ডিওলজিস্টের কাছে গিয়েছিলেন বলে পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদকের বাসায় ঘটে যাওয়া এমন মর্মন্তুদ ঘটনা সম্পর্কে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে দেরি হয়েছে। কিন্তু ১০ দিন পরে যে বক্তব্য দিলেন সম্পাদক তা-তো আমাদের গভীরভাবে হতাশ করেছে। তিনি অভিযুক্ত নির্বাহী সম্পাদকটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো আমাদের মতো সংক্ষুব্ধ মানুষের প্রশ্ন আমাদের কাছে ফিরে দিয়েছেন, “আমাদের পাঠক ও পৃষ্ঠপোষক এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমের একটি অংশে মূলত দুটি প্রশ্ন উঠেছে। প্রথমটি, অভিযুক্ত ব্যক্তি দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক হওয়ার কারণে শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা হিসেবে আমরা কি তদন্ত প্রক্রিয়ায় কোনোভাবে প্রভাব বিস্তার করছি? এবং দ্বিতীয়টি, আমরা কি এ ঘটনায় সেভাবেই প্রতিবেদন প্রকাশ করছি, যেভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রে করি?”

তাহলে কি আমরা ধরে নেব শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলো বিচারিক বিষয়ে তদন্ত প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে পারে? পারে। ডেইলি স্টার এমনটা করার কথা ভাববে, তখন পর্যন্ত আমি অন্তত ভাবিনি। এখন সন্দেহ করছি। ডেইলি সম্পাদকের দাবি, তারা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমনটা করেন। আদতে কি তা করেছেন তারা? করেননি যে তার প্রমাণ ডেইলি স্টার সম্পাদকের বক্তব্যের পর তার কাছে পাঠানো খোলা চিঠি নিয়ে পরিবেশিত খবরটি। এই খোলা চিঠির কথা অত্যন্ত গুরুত্বহীনভাবে প্রকাশ করেছে, যেন দায় সারবার জন্যই করেছেন। শুধু তাই নয়, ওই খোলা চিঠি নিয়ে কোনো বক্তব্য দেননি তারা।

প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুটি যদি সৈয়দ আশফাকের বাসায় না হয়ে রাম-শ্যাম-যদু-মধু কারোর বাসায় হতো ডেইলি স্টার কী করত? তারা নিশ্চয়ই প্রীতির মা-বাবার হাহাকার নিয়ে খবর প্রকাশ করত। মামলাটা কেন ঠিকঠাক ধারায় হলো না তা-ও থাকত ডেইলি স্টারের অন্য কোনো ফলোআপে। ফেরদৌসীর কথা লেখা হতো নিশ্চিত ধারণা করা যায়।

অথচ ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম এ নিয়ে তার বক্তব্যে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অর্থাৎ দোষ প্রমাণিত না হলে নির্বাহী সম্পাদককে বরখাস্ত করা যাবে না। বরখাস্ত না করুন, সাময়িক বরখাস্ত করা তো অনিবার্য ছিল। বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হলে না হয় তাকে কাজে ফিরিয়ে নিতেন। আসলে ডেইলি স্টার সম্পাদকের এই বক্তব্য আমাদের চোখে ধুলো দেওয়া এবং প্রীতি উরাং হত্যার বিচার দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনে জল ঢালার শামিল। সৈয়দ আশফাক জামিনে বেরিয়ে এলে কি ডেইলি স্টার তাকে নির্বাহী সম্পাদকের পদে যোগ দিতে দেবে? তাই যদি হয়, প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যু নিয়ে দায়ের করা মামলার পরিণতি কি ফেরদৌসীকে নিপীড়ন মামলার মতো লাখ দুয়েক টাকায় সমাধান করা সহজ হবে না?

ডেইলি স্টার সম্পাদকের সেই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ’ নামের একটি প্লাটফর্ম ডেইলি স্টার সম্পাদককে খোলা চিঠি প্রেরণ করে। নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগের পক্ষে যুব ইউনিয়নের সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম ডেইলি স্টার কার্যালয়ে গিয়ে ১৮ ফেব্রুয়ারি চিঠিটি হস্তান্তর করেন। ডেইলি স্টার সম্পাদকের ব্যক্তিগত সহকারী মাহাদী হাসান সংবাদমাধ্যমের কাছে এই চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ মাহফুজ আনামের কাছে লিখিত চিঠিতে বেশকিছু বিষয় খোলাসা করার জন্য দাবি জানিয়েছিল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল, ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক থেকে আশফাকুলকে অব্যাহতি প্রদান।

প্রীতি উরাং এবং এর আগে আশফাকুলের বাসা থেকে পড়ে গুরুতর আহত হওয়া ৭ বছরের গৃহকর্মী ফেরদৌসীর শিশুশ্রমের বিষয়ে ডেইলি স্টার সম্পাদকের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয় ওই খোলা চিঠিতে। একই সঙ্গে প্রীতি উরাং আর ফেরদৌসীর জন্য ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে ডেইলি স্টারের সহায়তার দাবি জানানো হয়। এই খোলা চিঠিটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমসহ অনেক সংবাদমাধ্যমে একটু সবিস্তারে প্রকাশিত হলেও ডেইলি স্টারে প্রকাশ করে দায় মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে। ফেরদৌসীর অবস্থা এখন আমাদের অজানা নেই। কিন্তু গত বছর অগাস্টে লাফিয়ে পড়ে ফেরদৌসী যখন আহত হয়, তখন ডেইলি স্টার কী করেছিল? আমরা এখন গুটিকয়েক সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বেঁচে থাকা ফেরদৌসীর জীবনে নেই কোনো আশার আলো। ডেইলি স্টার কি ফেরদৌসীর মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া, মৃতপ্রায় অবস্থায় বেঁচে থাকা নিয়ে কোনো খবর প্রকাশ করেছে? যতদূর জানি ডেইলি স্টার একা নয়, ফেরদৌসী লাফিয়ে পড়ার পর দেশের শীর্ষস্থানীয় সব সংবাদমাধ্যমই ভয়াবহ নীরবতা পালন করেছিল তখন। এখনো তাদের মৌনব্রত পালন শেষ হয়নি।

প্রীতি ও ফেরদৌসীকে নিয়ে ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ’ যে যৌক্তিক বিষয়গুলো তাদের খোলা চিঠিতে তুলে এনেছে, আমরা আশা করেছিলাম ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম সে বিষয়ে তার বক্তব্য জানাবেন। কিন্তু তিনি ভয়াবহভাবে মৌন থেকে গেলেন। ডেইলি স্টার সম্পাদকের এই মৌনতা প্রীতি উরাং এবং ফেরদৌসীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সহায়ক না প্রতিবন্ধক সেটা বিজ্ঞজনরাই ভালো জানবেন। তবে তার এই মৌনতা প্রাথমিকভাবে সুস্পষ্টভাবে পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক আশফাকুলের পক্ষেই যায়। প্রীতি উরাংয়ের হত্যাজনিত মামলায় আশফাকুল ও তানিয়া দম্পতি কারাগারে আটক থাকলেও আশফাক সাহেব ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের বদান্যতায় এখনও পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে বহাল আছেন।

গেল বছর ৬ অগাস্ট আশফাকুলের বাসা থেকে পড়ে গিয়ে ৭ বছরের গৃহকর্মী ফেরদৌসী মারাত্মক আহত হয়। ৬ মাসের অধিক সময় পার হয়ে গেলেও ফেরদৌসী এখনও শয্যাশায়ী। এর মধ্যেই আমরা খবর পেলাম দুই লাখ টাকার ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে আশফাকুল সেই মামলাটির আপসরফা করেছেন। তিনি এবং তার স্ত্রী সেই মামলা থেকে অব্যাহতিও পেয়েছেন। আদালতে ফেরদৌসীর মা বলেছেন তিনি দুই লাখ টাকার চেক পেয়েছেন। কিন্তু চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে যে দালাল মধ্যস্থতা করেছে সে প্রায় এক লাখ টাকা বিভিন্ন খরচ বাবদ নিয়ে নিচ্ছে বলে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা গেছে। তাহলে বাকি থাকে এক লাখ। ফেরদৌসীর পড়ে যাওয়া নিয়ে তার মা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “বাসার মালিক তাকে বাড়িতে যেতে দিচ্ছিল না। তাই সে ওপর থেকে জানালা দিয়ে নামার চেষ্টা করছিল। কিছু দূর নামার পর পা পিছলে নিচে পড়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে যায়।”

ফেরদৌসী যখন লাফিয়ে পড়েছিল, তখনো প্রীতি উরাং সৈয়দ আশফাকের বাস কাজ করত। ফেরদৌসী বেঁচে আছে, এই খবর নিশ্চয়ই প্রীতির জানা ছিল, তাই লাফিয়ে পড়ে নিজের মুক্তি আনতে চেয়েছিল। কিন্তু পেয়েছে মহামুক্তি।

প্রীতি উরাংয়ের মা-বাবা বলেছেন, তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না মেয়েটির। তারা বারবার চেষ্টা করেও মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। শিশুদের এক প্রকার বন্দি করে রেখে কাজে খাটানো হতো আশফাকের বাসা নামক বন্দিশালায়। কী নির্মম আর ভয়াবহ বিষয়। ভাবতেই গা শিউরে উঠে। প্রীতির মা-বাবা তাদের মেয়ের সঙ্গে ফোনে পর্যন্ত কথা বলার সুযোগ পেতেন না। প্রীতি তার মৃত্যুর আগে প্রায় দুই বছর বাবা-মায়ের মুখ দেখেনি, ভালো-মন্দ দু-কথা বলার সুযোগটুকু তাকে দেওয়া হয়নি। প্রীতির সঙ্গে এমন আর কী কী অমানবিক আচরণ সংঘটিত হয়েছে? সেসব প্রকাশ্যে আসার সুযোগ আছে কি? আমরা প্রায়ই শুনি বা দেখি রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নানান তথ্য সংবাদমাধ্যমে চলে আসে। রিমান্ডে নেওয়া কর্তৃপক্ষসমূহ সংবাদ সম্মেলন করে তথ্য প্রচার করতে বেশ উৎসাহী হন। কিন্তু প্রীতির ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা পরিলক্ষিত হয়েছে। রিমান্ড শেষে আসামিদের আদালতে আনা হয়। আদালত জামিন না মঞ্জুর করে তাদেরকে কারাগারে পাঠান। এর বাইরে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

প্রীতি উরাং মারা যাওয়ার পর সংবাদমাধ্যমগুলো শুরুতে সংবাদটি প্রচার করতে বেশ দ্বিধায় ভুগেছে, এর আগে ফেরদৌসীর ঘটনার সময় তো গোপন করেই গিয়েছিল তখন। সংবাদমাধ্যমের দ্বিধা এখনো কাটেনি। খোদ রাজধানীর একটি ভবন থেকে এক নাবালিকা গৃহকর্মী পড়ে মারা গেল। টিভি চ্যানেল, অনলাইন মিডিয়া এবং জাতীয় দৈনিকগুলোতে হৈচৈ পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটা আমরা দেখিনি। প্রতিবাদের ধরনটাও তেমন সোচ্চার ছিল না।

প্রীতি একজন আদিবাসী কিশোরী। আদিবাসী নারী ছাত্র ও যুব সংগঠনসমূহের উদ্যোগে ঢাকায় সম্মিলিত একটা প্রতিবাদ চোখে পড়েছে। কিন্তু সেটা আরও তীব্র এবং ধারাবাহিক হওয়া দরকার ছিল। অবশ্য গৃহকর্মীদের নিয়ে কাজ করে এই রকম একটি সংগঠন শুরু থেকেই প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল। পরে ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ’ উদ্যোগী হয়ে মাঠে নামে। সচরাচর যে সব মানবাধিকার সংগঠন, প্রতিষ্ঠান কিংবা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা আওয়াজ তোলেন তারাও প্রীতি উরাং বিষয়ে সরব হননি। এই ক্ষেত্রে শ্রেণিবৈষম্যের প্রশ্ন সামনে চলে আসে। মোহাম্মদপুরের যারা স্থানীয় হিসেবে মিছিল করেছিলেন, তারাও কিন্তু জেনিভা ক্যাম্পের নিপীড়িত মানুষ। অর্থাৎ প্রীতি উরাংয়ের মর্মান্তিক মৃত্যু ভদ্রলোকদের তেমন নাড়া দিতে পারেনি। এসবের বাইরে দু-একটি অস্বাভাবিক কর্মসূচিও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে কে বা কারা কয়েকদিন মাঠে ছিল, সেটাও একটা বড় রহস্য।

প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যু নিয়ে আমরা বিপরীতভাবেও ভাবতে পারি। প্রীতি উরাং নামের এক কিশোরী ঢাকা শহরে গৃহকর্মীর কাজ করত। প্রীতি এভাবে না মরলে সেটা আমরা কি জানতাম? সুতরাং প্রীতি উরাংয়ের ১৫ বছরের যাপিত জীবনের মধ্যে মৃত্যুটাই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই পড়ে গিয়ে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে তো প্রীতি এখন রীতিমতো তারকা বনে গেছে। লাখো লোক প্রীতি উরাংয়ের নাম জানতে পেরেছে। ফেসবুকের নিউজফিডে প্রীতি ভেসে বেড়াচ্ছে। এভাবে না মরে শত বছর বাঁচলে কেউ কি প্রীতিকে এতটা চিনত? সুতরাং এই অস্বাভাবিক মৃত্যু যেটা স্থানীয় কিছু দুষ্টু প্রকৃতির ছোটলোকরা হত্যাকাণ্ড বলার চেষ্টা করছে, সেটাই প্রীতি উরাংয়ের জন্য মরণোত্তর পদক হিসেবে ধরে নিলে সব ল্যাঠা চুকে যায়।

প্রীতি তো মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। আশফাকুলের বাসার আরেক শিশু গৃহকর্মী ফেরদৌসীর বাকি জীবনটা কী হবে? সবে মাত্র ৮-৯ বছর বয়স।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এক ভয়াবহ অবস্থার চিত্র বর্ণনা করেছেন ফেরদৌসীর মা। ফেরদৌসীর বর্তমান শারীরিক অবস্থা নিয়ে তিনি বলেছেন, “দুই দফা অস্ত্রোপচারের পর হাসপাতাল ছাড়লেও এখনো বসলে উঠে দাঁড়াতে পারে না ৯ বছরের ফেরদৌসী, প্রস্রাব করতে গেলেও চিৎকার দিয়ে ওঠে যন্ত্রণায়।” আমরা কি ফেরদৌসীর এই জীবন কাহিনি জানি? যে আদালত দুই লাখ টাকার আপসরফায় আশফাক দম্পতিকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন, সেই মহামান্য আদালতে সরকারপক্ষের আইনজীবীরা কি এই তথ্য উপস্থাপন করেছেন? যে ডেইলি স্টার নানান সংবাদ নিয়ে দেশের শীর্ষ ইংরেজি দৈনিকের সুনাম অর্জন করেছে, সেই ডেইলি স্টারও কি ফেরদৌসীর এই করুণ দুঃসহ জীবন নিয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশ করেছে। করেনি আগেই বলেছি। কেন করেনি, আমাদের বড়ই জানতে ইচ্ছে করে। খুব জানতে ইচ্ছে করে।

‘পদ্মা নদীর মাঝি’র কুবেরের আক্ষেপ ছিল, ঈশ্বর থাকেন ভদ্রপল্লীতে। ফেরদৌসী এবং প্রীতি উরাংদের ক্ষেত্রেও আইন-আদালত ওই ভদ্রপল্লীতেই বসবাস করে বললে অত্যুক্তি হবে না। এটাই শ্রেণিবৈষম্যে জর্জরিত সমাজের রেওয়াজ। আমরা যতই প্রীতি এবং ফেরদৌসীকে গৃহকর্মী বলি না কেন তারা আসলে শ্রমদাস। তাদের সঙ্গে শ্রমদাসের আচরণই করা হয়েছে। এই ভদ্রসমাজ দুই শিশু শ্রমদাসের জন্য প্রতিবাদে গলা ফাটাবে না। মাঠে সোচ্চার আওয়াজ তুলবে না। কিন্তু ভদ্রলোকের মুখোশটা রক্ষার জন্য হলেও একটু মায়াকান্না কাঁদা দরকার, সেটুকু অন্তত হোক।